(দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) সরকারি চাকরিতে ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা’ সংস্কার নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে উত্তপ্ত হয় ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ (ঢাবি) দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। শিক্ষার্থীরা আবাসিক হলগুলো থেকে মিছিল নিয়ে রাজপথে নেমে আসেন। এ সময় তাদের মুখে শোনা যায়, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার-রাজাকার’, ‘কে বলেছে কে বলেছে, সরকার-সরকার’, ‘রাজাকার আসছে, রাজপথ কাঁপছে’, ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’-সহ বিভিন্ন স্লোগান।
সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? তাদের নাতিপুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে? এটা আমার দেশবাসীর কাছে প্রশ্ন। তাদের অপরাধটা কী? নিজের জীবন বাজি রেখে, নিজের পরিবার সব ফেলে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, দিন-রাত খেয়ে না খেয়ে, কাদামাটি পেরিয়ে, ঝড়বৃষ্টি সব মোকাবিলা করে যুদ্ধ করে বিজয় এনে দিয়েছে। বিজয় এনে দিয়েছে বলেই তো আজ সবাই উচ্চপদে আসীন। আজ গলা বাড়িয়ে কথা বলতে পারছে। তা না হলে পাকিস্তানিদের বুটের লাথি খেয়ে থাকতে হতো।’
যেভাবে উত্তাপ ছড়াল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন হল থেকে বের হয়ে আসেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার-রাজাকার’, ‘এই বাংলার মাটি, রাজাকারের ঘাঁটি’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন।
এক সময় খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, ঢাবির মাস্টারদা সূর্যসেন, বিজয় একাত্তর ও মুহসিন হলের শিক্ষার্থীদের গেটে তালা দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। পরে তাদের ছাড়িয়ে নিতে অন্যান্য হলের শিক্ষার্থীরা বিজয় একাত্তর হলের সামনে জড়ো হন। রাত ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে বেগম রোকেয়া হলের শিক্ষার্থীরা গেটের তালা ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসেন।
পরে সম্মিলিত মিছিল নিয়ে হাজী মুহম্মদ মুহসিন হল, সূর্যসেন হল, বিজয় একাত্তর হল, জিয়াউর রহমান হল, বঙ্গবন্ধু হল, জসিম উদ্দীন হল, শহীদুল্লাহ হল, জগন্নাথ হল, এফএইচ হল, একুশে হল এবং রোকেয়া হলের শিক্ষার্থীরা জড়ো হন টিএসসিতে।
এ সময় তাদের ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, রাষ্ট্র কারও বাপের না’, ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘আমার স্বাধীন বাংলায়, একের কথা চলে না’, ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি-বাঙালি’, ‘লাখো শহীদের রক্তে কেনা, দেশটা কারও বাপের না’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে দেখা যায়।
বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বলেন, শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলার জেরে রোববার রাত ১১টার দিকে বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়েছে। তারা বলেন, আজ সংবাদ সম্মেলনে কোটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্য আমাদের রক্তে আগুন ধরিয়েছে। যখন কারও রক্তে দাগ লাগানো হয়, তখন কেউ ঘরে বসে থাকতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী যদি তার বক্তব্য প্রত্যাহার না করেন, তাহলে আমরা আরও বৃহত্তর আন্দোলনে নামতে বাধ্য হব।
রাত দেড়টার দিকে অবস্থান কর্মসূচি শেষে তারা নিজ নিজ হলে ফিরে যান।
তাঁতীবাজার অবরোধ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের
একই বক্তব্যের প্রতিবাদে রাত ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে-মেয়েরা হল থেকে বেরিয়ে তাঁতীবাজার মোড় অবরোধ করেন।
এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার-রাজাকার’, ‘কে বলেছে কে বলেছে, সরকার-সরকার’ স্লোগান দিতে থাকেন।
সোহান নামে চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী বলেন, সরকার কতটা বোধহীন হয়ে পড়লে সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটি যৌক্তিক আন্দোলন না মেনে উল্টো রাজাকার তকমা দেয়। আমরা জাতি হিসেবে লজ্জিত।
উত্তাল কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রধানমন্ত্রীর একই বক্তব্যের প্রতিবাদে রাত ১১টার পর থেকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল থেকে স্লোগান দিতে শুরু করেন ছাত্ররা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হল, কাজী নজরুল ইসলাম হল এবং নারী ছাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত শেখ হাসিনা হল থেকে ভেসে আসে স্লোগানের শব্দ।
‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার-রাজাকার’, ‘কীসের তোমার অধিকার, তুমি একটা রাজাকার’ ইত্যাদি স্লোগানে মুখরিত ছিল ক্যাম্পাসের হলগুলো। রাত ১২টার দিকে ক্যাম্পাসের মূল গেটে মিছিল করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
নৃবিজ্ঞান বিভাগের সাইফুল বলেন, ‘সরকার এখন পর্যন্ত মোটেই যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেয়নি। একটি বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি লাখ লাখ শিক্ষার্থীদের ঢালাওভাবে রাজাকারের নাতি-নাতনি বলে সম্বোধন করেছেন। একটা ঘৃণিত শব্দ এখন অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরাধিকারীদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। অনতিবিলম্বে কোটার যৌক্তিক সংস্কার দাবি করছি।’
ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ রাবি শিক্ষার্থীদের
সরকারি চাকরিতে ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা’ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) মিছিল বের করেন আন্দোলনরত কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীরা। রাত ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুজ্জোহা চত্বরে একত্রিত হয়ে মিছিল নিয়ে বিভিন্ন হল প্রদক্ষিণ করেন শিক্ষার্থীরা। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনের ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করেন তারা।
মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব ম্যুরালের সমাবেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের
রোববার (১৫ জুলাই) রাতে জিয়া মোড় থেকে বিক্ষোভ মিছিল করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব ম্যুরালের সামনে এসে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ মিলিত হয়। এরপর শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে পুনরায় জিয়া মোড়ে এসে বিক্ষোভের মাধ্যমে কর্মসূচি শেষ করেন।
হল থেকে সড়কে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা
রাত সাড়ে ১১টা থেকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো থেকে স্লোগান দিতে শুরু করেন ছাত্ররা। বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, শহীদ মুখতার ইলাহি হল থেকে ভেসে আসে স্লোগানের শব্দ। এ সময় মিছিল বের করে মিছিলটি রংপুরের মর্ডান মোড়, দর্শনা, লালবাগ হয়ে আবারও পার্ক মোড় হয়ে আবারও মর্ডান মোড়ে গিয়ে অবস্থান করেন শিক্ষার্থীরা।
এ সময় মিছিল থেকে বিভিন্ন স্লোগান দিতে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের। এর মধ্যে ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’, ‘কীসের তোমার অধিকার, তুমি একটা রাজাকার’ ইত্যাদি স্লোগানে মুখরিত ছিল।
শাবিপ্রবিতে মুখোমুখি অবস্থানে ছাত্রলীগ ও আন্দোলনকারীরা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য ঘিরে শিক্ষার্থীদের ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ স্লোগানে মাঝরাতে উত্তাল হয়ে উঠেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) ক্যাম্পাস। বিপরীতে ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি’ পাল্টা স্লোগান দিয়ে মিছিল বের করেন শাবিপ্রবি শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
রোববার (১৫ জুলাই) দিবাগত রাত সাড়ে ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও অ্যাকাডেমিক ভবন ডি’এর সামনে মুখোমুখি অবস্থান নেয় দুই পক্ষ। এ সময় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্য করে ‘ভুয়া, ভুয়া’ স্লোগান দিতে দেখা যায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের। প্রসঙ্গত, চীন সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিরা চাকরি পাবে না কি রাজাকের নাতি-নাতনিরা চাকরি পাবে? তারই প্রতিবাদে রাতেই রাজপথে নেমে আসেন শিক্ষার্থীরা। -সূত্র : ঢাকা পোষ্ট