(দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার কুচিয়ামোড়া গ্রামের মনিরুল ইসলাম পলাশ। ভালো আয়ের স্বপ্ন নিয়ে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ধারসহ এনজিও থেকে লোন নিয়ে ৫ লাখ টাকা জোগাড় করে তা তুলে দেন স্থানীয় দালালের হাতে। উদ্দেশ্য ছিল মালয়েশিয়া যাবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন এখন তার দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। মালয়েশিয়া যাওয়া তো দূরের কথা ধারে আনা টাকা কিভাবে পরিশোধ করবেন আর সংসার কিভাবে চালাবেন সেই চিন্তায় মরতে বসেছেন।
পটুয়াখালী সদর উপজেলার কমলাপুর ইউনিয়নের শফিকুর রহমান। তিনি তার ছেলে, ছোট ভাই, ভাতিজা ও ভাগিনার জন্য কলিং ভিসায় মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য দালাল ধরে এজেন্সিকে ২০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। দালাল ও এজেন্সির দেওয়া আশ্বাসে তারা গত মঙ্গলবার ঢাকায়ও আসেন। এরপর টানা তিনদিন ছিলেন এজেন্সির অফিসের বাইরে খোলা জায়গায়। কিন্তু চারদিন অতিবাহিত হলেও তাদের ফ্লাইটের টিকিট দেওয়া হয়নি। উল্টো শেষদিন শুক্রবার তাদের টিকিট সংগ্রহ চলছে জানিয়ে বিমানবন্দর পাঠিয়ে দেয় এজেন্সির কর্মীরা। পরে তারা হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে যান। কিন্তু সেখানে প্রায় ১৮ ঘণ্টা অপেক্ষা করলেও সেই এজেন্সি মালিক আর টিকিট নিয়ে আসেনি। এমনকি সেদিন থেকে কল দিচ্ছেন, কিন্তু সেই ব্যক্তিকে ফোনে পাচ্ছেন না এই চার ভুক্তভোগী।
গত শুক্রবার সারাদিন ছিল মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশ থেকে কর্মী যাওয়ার শেষ দিন। ওইদিনই যাওয়ার কথা ছিল কুষ্টিয়ার মনিরুল ইসলাম পলাশের। কিন্তু তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। শুধু তিনিই নন, তার মতো প্রায় ৩১ হাজার কর্মীর স্বপ্ন এখন মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। তাদের ভবিষ্যত কি, তারা টাকা ফেরত পাবেন কিনা, যেতে পারবেন কিনা এবং ধারে আনা টাকা কিভাবে পরিশোধ করবেন সেই চিন্তায় মানুষগুলো দিশেহারা।
কুষ্টিয়ার পলাশ জানান, তারা চারজন যাওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে যশোরের একজন ও বাকি দুজন নারায়ণগঞ্জ জেলার। তারা প্রত্যেকে প্রায় ৫ লাখ টাকা করে দেন। তিনি নিজে ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা দেন, মালয়েশিয়ায় যে কোম্পানিতে তার যাওয়ার কথা ছিল সেখানে দিয়েছেন ৩০ হাজার, এছাড়া আরও খরচ বাবদ তিনি ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা দেন। গালফ ওভারসিস (আরএল-৮২৫) নামে এক এজেন্সিকে এই টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে তিনি দিয়েছিলেন।
জমি বন্ধক রেখে, চড়া সুদে ২০ লাখ নিয়েছেন চারজন
পটুয়াখালীর শফিক আহমেদ জানান, তার ছেলে, ভাগিনা, ছোট ভাই ও ভাতিজার (কাওসার, আবু সাঈদ, মাসুদ রাব্বী) ২০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন সাউথ পয়েন্ট নামে এক এজেন্সিকে। কিন্তু সেই এজেন্সি এখন লাপাত্তা। তাদের কাউকে তারা ফোনে পাচ্ছেন। তিনি বড় বিপাকে পড়েছেন, কারণ মালয়েশিয়া যাওয়া নিয়ে যাবতীয় কথাবার্তা তিনি চালিয়েছেন দেশটিতে থাকা তার সজল নামে এক ভগ্নিপতির মাধ্যমে। সজলের নোমান নামে এক সহকর্মী আবার এজেন্সির দারস্থ হয়ে যাবতীয় কাগজপত্র ঠিক করে দিয়েছে। ফলে সরাসরি শফিকের কোনো যোগাযোগ হয়নি এজেন্সির সাথে। তবে টাকা পয়সা দেওয়ার যাবতীয় ডকুমেন্টস তিনি রেখেছেন বলে দাবি করেন।
তিনি বলেন, গ্রামের এনজিও থেকে লোন নিয়েছি, মানুষের কাছে জমি রাইখা টাকা আনছি। জমি বন্ধক রাখছি। আবার অনেকের কাছ থেকে হাওলাদ (ধার) আনছি। এভাবে ২০ লাখ টাকা ম্যানেজ করছি।
তিনি আরও বলেন, আমরা প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে লোন নিতে চেয়েছিলাম। তারা টিকিট দিতে না পারায় আমরা সেটাও নিতে পারিনি। ভিসা, ম্যানপাওয়ার কার্ড ও টিকিটের ফটোকপি দিলেই আমরা আড়াই লাখ টাকা লোন পাইতাম। কিন্তু সেটাও নিতে পারি নাই। আমাগোরে সেই সময়টাও তারা দেই নাই।
টিকিটের কথা বলে আমাদের আশা দিয়ে তিনদিন বসায় রাখছে। অনেকের ফিঙ্গারিং নিয়েছিল। কিন্তু আমার ছেলে ও ছোট ভাইয়ের ফিঙ্গারিংও নেয়নি। এরপরও বলছে যেতে পারবেন। আমরাও আশায় ছিলাম। কিন্তু তারা যে এভাবে প্রতারণা করবে তা তো বুঝি নাই। এদিকে আমার ভগ্নিপতি বলছে, আপনাদের সোমবার পাঠানো হবে। সেই সজল এখন মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন। তবে ২০ লাখ টাকা তারা দেন গ্রামের রাজ্জাক সিকদার ও সজলের স্ত্রী মোছা. নিশাতকে।
অন্যদিকে কুষ্টিয়ার পলাশ জানান, তিনিও এনজিও থেকে দেড় লাখ টাকা লোন ও বাকি টাকা তার এক ভাইয়ের কাছ থেকে নিয়েছিলেন। ভাইকে বলেছিলেন মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পর কাজ করে পরিশোধ করবেন। পলাশ বলেন, তাদের (এজেন্সি) ফোন বন্ধ পাচ্ছি।
মিষ্টি খাওয়া বাবদ ৫ হাজার করে আদায় করে এজেন্সির কর্মীরা
শফিক জানান, সাউথ পয়েন্ট এজেন্সিতে থাকা অনিক নামে এক ম্যানেজার ও অন্য কর্মীরা তাদের পাসপোর্ট আটকে রেখেছিল। কারণ সবার কাছে তারা মিষ্টি খাওয়ার জন্য ৫ হাজার করে টাকা দাবি করে। পরে বাধ্য হয়ে সেই টাকা দিয়ে সবার পাসপোর্ট বুঝে নিয়ে বিমানবন্দরে রওনা হন। কিন্তু টিকিট দেয়নি তারা। ফলে তারা যেতেও পারেননি।
কলিং ভিসার নামে ভ্রমণ ভিসা দিয়ে প্রতারণা
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে যারা গেছেন তারা সবাই মূলত কলিং ভিসায় গেছেন। তাদের প্রত্যেকের কাছে ৭৮ হাজার করে টাকা নেওয়ার কথা থাকলেও এজেন্সিগুলো নিয়েছে ৫ লাখ থেকে সাড়ে ৫ লাখ টাকা। এখানেই শেষ নয়, যারা যেতে পারেনি তাদের সাথে হয়েছে বড় ধরনের প্রতারণা। প্রত্যেককে কলিং ভিসার কথা বলে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে ভ্রমণ ভিসা। আর বলা হয়েছে, দেশটিতে গিয়ে তারা আবারও ভিসা রিনিউ করতে পারবেন। তখন কাজ পেতে ও করতে কোনো সমস্যা হবে না। এভাবে হাজার হাজার মানুষকে ভ্রমণ ভিসা ধরিয়ে দিয়েছে দালাল, এজেন্সি ও প্রতারক চক্র।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, তারা বেশিরভাগই অল্প শিক্ষিত। ফলে এই সুযোগটি নিয়েছে প্রতারকরা। তারা মনে করছেন, এই কাজে বাংলাদেশস্থ মালয়েশিয়ান দূতাবাসের বাংলাদেশি কর্মীরাও জড়িত। যাদের মাধ্যমে এটি করা হয়েছে। এজন্য তারা পুলিশ বিভাগ থেকে শুরু করে গোয়েন্দাদের বিষয়টি নজরে নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
কুষ্টিয়ার পলাশ জানান, তার পাসপোর্টের ভিসার মেয়াদ রয়েছে মাত্র ১ মাস ১৭ দিন। তবে তিনিও জানেন না এটা ভ্রমণ ভিসা। ফলে এখনও আশায় আছেন তিনি হয়তো মালয়েশিয়া যেতে পারবেন।
টিকিট নিয়ে আসছি বলে নিখোঁজ সেই এজেন্সি
গত শুক্রবার শাহজালাল বিমানবন্দরে হাজার হাজার মানুষের ভিড় জমেছিল। সবারই মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা ছিল। পরে তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা সেদিন আর যেতে পারেননি। কারণ সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলো তাদের ভিসা ও পাসপোর্ট দিলেও টিকিট দেয়নি। তারা তাদের আশ্বাস দিয়েছিল বিমানবন্দরে অপেক্ষায় থাকেন, টিকিট নিয়ে ফ্লাইট ছাড়ার আগে চলে আসবেন। কিন্তু আসেনি সেই এজেন্সির মালিক ও কর্মীরা। ফলে পরদিন খালি হাতে গ্রামে ফিরে যান হাজার হাজার মানুষ।
কুষ্টিয়ার সেই পলাশসহ চারজনকে মালয়েশিয়া নিতে চেয়েছিল গালফ ওভারসিস নামে একটি এজেন্সি। সেই এজেন্সির দেওয়া নম্বরে কল করা হলে কাউকে পাওয়া যায়নি।
এখনো আশা দিচ্ছে এজেন্সি ও দালালরা!
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ থেকে কর্মী পাঠানোর সর্বশেষ সময় ছিল ৩১ মে। কিন্তু এরপরও মালয়েশিয়া যেতে না পারা ব্যক্তিদের নানাভাবে আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন দালাল ও এজেন্সির মালিকরা। তারা কাউকে বলছে, চলতি সপ্তাহে হবে। আবার কাউকে বলছে, সামনে আবারও শ্রমবাজার খুলবে। তারা এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে মালয়েশিয়ান সরকারের সাথে ডিল করছেন। কেউ কেউ আবার টাকা ফেরত নিলে হয়তো ওই ব্যক্তির আর যাওয়া নাও হতে পারে— এমন মিথ্যা আশ্বাসও দিচ্ছেন।
কি বলছে বায়রা
এ বিষয়ে শনিবার রাতে কথা হয় বায়রা মহাসচিব আলী হায়দারের সাথে। সাথে আলাপে তিনি বলেন, এসব বাজে ঘটনাগুলো আমাদের কারও কাম্য নয়। এটা কারও কাছে গ্রহণযোগ্যও নয়। আমাদের যেসব ভাইয়েরা যেতে পারেনি বা কারও মাধ্যমে যদি তারা প্রতারিত হয়ে থাকে আর তারা যদি আমাদের কাছে অভিযোগ করে তবে আমরা অবশ্যই সেই এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করব। আমরা সেই সব এজেন্সির তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছি। এছাড়াও এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সাথেও আমার কথা হয়েছে। যদি কোন কর্মীর পাসপোর্টে ভিসা লেগে থাকে আর যদি তিনি যেতে পারেননি বলে অভিযোগ করেন সেই এজেন্সির বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তার আগে তিনি গণমাধ্যমে দাবি করেছিলেন, মালয়েশিয়ায় টিকেট না থাকায় এমন ৪ থেকে ৫ হাজার ব্যক্তি যেতে পারেনি। যদিও সেই সংখ্যা কয়েক গুন বলে জানা গেছে।
তবে বায়রার সূত্র বলছে, মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর জন্য এবার ১০১ একটি এজেন্সি অনুমোদন পেয়েছিল। তার মধ্যে একটি বোয়েসল সরকারী। বাকী সব বেসরকারী। এসব এজেন্সির অনেকেই এসব কর্মীর সাথে প্রতারণা করেছেন। তবে তাদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করছে বায়রা।
মন্ত্রী ও সচিব কি বলছেন
সর্বশেষ আজ রোববার প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শকিফুর রহমান চৌধুরী দাবি করেছেন, ৩১ হাজার নয়, ১৭ হাজারের বেশি কর্মী টিকিট না পেয়ে যেতে পারেনি।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, যারা যেতে পারেননি সেই কারণ খতিয়ে দেখতে মন্ত্রণালয় ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তদন্ত কমিটি সাত দিনের মধ্যে রিপোর্ট এবং সুপারিশ দেবে। আমি বিশ্বাস করি যারা এর জন্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব রুহুল আমিন জানান, ২৪ মে-র পর থেকে যাদের টিকিট ছিল শুধুমাত্র তাদের ক্ষেত্রে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে কাউকে অনুমোদন দেওয়া হয়নি।
তবে শুক্রবার রাতে কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শামীম হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, যারা ভিসা পেয়ে মালয়েশিয়ায় আসতে পারেননি তাদের নিয়ে আসার ব্যাপারে হাইকমিশনের পক্ষ থেকে চেষ্টা অব্যাহত থাকবে, যেন তাদের দ্রুত নিয়ে আসা যায়। -নিউজ ডেস্ক