(দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) সম্প্রতি ভারত সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশটির সঙ্গে যে ১০টি সমঝোতা স্মারক সই করেছেন তাকে গোলামির নবতর সংস্করণ বলে আখ্যা দিয়েছে বিএনপি। দলটির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে একথা বলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
রোববার (৩০ জুন) বিকেলে গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সুনির্দিষ্ট সব বিষয় নিয়ে আলাদা আলাদা বক্তব্য তুলে ধরেন বিএনপি মহাসচিব। এ সময় দলের সিনিয়র নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘বস্তুত এসব সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে নিরাপত্তা কৌশলগত 'বাফার স্টেট' হিসেবে ভারতকে ব্যবহারের সুযোগ করে দিতে চান। এর ফলে বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবে আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার জটিলতার মধ্যে জড়িয়ে পড়বে।’
ফখরুল বলেন, ‘যে সাতটি সমঝোতা স্মারক নতুন করে সই করা হয়েছে, সেগুলোর প্রায় সবগুলোই বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকেন্দ্রিক। প্রয়োজনের সময় বাংলাদেশ ভূখণ্ডকে ভারতের সামরিক ও বেসামরিক পণ্য পরিবহনের জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘চিকেন নেক’কে বাইপাস করে ব্যবহার করার সুদূরপ্রসারী মহাপরিকল্পনা থেকেই এসব সমঝোতা চুক্তি করা হয়েছে বলে আমরা মনে করি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বকে জলাঞ্জলি দিয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদে ভারতের গোলামি চুক্তির গভীর ফাঁদে ফেলার সেই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন। জাতীয় স্বার্থবিরোধী এহেন চুক্তি জনগণ মেনে নেবে না।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘শাসক গোষ্ঠী দাবি করে গত দেড় দশকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ‘অনন্য উচ্চতায়’ পৌঁছেছে। কিন্তু সম্পর্কের তথাকথিত 'সোনালি অধ্যায়'-এর সময়কালে বাংলাদেশের জনগণের তরফে প্রাপ্তি শূন্যের কোঠায়। এ সময়ে দুই দেশের মধ্যকার লেনদেনের প্রধান অংশজুড়ে রয়েছে কানেক্টিভিটির নামে একের পর এক ভারতকে ট্রানজিট ও করিডোর সুবিধা প্রদান। ট্রানজিট—করিডোর দেওয়ার রাজনৈতিক—অর্থনৈতিক ও কৌশলগত ঝুঁকি সত্ত্বেও সবকিছুই একতরফাভাবে করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বার্থকে কোনো গুরুত্বই দেওয়া হয়নি।’
ভারতীয়রা বাংলাদেশ থেকে ডলার নিয়ে যাচ্ছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘তীব্র বেকারত্বের বাংলাদেশে কাজ করছে লাখ লাখ ভারতীয় যুবক। ভারতের রেমিট্যান্স আহরণের প্রধান উৎসের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৪ নম্বরে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী সংসদে জানিয়েছেন, গত ১০ মাসে ভারতীয়রা নিয়ে গেছে ৫০.৬০ মিলিয়ন ডলার। আমরা জানি, এর বাইরেও অবৈধ পন্থায় নিয়ে যাচ্ছে লাখ লাখ ডলার।’
ফখরুল বলেন, ‘বর্তমান অবৈধ সরকার যেহেতু বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণকে প্রতিনিধিত্ব করে না এবং তাদের জনগণের কাছে কোনো জবাবদিহিতা নেই, তাই দেশের স্বার্থরক্ষার জন্যও তারা সচেষ্ট নয়। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে রেল করিডোর দেওয়ার চুক্তি, তিস্তা প্রকল্পে ভারতের সহযোগিতা গ্রহণ, প্রতিরক্ষা ও সামরিক সহযোগিতা, ঔষধ সংক্রান্ত সমঝোতা, বাংলাদেশের জলসীমায় ভারতের অবাধ বিচরণ, ভারতের ইনস্পেস এবং বাংলাদেশের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের যৌথ স্যাটেলাইট সমঝোতা, ডিজিটাল পার্টনারশিপ, গ্রিন পার্টনারশিপ, সমুদ্র সহযোগিতা ও সুনীল অর্থনীতি ইত্যাদি নানা নাম দিয়ে যে দশটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হলো, তাতে বাংলাদেশের প্রাপ্তিশূন্য। বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণের চাইতে ভারতের কাছে শেখ হাসিনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দায়বদ্ধতা থেকে এসব সমঝোতা সই হয়েছে, তা জনগণের কাছে স্পষ্ট। এসব চুক্তির সাথে বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণের ন্যূনতম সংশ্লিষ্টতা নেই।’
ফখরুল বলেন, ‘ভারত সফরপরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেছেন, 'ভারত যদি আমাদের তিস্তা প্রজেক্টটা করে দেয়, তাহলে আমাদের সব সমস্যাই তো সমাধান হয়ে গেল'। শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে সাধারণ কূটনৈতিক দরকষাকষির ন্যূনতম ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।’
ভারতীয় রেল ট্রানজিট নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করে ফখরুল বলেন, ‘শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতীয় রেল ট্রানজিটের ফলে বাংলাদেশের জনগণ উপকৃত হবে। অথচ বিশেষজ্ঞরা রেল করিডোরের ফলে বাংলাদেশের লাভ নিয়ে দারুণ সংশয় প্রকাশ করেছেন। জানা গেছে, এ ট্রেন বাংলাদেশের কোনো মানুষ ব্যবহার করতে পারবে না। একতরফাভাবে ভারতকে করিডোর সুবিধা দেওয়ার জন্য এ চুক্তি করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশের কোনো লাভ হবে না। তাহলে শেখ হাসিনা কিভাবে দাবি করেন এ রেল ট্রানজিট বাংলাদেশের মানুষের উপকারে আসবে?’
‘অপরদিকে এ রেল ট্রানজিটের কোনো সমীক্ষা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি। নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞদের কারগরি ও অর্থনৈতিক মূল্যায়ন এবং সামরিক বিশেষজ্ঞদের ইতিবাচক বিশ্লেষণ ছাড়া এ ধরনের রেল—করিডোর প্রদান আত্মঘাতী ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী হবে মর্মে মন্তব্য করেন তারা। সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা রেল—করিডোরকে ইউরোপের সাথে তুলনা করে বলেছেন, তারা পারলে আমরা পারবো না কেন। কথা হলো ইউরোপের ক্ষেত্রে বিষয়টি বহুদেশীয়, আমাদের ক্ষেত্রে যা কেবলই দ্বিপাক্ষিক। তাছাড়া ইউরোপের সকল দেশে সুশাসন ও ন্যায়নীতি বিরাজমান, যা আমাদের দেশে অনুপস্থিত। ইউরোপের সীমান্তগুলোতে আমাদের মতো কাঁটাতারের বেড়া নেই, ঝুলন্ত ফেলানিও নেই। অতএব আমাদের বিষয়টি ইউরোপের সাথে তুলনীয় নয়।’
এ সফরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে দশটি চুক্তি-সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে, বরাবরের মতো এবারও এসবের বিশদ বিবরণ প্রকাশিত হয়নি বলেও দাবি করেন ফখরুল। পাশাপাশি সমঝোতা স্মারক নিয়ে ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়, দেশি ও আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম এবং বিশেষজ্ঞ মতামতের কথা তুলে ধরে এসব নিয়ে শঙ্কার কথা জানান বিএনপি মহাসচিব।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘আমাদের জন্য সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, তিস্তা চুক্তি প্রসঙ্গ। আগেই বলেছি, এবারের সফরে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ বৃদ্ধি এজেন্ডাতেই ছিল না, অথচ এটাই হওয়া উচিত ছিল সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। দীর্ঘ দিন ধরে আমরা লক্ষ করছিলাম, এই অনির্বাচিত সরকার তিস্তা প্রকল্প নিয়ে ভারত ও চীন উভয়ের সাথেই লুকোচুরি খেলছিল। সাম্প্রতিককালের ডামি নির্বাচনে সমর্থন আদায়ের দূরভিসন্ধি থেকে সরকার তিস্তা প্রকল্পকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছে। এ প্রকল্পে চীনের আগ্রহের কথা আমরা জানি। অপরদিকে ভারত নির্বাচনের পরপরই তার পররাষ্ট্র সচিবকে পাঠিয়ে জানিয়ে দেয়, ভারত তিস্তা প্রকল্পে অংশগ্রহণ করতে চায়। প্রায় দেড় দশক ধরে নানা অহেতুক অজুহাতে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর হচ্ছে না, অপরদিকে উত্তরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার উপক্রম। ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরকালে তিস্তা চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। এরপর গত ১৪ বছরে তিস্তা শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হলেও এই সংকটের সমাধান হয়নি। আশ্চর্যের বিষয়, এখনও এটি রয়ে গেছে রুদ্ধকক্ষের দ্বিপাক্ষিক একান্ত আলোচনার স্তরে।’
ফখরুল বলেন, ‘প্রশ্ন হলো তিস্তা প্রকল্প বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ প্রকল্প নিয়ে ভারত কিংবা অন্য কোনো দেশের সাথে আলোচনা করার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে বলেই মনে হয় না।’
সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বার্থ সুনিশ্চিত না করে ভারতকে রেল করিডোর সুবিধা প্রদান বস্তুত ইতোপূর্বে রেল, স্থল, নৌ করিডোর ও সামুদ্রিক বন্দর ব্যবহারের চেয়ে আরও বিপজ্জনক আত্মসমর্পণ। এতে বাংলাদেশের কতটুকু লাভ হবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের নিজস্ব স্বার্থ সুরক্ষার ওপর সর্বোচ্চ জোর দিতে হবে। ভারতকে রেল ট্রানজিট সুবিধা দিতে হলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে হবে। বস্তুত দেশের জনগণের অর্থেই রেলের উন্নয়ন হয়েছে। জনগণের করের অর্থ দিয়ে রেলে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় ইউএন—এসকাপ (এশিয়া ও প্যাসিফিকের জন্য জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন) থেকে ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্টের একটা প্রাক্কলন করে রাখা আছে। অর্থাৎ ট্রানজিটের বিনিময়ে বাংলাদেশ কী পাবে, তা প্রাক্কলন করে দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের এ মানদণ্ড মেনেই চুক্তিতে যাওয়া উচিত। এই রেল—করিডোর বাংলাদেশের বাণিজ্য বৃদ্ধিতে কোনো সহায়তা করবে না। ভারত—বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক রেল যোগাযোগের বদলে নেপাল—ভুটান—বাংলাদেশ—ভারত চতুর্দেশীয় কানেক্টিভিটি সৃষ্টি করা গেলে তা বাংলাদেশের trade creation এ অবদান রাখতে পারে।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘বিদ্যমান অবকাঠামোর উন্নতি না করে ভারতের ট্রেন চলাচল শুরু হলে তা বাংলাদেশের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি ট্রেন চলাচল রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় বাড়তি চাপ তৈরির আশঙ্কা করছেন যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞরা। আবার সর্বত্র বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে ভারতকে ট্রেন চলাচলের সুযোগ করে দিলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়তে পারে। এতে নাগরিক হিসেবে সকলের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। করিডোরের আড়ালে সিলগালা করা ভারতীয় রেল-বগিতে সশস্ত্র সামরিক লোক ও অস্ত্র সরঞ্জাম ঢুকলে অনেকেই এসব ভারতীয় রেল-বগিগুলোকে গ্রিক মহাকাব্যের ট্রোজান হর্সের সাথে তুলনা করেন, যে কাঠের হর্সের পেটে গ্রিক সৈন্যরা লুকিয়ে ছিল, আর নিশিরাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ট্রয় নগরীকে ধ্বংস করেছিল।’
ফখরুল বলেন, ‘শেখ হাসিনার সর্বশেষ দিল্লি সফরটি কার্যতই একপাক্ষিক। এ সফরে স্বাক্ষরিত সমঝোতা কিংবা চুক্তি বাংলাদেশের ন্যূনতম স্বার্থ সুনিশ্চিত করে না। তাছাড়া আলোচনায় এমন কিছু বিষয় এসেছে যাতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সামরিক সহযোগিতার নামে জাতীয় নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ইতোপূর্বে আদানির সাথে বিদ্যুৎ আমদানির অন্যায্য চুক্তি, জ্বালানি ও বিদ্যুতের মতো অধিকতর কৌশলগত পণ্যের জন্য ভারতের ওপর নির্ভরশীল করে তোলার চলমান উদ্যোগ, দেশবাসী এবং আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ মহল গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছে।’
বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের বর্তমান অবৈধ সরকার অনেক আগেই স্বাধীনভাবে পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে কার্যত অক্ষম হয়ে পড়েছে। তারা রাষ্ট্রের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে কেবল ক্ষমতার দখলদারিত্ব অব্যাহত রাখতে দেশি—বিদেশি সহযোগী গোষ্ঠী কিংবা প্রভুদের নিরন্তর আস্থা অর্জনে সচেষ্ট।’ -অনলাইন ডেস্ক