(দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আগ্রাসী পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকেই এখনো বহাল তবিয়তে আছেন। এখনো তারা দাপটের সঙ্গেই রয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকে ছাত্র-জনতা হত্যা মামলার আসামিও রয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, নানা লেজ ধরে এরা পার পেয়ে যাচ্ছেন। স্বৈরাচারের দোসর হলেও নিজেকে এখন নানাভাবে আওয়ামী বিরোধী হিসেবে পরিচিত করতে চাচ্ছেন।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (অতিরিক্ত কমিশনার পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত) হেডকোর্য়াটার ইলতুৎমিশ। সাতক্ষীরায় বিএনপি নেতাকে গুলি করে হত্যা মামলার আসামি তিনি। স্বৈরাচার হাসিনা সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকতেন মারমুখী। বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানিসহ নানা কাণ্ডেও বিতর্কিত। গত জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ছিলেন আগ্রাসী ভূমিকায়। ছিলেন সাবেক পুলিশ কমিশনার মোল্লা নজরুলের ক্যাশিয়ার। আওয়ামী পরিবারের লোক পরিচয়ে গত ৪ বছর বুক ফুলিয়ে বহু অপকর্মের হোতা ওই পুলিশ কর্মকর্তা এখনো বহাল রয়েছেন জিএমপিতে। এ নিয়ে ক্ষোভ বিরাজ করছে বিভিন্ন মহলে। বিসিএস ২৫ ব্যাচের কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইলতুৎমিশ ২০২০ সালের জুন মাসে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশে (জিএমপি) যোগ দেন উপ-কমিশনার (ডিসি) পদে। পরে তাকে জিএমপির লোভনীয় টঙ্গী (দক্ষিণ) বিভাগের উপ-কমিশনার নিয়োগ দেয়া হয়। জমি দখলে মদদ, মাদক ব্যবসায়ীদের লালনসহ আইনশৃঙ্খলার অবনতির কারণে ২০২১ সালের জুলাই মাসে তাকে ডিসি হেডকোয়ার্টার পদে ফিরিয়ে আনা হয়। গত তিন বছর ধরে তিনি ওই দায়িত্বে রয়েছেন।
জানা গেছে, জিএমপিতে যোগদানের আগে মোহাম্মদ ইলতুৎমিশ ছিলেন সাতক্ষীরার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার। পুলিশ সুপার ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মো: মোস্তাফিজুর রহমান। ২০১৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা সদর উপজেলার কুচপুকুর গ্রামের বিএনপি নেতা হুমায়ুন কবিরকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে গত ২৫ আগস্ট ইলতুৎমিশ, পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান ও সদর থানার সাবেক ওসি মহিদুল ইসলামসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করে নিহতের ভাই মো: আজগর আলী। সাতক্ষীরা আমলী আদালত-১ এর বিচারক মামলাটি এজাহার হিসেবে গণ্য করার জন্য সাতক্ষীরা সদর থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়েছেন।
ইলতুৎমিশ গাজীপুরে যোগদান করে টঙ্গীর উপ-কমিশনার হলে কিছু দিন পর সাতক্ষীরা সদর থানার ওসি মহিদুল ইসলামকে বদলি করে টঙ্গীর পুবাইল থানায় নিয়ে আসেন ইলতুৎমিশ। যোগ দিয়েই ওসি মহিদুল ও ডিসি ইলতুৎমিশ মিলে জমি দখল-বাণিজ্য। মহিদুল দায়িত্বে থাকার সময় পুবাইল একের পর এক ডাকাতি শুরু হয়। হয়ে এলাকা পরিণত হয় মাদক সাম্রাজ্যে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুবাইলের এক ব্যবসায়ী বলেন, খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা আবদুল মজিদের খিলগাঁও মৌজায় ৭-৮ বিঘা জমি ছিল। তিনি পর্যায়ক্রমে প্রায় সব জমি বিক্রি করে দখল বুঝিয়ে দেন। পরে ইলতুৎমিশের সাথে মিলে বিক্রি করা জমি উদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু করেন। ইলতুৎমিশ ওসি মহিদুলকে নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে আবদুল মজিদের জমি ছেড়ে দিতে হুমকি দেন। নইলে মামলা দিয়ে গ্রেফতারের হুমকি দেন। স্বৈরাচার হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে দোসর হিসেবে ইলতুৎমিশ আলেম-উলামেদের চরিত্র হননে নামেন। গাজীপুর মহানগরীর গাছা এলাকায় একটি ওয়াজ মাহফিলে দেয়া বক্তব্যের কারণে রফিকুল ইসলাম মাদানীর বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ৮ এপ্রিল জিএমপির গাছা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি এবং ১১ এপ্রিল বাসন থানায় আরো একটি মামলা দায়ের হয়। এসব মামলায় গ্রেফতার হলে সাথে থাকা ৪টি মোবাইল ফোন জব্দ করে পুলিশ। ১২ এপ্রিল ডিসি ইলতুৎমিশ গাছা থানায় প্রেস বিফ্রিংয়ে জানান, মাদানীর মোবাইল ফোনে অশ্লীল ভিডিও এবং কুরুচিপূর্ণ পর্নোগ্রাফিতে ঠাসা। তিনি মিয়মিত এসব ভিডিও দেখতেন। মামলায়গ্রর্ণগ্রাফি ধারাযুক্ত করেন ডিসি ইলতুৎমিশ এবং জিজ্ঞাসাবাদের নামে ৭ দিনের রিমান্ডে নিয়ে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
গাজীপুরের একজন পরিবহন মালিক নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ইলতুৎমিশ ছিলেন জিএমপির সাবেক কমিশনার বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তা শেখ হাসিনার আজ্ঞাবহ মোল্লা নজরুলের চাঁদার ক্যাশিয়ার। গাজীপুরের তাকওয়া পরিবহন বাস কোম্পানির কাছে মোল্লা নজরুলের হয়ে ৮০ লাখ টাকার বেশি চাঁদা দাবি করেন তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার দেলোয়ার হোসেন ও ইলতুৎমিশ। পরে কোম্পানির পক্ষ থেকে ইলতুৎমিশের কাছে ৫ লাখ টাকা দেয়া হয়। একদিন পর ইলতুৎমিশ টাকা ফিরত দিয়ে পুরো ৮০ লাখ টাকাই দিতে হবে বলে জানান। ওই টাকা না দেয়ায় ২৫টি বাস ৭ মাস আটকে রাখে পুলিশ। চাঁদাবাজির মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হয় বহু শ্রমিককে। একের পর এক কমিশনার বদলি হলেও এখনো বহাল রয়েছেন ইলতুৎমিশ।
ইলতুৎমিশ টঙ্গীর ডিসি থাকার সময় টঙ্গী পূর্ব থানার সেকেন্ড অফিসার আশিক রোনাল্ডসহ তিন এসআই দত্তপাড়া এলাকার একটি বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ ফেনসিডিল উদ্ধার করেন। এ ঘটনায় কোনো আইনগত ব্যবস্থা না নিয়ে উদ্ধার করা ফেনসিডিল গোপন বিক্রি করে দেন। এমনকি বাড়ির মালিকের কাছ থেকে আদায় করেন বড় অঙ্কের টাকা। গণমাধ্যমে এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলে তিন এসআইকে থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয়। গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। কমিটিকে প্রভাবিত করে ঘটনাটি ধামাচাপ দেয়ার অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে গত ২১ জুলাই গাছা থানার বোর্ডবাজারে গুলি-টিয়ার সেলে মারা যায় ৯ জন। ওই সময় বোর্ডবাজার ও গাজীপুরা এলাকায় ইলতুৎমিশ নেতৃত্ব দেন বলে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী অভিযোগ করেন। -সূত্র : নয়া দিগন্ত