(দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) গত বৃহস্পতিবার (৯ মে) রাজধানীর বনানী এলাকায় দায়িত্ব পালন করছিলেন গুলশান ট্রাফিকের কয়েকজন সদস্য। হঠাৎ এক যুবক ট্রাফিক সিগন্যালে এসে দাঁড়ান। ওই সময় অভিযান চলছিল। সেই যুবকের মোটরসাইকেলের সামনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো সম্বলিত স্টিকার লাগানো। এ সময় তাকে সেখানে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ সদস্যরা জিজ্ঞেস করেন- তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেন কি না। কিন্তু সেই যুবক কোনো জবাব দিতে পারেননি। হাসতে হাসতে জানান, তার এক আত্মীয় সেখানে চাকরি করেন। এছাড়া এমন স্টিকার লাগালে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায় এই ভেবে তিনি স্টিকার ব্যবহার করছেন। পরে পুলিশ সদস্যরা দ্রুত তার স্টিকার মোটরসাইকেল থেকে খুলে ফেলতে বলেন। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কেউ না হয়েও স্টিকার ব্যবহারের অপরাধে তাকে জরিমানাও করা হয়।
একই দিন গুলশান এলাকায় নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা এক ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ট্রাফিক পুলিশের অভিযানে পড়েন। সেই ব্যক্তির মোটরসাইকেলের সামনে লেখা ছিল সাংবাদিক। এমন লেখা দেখে পুলিশ তাকে জিজ্ঞেস করেন, তার আইডি কার্ড আছে কি না এবং তিনি কোথায় কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। এরপর সেই ব্যক্তি তার পরিচয়পত্র বের করলে পুলিশ সদস্যদের চোখ কপালে উঠে যায়। তারা তার পরিচয়পত্রে দেখতে পান, তিনি নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় একটি কথিত পত্রিকায় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। সেই প্রতিষ্ঠান থেকে সরবরাহকৃত পরিচয়পত্রটির মেয়াদও তিন বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে। এরপরও তিনি সেটি ব্যবহার করে রাজধানীজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।
শুধু এই দুটি ঘটনাই নয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সচিবালয়, ঢাকা ওয়াসা, সিটি করপোরেশন, তিতাস গ্যাস, স্বাস্থ্য অধিদফতর, হাসপাতাল, বিভিন্ন কলেজ এমনকি সচিব পদমর্যাদার ব্যক্তির পরিচয় সামনে লিখে ও স্টিকার লাগিয়ে গাড়ি নিয়ে চলাচল করতে গিয়ে পুলিশের অভিযানের মুখে পড়েছেন এমন কয়েকশ ব্যক্তি। যাদের বেশিরভাগের কোনো বৈধতা নেই। তারা সেইসব প্রতিষ্ঠানের কেউই নন। তাদের কোনো আত্মীয়-স্বজন চাকরি করেন অথবা তারা কখনো সেই প্রতিষ্ঠানে চাকরি তো দূরের কথা এই প্রতিষ্ঠান কোথায় সেটাও জানেন না।
সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ এসব অবৈধ ও অননুমোদিত স্টিকারের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে। ১৫ এপ্রিল থেকে ৩ মে পর্যন্ত এই স্টিকার অবৈধভাবে ব্যবহারের অভিযোগে জরিমানা গুনেছেন কিংবা মামলার মুখে পড়েছেন ৩৬৩ জন। এরপরও বন্ধ হচ্ছে না অবৈধ এবং অননুমোদিত স্টিকার ব্যবহার। বাধ্য হয়ে পুলিশ প্রশাসন সংশ্লিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানকে সচেতন করতে এবং তাদের লোগো সম্বলিত স্টিকার ব্যবহার করে অপরাধীরা নানা অপরাধ ও সুবিধা নিচ্ছে জানিয়ে চিঠিও পাঠিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৫ সালের আগে থেকেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও মন্ত্রণালয়ের লোগো সম্বলিত স্টিকার ব্যবহার হচ্ছে। ফলে সেই সময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টির ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়ে পরিপত্র জারি হয়েছিল। সেটি ২০১৫ সালের ৩০ নভেম্বর জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এরপর সেটি বিভিন্ন দফতরে পাঠানো হয়। বিশেষ করে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এমন স্টিকার ব্যবহার করে ব্যক্তিগত গাড়ি চালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন বলে সেই চিঠিতে জানানো হয়।চিঠিতে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বলা হয়েছিল, লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারীদের অনেকেই ব্যক্তিগত গাড়িতে মন্ত্রণালয়/দফতরের নাম সম্বলিত স্টিকার ব্যবহার করছেন। এ ধরনের ব্যক্তিগত গাড়ি কখনো কখনো অবৈধ কাজে ব্যবহার হচ্ছে মর্মে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এতে সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারীদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
এমতাবস্থায়, যথাযথ সরকারি কর্তৃপক্ষ মাধ্যমে (কর্তৃক) ইস্যুকৃত স্টিকার ব্যতীত সরকারের মনোগ্রামযুক্ত মন্ত্রণালয়/দফতরের নাম সম্বলিত কোনো প্রকার স্টিকার/কম্পিউটার কম্পোজকৃত/টাইপকৃত/অন্য কোনোভাবে প্রস্তুতকৃত বোর্ড/পোস্টার ইত্যাদি ব্যক্তিগত গাড়িতে ব্যবহার না করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে অনুরোধ করা হলো। এই নির্দেশনা যথাযথভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে কি না এ বিষয়ে সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
প্রায় নয় বছর হতে চলেছে, কিন্তু সেই নিয়ম আজও কেউ মানছে না। বিশেষ করে সরকারি কর্মকর্তার পরিচয়ে থাকা ব্যক্তি ও আত্মীয়-স্বজনরাই এমন কাজ বেশি করছেন বলে গত মাস থেকে চলা ট্রাফিকের অভিযানে ওঠে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে বিব্রত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও।
ট্রাফিকের উত্তর বিভাগের গুলশান জোনের এডিসি হাফিজুর রহমান বলছিলেন, আমরা প্রতিদিন স্টিকার লাগানো গাড়ি পাচ্ছি। এই তালিকায় সিটি করপোরেশন, ওয়াসা ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের গাড়িও আছে। তবে সেগুলোতে সেসব প্রতিষ্ঠানের লোগো লাগানো স্টিকার থাকলেও গাড়িটি ব্যক্তিগত। এটি অবৈধ। একমাত্র প্রতিষ্ঠানের গাড়িতে এমন সব স্টিকার ব্যবহার করা যাবে, ব্যক্তিগত গাড়িতে নয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যেমন ২০১৫ সালে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছিল তেমনি ২০২৩ সালে এসে উত্তর করপোরেশনও চিন্তায় পড়ে। কারণ প্রতিষ্ঠানটির স্টিকার ব্যবহার বাড়ছিল। ফলে তারা সেটি বন্ধে পুলিশের সহায়তা চেয়ে চিঠি দিয়েছিল। সেই চিঠি উত্তর সিটির মেয়র থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতর এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে গুলশান ট্রাফিক বিভাগ ও উত্তর বিভাগকেও দেওয়া হয়।
উত্তর সিটির সেই চিঠিতে বলা হয়, ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মনোগ্রাম সম্বলিত স্টিকার ব্যক্তিগত বা সংশ্লিষ্ট দফতরের আওতা বহির্ভূত বিভিন্ন গাড়িতে (কার/জিপ/পিকআপ/মটর সাইকেল) ব্যবহার করা হচ্ছে। এ সকল গাড়ি/মটর সাইকেল ডিএনসিসির মালিকানাধীন নয়, অধিকাংশই ব্যক্তিগত গাড়ি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নিজস্ব ও কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত গাড়ি ব্যতীত অন্য গাড়িতে এরূপ অননুমোদিত স্টিকার ব্যবহার করা হচ্ছে, যা অনভিপ্রেত।
এমতাবস্থায়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নিজস্ব ও কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত গাড়ি ব্যতীত ডিএনসিসি’র অননুমোদিত অন্য কোনো ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের গাড়িতে (কার/জিপ/পিকআপ/মোটরসাইকেল) ব্যবহৃত স্টিকারের বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্ত আপনাকে অনুরোধ করা হলো।
গুলশান ট্রাফিকের নাম প্রকাশ না করা শর্তে এক কর্মকর্তা জানান, উত্তর সিটি করপোরেশনের লোগো সম্মিলিত স্টিকার ব্যবহার করা গাড়ি প্রায় দিন ধরা পড়ছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা এর আগেও তাদের জানিয়েছি। এবার অভিযানে সংখ্যাটা বেড়েছে। তবে সেই সংখ্যা কত সেটা তিনি জানাতে পারেননি।
গেল সপ্তাহে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের জয়েন্ট কমিশনার (দক্ষিণ) এস এম মেহেদী হাসান জানান, গত ১৫ এপ্রিল থেকে ৩ মে পর্যন্ত অবৈধ স্টিকার ব্যবহারের দায়ে তারা ৩৬৩টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তারা তাদের গাড়িতে, পুলিশ, সাংবাদিক, ডাক্তার, আইনজীবীসহ বিভিন্ন সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের স্টিকার লাগিয়েছিলেন।
তিনি আরও জানান, ভুয়া স্টিকার ব্যবহার করে অপরাধ বাড়ছে। ভুয়া স্টিকারের কারণে পুলিশের দায়িত্ব পালনেও নানা অসুবিধা হয়। এই কারণেই তারা অভিযান চালাচ্ছেন। তাদের এই অভিযান চলবে।
পুলিশ সদস্যরা বলছেন, অভিযানে বিভিন্ন সরকারি অফিস, সাংবাদিক বা বিভিন্ন স্পর্শকাতর পেশার পরিচিতি সম্বলিত ভুয়া স্টিকার ব্যবহার করা গাড়ি আটক হচ্ছে। আসলে তাদের এমন বৈধতাও নাই। এটার ব্যবহারের সাথে অপরাধ বাড়ছে।
শুধু পুলিশ ও সাংবাদিকের পরিচয়ে স্টিকার নয়, সংসদ সদস্য, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লোগো সম্বলিত স্টিকারও গাড়িতে ব্যবহার করে নানা সুবিধা আদায় করছেন অপরাধীরা। এমন স্টিকার ব্যবহার করে মাদক পর্যন্ত পাচার করছে মাদক কারবারিরা।
অপরাধ দমনে নিয়োজিত এমন ব্যক্তিরা বলছেন, অপরাধীরা মাদক নিরাপদে বহনে এখন সাংবাদিক, ওয়াসা, সিটি করপোরেশন, সরকারি দফতরের লোগো সম্বলিত স্টিকার লাগিয়ে গাড়ি নিয়ে ঘুরছে। অনেক ক্ষেত্রে ওই প্রতিষ্ঠানের কেউ না হয়েও পরিচয় আত্মীয়তার সূত্রে প্রতিষ্ঠানের স্টিকার ব্যবহার করা হয়। এমনকি সংসদ সদস্যদের স্টিকারও অন্যদের ব্যবহারের নজির আছে।
পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, শুধু সাংবাদিক পরিচয় দেওয়া ও মিডিয়ার স্টিকার ব্যবহার করে মাদক পাচারের সময় বেশ কিছু বাহনকে তারা ধরেছেন। সেই সাথে এ কাজে যারা জড়িত ছিল তারা পরে জানতে পারেন তারা কেউ সাংবাদিক নন। পাশাপাশি ডিবি লিখেও মাদক পাচার করার সময় আটক হয়েছে এমন ঘটনাও কম নয়। অপরাধীরা ডিবি, পুলিশ এবং সাংবাদিক স্টিকার লাগিয়ে মাদক পাচার করে এবং অপরাধ করছে। আর এসব ঘটনা বেশি ঘটছে মাদক চোরাচালানের রুট বিশেষ করে সীমান্তের জেলাগুলোতে। কক্সবাজার, চট্টগ্রাম এলাকায় বেশি বেড়েছে। এই এলাকাগুলোতে টিভি চ্যানেলের স্টিকার লাগিয়ে মাদক চোরাচালান করছে অপরাধীরা। অনেক ঘটনা গত কয়েক বছরে ধরা পড়েছে।
২০১৯ সালে সীতাকুণ্ড এলাকায় গাড়িতে ‘গাজী টেলিভিশনের’ স্টিকার লাগিয়ে এক হাজার ৪০০ পিস ইয়াবা পাচারের সময় চার ইয়াবা পাচারকারী আটক হয়। গত বছরের আগস্টে র্যাব ঢাকার একটি মাদক পাচারকারী চক্রের সদস্যদের আটক করে। তারা কখনো নিজেদের পুলিশ, সাংবাদিক, ডিবি ও আইনজীবীর পরিচয় দিতেন। গাড়ির সামনে এসব পরিচয়ের স্টিকার ব্যবহার করে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মাদক সরবরাহ করতেন তারা। তাদের কাছ থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকার বিদেশি মদও উদ্ধার করা হয়।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে নরসিংদীতে র্যাব এমন আরেকটি চক্রকে আটক করে। তারা সংসদের স্টিকার ব্যবহার করে মাদক চোরাচালান করতেন। ঢাকার ওয়ারি এলাকা থেকে গত বছর পুলিশ কয়েকজন ছিনতাইকারীকে আটক করে। যারা মোটরসাইকেলে পুলিশের স্টিকার ব্যবহার করে ছিনতাই করতেন।
সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যরা বলছেন, পুলিশ ও ডিবির শুধু স্টিকার নয়, পোশাক ব্যবহার করেও ছিনতাই অপহরণের মতো ঘটনা আছে। যারা আগে পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করতেন তারা এমন কাজ করছেন। আরেকটি গ্রুপ অ্যাম্বুলেন্স স্টিকার লাগিয়ে মাদক পাচার করে। তারা চলমান অভিযানে আটক হবেন বলে আশা তাদের।
ঢাকা মহানগর পুলিশের জয়েন্ট কমিশনার ট্রাফিক আবু রায়হান মোহাম্মদ সালেহ বলছিলেন, আমাদের ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। আমরা বিষয়টিতে এখন জিরো টলারেন্স পর্যায়ে আছি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মনিবুর রহমান বলেন, সন্দেহজনকভাবে স্টিকার ব্যবহার করছে বলেই অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। মূলত স্টিকারগুলো আইনসম্মতভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না। অনেকে সুযোগ নিচ্ছে আবার অনেকেই অপব্যবহার করছে। ফলে এই অভিযান। এটাই আমাদের বার্তা। মানুষকে সচেতন করে আইনের পথে নিয়ে আসা।
এই কর্মকর্তা বলেন, যারা বৈধভাবে স্টিকার ব্যবহার করছে তাদের ব্যাপারে আমাদের কোনো প্রশ্ন নেই। স্টিকারের যেন বৈধতা থাকে এবং আইন এবং প্রশাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে। আইনসম্মতভাবে যেন স্টিকারটা ব্যবহার করা হয়। বিষয়গুলো মানুষকে বোঝানোর জন্যই অভিযান পরিচালনা করছি। -নিউজ ডেস্ক