(দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) ‘স্যার আমার নামডা লেইখেন। আমাগো সব পুড়ে শেষ হইয়া গ্যাছে গা। লোন নিয়া তিনডা ঘর বানাইছিলাম পুইড়া গ্যাছে। এখন প্লাস্টিকের নিচে আছি। দেড় লাখ টাকা লোন নিছিলাম। ৫০ হাজার শোধ করছি। এহন ভাত খামু না কি কিস্তি দিমু।’
রাজধানীর বনানী এলাকার গোডাউন বস্তির (বেদে বস্তি) আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত রেহেনা বেগম এসব কথা বলছিলেন। গত রোববারের ভয়াবহ আগুনে সব পুড়ে ছাই হয়ে যায় তার। সেদিনের আগুনে সব হারান দুই শতাধিক পরিবার।
রেহানা বেগম বলেন, স্বামী মফিজের সঙ্গে ওই বস্তিতেই থাকতেন তারা। সেখানে অনেক কষ্ট করে ঋণ নিয়ে তিনটি ঘর বানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। যে ঋণ করে ঘর বানিয়েছিলেন সেই ঘরে প্লাস্টিক দিয়ে এখন রাত কাটাচ্ছেন। আর কখনও ঘর বানাতে পারবেন কি না ভুগছেন অনিশ্চয়তায়। কারণ মাথায় তাদের লাখ টাকার ঋণ। যা এখনো পরিশোধ হয়নি।
রেহানা বলেন, তিনি অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। আর তার স্বামী মফিজ ময়লার কাজ করেন। স্বামীর বেতন ৮ হাজার। আর তার বেতন ৪ হাজার। এই ১২ হাজার টাকার ওপর ভরসা করে দেড় লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন তারা। সেই ঋণের মাত্র ৫০ হাজার শোধ করেছেন। এখনো এক লাখ টাকা ঋণ আছে।
রেহেনা জানান, এবারই প্রথম নয়। সাড়ে চার বছর আগেও একবার ঘর পুড়েছিল তাদের।
শুধু রেহেনা ও মফিজ দম্পতিই নয়, বস্তিটিতে অধিকাংশ মানুষজন ঋণ করে ধার দেনা করে ঘর বানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ঘর এখন ধ্বংসস্তুপ। এমন অবস্থায় ঋণ তাদের কাছে মরার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত রোববারের বিকেলের গুনে বস্তিটির ২২০ পরিবার হারিয়েছে তাদের কয়েক বছরের সহায় সম্বল। জমানো টাকা পয়সা ও শখের কেনা জানা তৈজসপত্রও কিছুই রক্ষা পায়নি ভয়াবহ আগুন থেকে। বাদ যায়নি বস্তিবাসীর ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার বইপত্রও। ঘরপোড়া মানুষগুলো এখন প্লাস্টিকের ত্রিপল বানিয়ে তার নিচে ঘুমাচ্ছেন। অনেকের ঘরে খাবারও নেই।
ভরদুপুরে প্লাস্টিকের ত্রিপলের নিচে সাত বছরের ছেলে ও ছোট দেবরকে নিয়ে বসে আছেন নিপা আক্তার। দুইদিন আগেও তাদের ঘর ছিল, ছিল শোয়ার খাট। কিন্তু এখন আর কিছুই নেই। চোখের সামনেই সব কিছু পুড়ে গেলেও চেয়ে দেখা ছাড়া তাদের আর কিছুই করার ছিল না।
নিপা বলেন, ‘যখন আগুন লাগছে জানছি তখন কিছু নিবার পারি নাই। কারণ ঘরের ভেতর ঢুকলে আর বাইর হইবার পারতাম না।’
নিপার স্বামী সিংড়া বিক্রি করেন। কিন্তু ঘর পুড়ে এখন সেই ব্যবসাও বন্ধ। পুঁজিও তেমন নেই। তাছাড়া পরপর দুইবার ঘর পোড়াতে তারাও অন্যের মতো ঋণী। রেহেনার মতো সাড়ে চার বছর আগে নিপার স্বামীরও ঘর পুড়েছিল। এবার আগুনের অবস্থা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, তারা কোনমতে প্রাণ নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছেন।
নিজের গায়ের কাপড়টি দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘এটি ছাড়া আর কিছু নেই। আমরা যখন আগুন লাগা টের পাইছি তখন জিনিস নিতে গেলে বাঁচতাম না।’
খাবার নয়, ঘর বানাতে টিন-কাঠ চান বস্তিবাসী
দুই ছেলে, ছেলের বৌ ও স্বামীকে নিয়ে ভালোই সংসার চলছিল সকিনা বেগমের। কিন্তু আগুন তাদের পথে বসিয়ে দেয়। এখন তারা কোনমতে রাত কাটাচ্ছেন খোলা আকাশের নিচে।
সকিনা জানান, তাদের ৪০ হাজার টাকা ঋণ আছে। ফলে নতুন ঘর করবেন সেই অবস্থাও তাদের নেই। দুই যুগে তারও দুইবার ঘর পুড়েছে বলে জানান।
সকিনা বলেন, ‘আমরা খাবার চাচ্ছি না। এই রোদের মধ্যে থাকতে পারছি না। মাথা ছিড়ে যাচ্ছে। তার ওপর রোজা। অনেক কষ্ট হচ্ছে। সরকার আমাদের চালের (টিন ও কাঠ) ব্যবস্থা করে দিতো তাহলে খুব ভাল হতো।
একই দাবি করেন খাদিজা আক্তারও। তিনিও আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তার পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের আটটি ঘর পুড়েছে। খাদিজা বলেন, ‘আমরা এখনো কিছু পাইনি। আমরা এমন কিছু চাই যাতে থাকতে পারি। সরকার টিন ও কাঠ দিলে ঘর বানাইতে পারতাম।’
ফারুক নামে এক বস্তির বাসিন্দা জানালেন, বস্তির আব্দুল, নাসির, রমজান মিয়া, সেলিম মিয়ার দুটি করে ঘর পুড়েছে। তাদের কোন সামর্থই নেই ঘর বানানোর। এজন্য তারা বিত্তবান মানুষের সহায়তা চেয়েছেন।
খাবার দিচ্ছে কাউন্সিলর
বস্তিবাসী জানান, আগুন লাগার রাত থেকে তাদেরকে খাবার দিচ্ছেন উত্তর সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ নাসির। রাতে ও সেহরি ছাড়াও ইফতার পাচ্ছেন তারা। অস্থায়ী ঘর বানিয়ে থাকার জন্য প্লাস্টিকের ত্রিপল ও প্লেট দিয়েছে ব্র্যাকের কর্মীরা। তাছাড়া আর কেউ খোঁজ নেয়নি। -নিউজ ডেস্ক