(দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে টানা চার মেয়াদ ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের পতন ঘটেছে গত ৫ আগস্ট। এরপর আওয়ামী লীগের পাশাপাশি সহযোগী হিসেবে ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোও বেকায়দায় পড়ে। শুরুতে আওয়ামী লীগকে ‘ক্ষমতার স্বাদ পাইয়ে দেওয়া’ জাতীয় পার্টির প্রতি কারও তেমন নজর যায়নি। এমনকি ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ বাদে অন্যান্য দলের সঙ্গে সেনাবাহিনী প্রধানের সংলাপে ডাক পায় গত তিন সংসদে বিরোধী দলের আসনে থাকা জাতীয় পার্টি। এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. ইউনূসের সঙ্গে দুই দফার সংলাপেও ডাক পায় দলটি। ধারণা করা হচ্ছিল, আওয়ামী লীগের অপশাসনের দায়ভার তাদের নিতে হবে না।
তবে কিছু দিন গড়াতেই ‘স্বৈরাচারের দোসর’ হিসেবে জাতীয় পার্টির নাম সামনে আসতে থাকে নানা মহল থেকে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যেমন আওয়ামী লীগের সহযোগী হিসেবে জাতীয় পার্টির বিচার দাবি করেছে, তেমনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও অভিন্ন দাবি জানিয়েছেন। এমনকি জাতীয় পার্টি কীভাবে সংলাপে ডাক পায় সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কোনো কোনো সমন্বয়ক। এরপর থেকে কোণঠাসা হয়ে পড়ে জাতীয় পার্টি।
সম্প্রতি রাষ্ট্র সংস্কারের আগে প্রধান উপদেষ্টা পুনরায় যে সংলাপ শুরু করেছেন, সেটা পূজার পরে আরও কয়েকটি দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে শেষ হবে। তবে এবারের সংলাপে জাতীয় পার্টি আর ডাক পাচ্ছে না বলে জানা গেছে। এছাড়া দলটির নেতারা হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন মামলার আসামিও হচ্ছেন। ‘স্বৈরাচারের দোসর’ হিসেবে জাতীয় পার্টির নাম জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে। তাদের বিচার দাবি করা হচ্ছে। এতে বেশ বিপাকে পড়েছে দলটি। আওয়ামী লীগের পাশাপাশি তারাও রোষানলে পড়তে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা।
এই পরিস্থিতিতে সম্প্রতি করণীয় ঠিক করতে বৈঠক করেছে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি। সেখানে দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া জাপার কয়েকজন শীর্ষ নেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে গণহত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে রাজধানীসহ সারা দেশে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে দলটি। পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে যে বিভেদ আছে তা কাটিয়ে ঐক্য প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছেন নেতারা। দলের এক অংশের নেতৃত্ব দেওয়া রওশন এরশাদ জানিয়েছেন, তিনি মৃত্যুর আগে দলকে ঐক্যবদ্ধ দেখে যেতে চান।
জাতীয় পার্টি দাবি করছে, ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলনে তারা শুরু থেকেই সমর্থন দিয়ে আসছে। এমনকি আন্দোলনে তাদের নেতাকর্মীরা অংশও নিয়েছেন। কিন্তু একটি চক্র জাতীয় পার্টিকে ছাত্র আন্দোলনের বিপক্ষের দল হিসেবে চিহ্নিত করতে অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
তবে বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা ৫ আগস্টের পর থেকে জাতীয় পার্টির বিচার দাবি করে আসছেন। তাদের দাবি, গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ধরে রাখার পেছনে প্রধান সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছে জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টি তাদের সহযোগিতা না করলে এত দিন স্বৈরশাসন টিকে থাকত না। এজন্য এখন আওয়ামী লীগের পাশাপাশি তাদের দোসর হিসেবে জাতীয় পার্টিরও বিচার হওয়া উচিত।
তবে জাতীয় পার্টি কোণঠাসা হয়ে পড়ার পেছনে সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আলোচিত দুজন সমন্বয়কের বক্তব্য জোরালো ভূমিকা রাখে। ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম সম্প্রতি নিজ নিজ ফেসবুক পেজে জাতীয় পার্টি নিয়ে পোস্ট দেন। তাদের অভিযোগ, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সহযোগী ছিল জাপা।
হাসনাত আব্দুল্লাহ ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘স্বৈরাচারের দোসর জাতীয় পার্টিকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানানো হলে আমরা সেই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ ও কঠোর বিরোধিতা করব।’
আরেক সমন্বয়ক মো. সারজিস আলম লিখেন, ‘জাতীয় পার্টির মতো মেরুদণ্ডহীন ফ্যাসিস্টের দালালদেরকে প্রধান উপদেষ্টা কিভাবে আলোচনায় ডাকে?’ সূত্র জানিয়েছে, দুই সমন্বয়কের এই অবস্থানের পরই প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় জাতীয় পার্টিকে চলমান সংলাপে না ডাকার সিদ্ধান্ত নেয়। সংস্কার, নির্বাচন ও চলমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তৃতীয় দফায় সংলাপ করছেন। গত ৫ অক্টোবর প্রথম দিনের সংলাপে অংশ নেয় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণঅধিকার পরিষদসহ পাঁচটি দল এবং গণতন্ত্র মঞ্চসহ তিনটি জোট। দুর্গাপূজার পর ১৯ অক্টোবর বাকি দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ হবে। সেদিনের সংলাপের জন্য অন্য দলগুলো ডাক পেলেও জাতীয় পার্টি ডাক পাচ্ছে না বলে জানা গেছে। সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ এক পোস্টে নিজেই তথ্য জানিয়েছেন।
সংলাপে ডাক না পাওয়া নিয়ে এত দিন জাতীয় পার্টির ভেতরে ভেতরে গুঞ্জন থাকলেও এবার এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে মুখ খুলেছেন দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। শনিবার (১২ অক্টোবর) রংপুরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, আমাদের দলের একটা ঐতিহ্য আছে। পুরানো দল। দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে। আমাদের রাষ্ট্র চালানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে। সেই জায়গা থেকে এই অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে চেয়েছি। সহযোগিতা করে আসছিলাম। কিন্তু তারপরও আমাদের যদি রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়ের আলোচনায় না ডাকা হয়, দূরে রাখা হয়, সে বিষয়ে আপত্তি নেই। তবে আমাদের নিয়ে বাইরে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। কতগুলো অভিযোগ করা হচ্ছে এবং শাস্তিস্বরূপ আমাদের ডাকা হচ্ছে না। এটি আমাদের বিব্রত করছে।
তারা আওয়ামী লীগের দোসর নন দাবি করে জি এম কাদের বলেন, আমরা আওয়ামী লীগের সময় নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। এজন্য আমাদের আওয়ামী লীগের দোসর বলা হচ্ছে। কিন্তু আপনারা জানেন, আওয়ামী লীগের সর্বশেষ নির্বাচনে আমরা অংশ নিতে চাইনি। কিন্তু আমার অফিস এবং আমাকে এক প্রকার জোর করে নির্বাচন করতে বাধ্য করেছে। এমন করেই আমার ভাইয়ের সময়ও হয়েছে। ২০১৪ সালে আমার ভাই বলেছিল বিএনপি নির্বাচনে গেলে আমরা নির্বাচনে যাব। কিন্তু বিএনপি যখন গেল না, তখন আমরা নির্বাচন করতে চাইনি। আমার ভাইকে সিএমএইচে রেখে তার এবং ভাবিসহ কয়েকজনের মনোনয়ন বৈধ করে নির্বাচন করল। সেই সরকারে আমাকে মন্ত্রিত্ব দিতে চেয়েছিল আমি নিইনি। সব মিলিয়ে আমাদের জাতীয় পার্টির একটা অংশ নির্বাচন করেছে। এই নির্বাচন নিয়ে রংপুরেও আন্দোলন হয়েছে।
জাপা চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের ওপর হাামলা-মামল হয়েছে। আমাদের অনেক জায়গায় অফিস ভাঙচুর করা হয়েছে। সরকার এটা করেনি। তবে আমাদের যে নিরাপত্তা দেওয়ার কথা ছিল তা হয়তো সরকার দিতে পারেনি। তবু আমি সরকারকে দোষারোপ করব না। সরকার যখন দায়িত্ব নিয়েছে, তখন সরকারব্যবস্থা বলতে কিছুই ছিল না। একেবারে ভঙ্গুর অর্থনীতিকে সঙ্গে নিয়ে জনগণের পাহাড়সম প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ নিয়ে সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। দুই মাসের মধ্যে সব করতে পারবে এমনটা না। তবে আমি আশাবাদী, ওনারা পারবে। তাই সরকারকে সময় দেওয়া দরকার। জাতীয় পার্টি সরকারের পাশে থেকে সহযোগিতা করবে, এটি আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি। ক্ষমতা হারানোর পর ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩৫টি আসন নিয়ে জাতীয় পার্টি তৃতীয় শক্তি হিসেবে দেশের রাজনীতিতে অবস্থান নেয়। ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৩২টি আসন লাভ করে। ওই নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে আওয়ামী লীগ। সরকার গঠনে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয় জাতীয় পার্টি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে যোগ দেয়। এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ৪৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। জাতীয় সংসদে তারা ২৭টি আসন পান এবং মোট ভোটের ৭.০৪ শতাংশ ভোট লাভ করেন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষকতায় পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে মাত্র ৩৪টি আসন নিয়ে বিরোধী দল হয়ে যায় জাতীয় পার্টি। একাদশ নির্বাচনে ২৫টি আসনে জয়লাভ করলেও সংসদে আওয়ামী লীগের ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ হিসেবে অভিহিত হয় দলটি। সর্বশেষ ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ২৬টি আসনে সমঝোতা করলেও জয় পায় মাত্র ১১টিতে। দলের এই করুণ অবস্থার মধ্যেই ৫ আগস্ট রাজনীতিতে পালাবদল ঘটে। -নিউজ ডেস্ক