(দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) বিচারকাজ থেকে বিরত রাখা হাইকোর্টের ১২ বিচারপতির ভাগ্য নির্ধারণ করবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর ওপর রিভিউ আবেদন নাকচ হওয়ায় ওই বিচারকদের বিষয়ে অভিযোগের তদন্ত হবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে।
‘দলবাজ’ ও ‘দুর্নীতিবাজ’ বিচারপতিদের পদত্যাগ অথবা তাদের অপসারণের দাবিতে হাইকোর্ট ঘেরাও এবং বিক্ষোভের ঘটনার পর হাইকোর্ট বিভাগের ১২ জন বিচারপতিকে আপাতত বেঞ্চ না দেওয়া, অর্থাৎ বিচারকাজ থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। এর আগে গত সরকারের আমলে আরও তিন বিচারপতির বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়েছিল। আর তাই এই ১৫ বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে।
গত ১৬ অক্টোবর বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা ‘ফ্যাসিস্ট সরকারে সহযোগী ও দলবাজ বিচারপতিদের’ পদত্যাগের দাবিতে সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাও করলে ওই ১২ জন বিচাপতিকে চায়ের দাওয়াত দিয়ে তাদের বিচারিক বেঞ্চ কেড়ে নেন।
একই সঙ্গে আপিল বিভাগে বিচারপতিতের অভিসংশনের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিরুদ্ধে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের রিভিউ পিটিশনের শুনানির দিন ধার্য করা হয় রোববার। ২০১৪ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার বিচারপতিদের অভিসংশনের ক্ষমতা সংসদকে দিয়েছিল। কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালত তা বাতিল করে দিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল রেখেছিল। আওয়ামী লীগ সরকার আপিল বিভাগে আবার সেই রায়ের ব্যাপারে রিভিউ করে।
রোববারের শুনানি শেষে আপিল বিভাগ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণ করা যাবে বলে সিদ্ধান্ত দেন। সংবিধানের এ সংক্রান্ত ৯৬ অনুচ্ছেদ পুরোটাই পুনর্বহাল করেছে আপিল বিভাগ।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ রোববার এই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
এই রায়ের ফলে কোনো বিচারপতির বিরদ্ধে অসমর্থতা ও পেশাগত অসদাচরণের কোনো অভিযোগ উঠলে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া যাবে।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও রিট আবেদনকারীদের পক্ষে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ শুনানিতে অংশ নেন। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল আদালতের অনুমতি নিয়ে শুনানিতে অংশ নেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আপিল বিভাগের আদেশের ফলে দেশে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল হলো। বিচারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওই কাউন্সিলেই নিস্পত্তি হবে।
আর বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নেয়া ১২ জন বিচারপতির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাদের বিরুদ্ধে যদি পেশাগত অসদাচারণ বা আর্থিক বা মানসিক অসততার কোনো অভিযোগ থাকে তাহলে তা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে অভিযোগ আকারে দিতে হবে। কাউন্সিল তদন্ত করে দেখবে যে, তারা দোষী না নির্দোষ। এরপর কাউন্সিল আবার তাদের ফাইন্ডিংস রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন, সুপারিশ করবেন। রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা নেবেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো রাষ্ট্রপতির। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব হলো মেকানিক্যাল। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের দায়িত্ব হলো যেসব বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা দোষী না নির্দোষ তা নির্ধারণ করা। অভিযোগ প্রমাণ হলে শাস্তির সুপারিশ করা।
আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের দুইজন সিনিয়র বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত হয়। তবে অভিযোগ করতে হয় রাষ্ট্রপতির কাছে। রাষ্ট্রপতি অভিযোগ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে পাঠান।
তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ হয়তো সব সময় রাষ্ট্রপতির কাছে অভিযোগ করতে পারেন না। আবার অনেক অভিযোগ আছে যা সাধারণ মানুষের জানা নেই। সেই কারণে কাউন্সিল স্বপ্রণোদিত হয়েও তদন্ত শুরু করে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করতে পারেন।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের তৎপরতা
২০০৩ সালের অক্টোবর মাসে হাইকোর্ট বিভাগের সেই সময়ের বিচারপতি সৈয়দ শাহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে অসৎ উপায়ে অর্থ গ্রহণের অভিযোগ ওঠে। সৈয়দ শাহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির তৎকালীন সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ অসদাচরণের অভিযোগ প্রকাশ্যে আনেন। রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে বিষয়টি তদন্ত করতে নির্দেশ দেন। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি কেএম হাসানের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বিষয়টি তদন্ত করে। তদন্ত শেষে কাউন্সিল অভিযোগের সত্যতা পায় এবং রাষ্ট্রপতির নিকট তার পদচ্যুতির সুপারিশ করে। পরে রাষ্ট্রপতি তাকে পদচ্যুত করেন।
আরও দুটি ঘটনায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পদক্ষেপ গ্রহণের আগেই সংশ্লিষ্ট দুইজন বিচারপতি পদত্যাগ করেন। আকেটি ঘটনা হলো হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি লতিফুর রহমান ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল এরশাদের ফোনালাপ একটি পত্রিকায় ফাঁস হওয়া। ঘটনাটি ক্যাসেট কেলেঙ্কারি নামে অধিক পরিচিত। পরে বিচারপতিকে দীর্ঘদিন বেঞ্চ থেকে সরিয়ে রাখা হয় এবং তিনি পদত্যাগ করেন।
এদিকে ২০১৯ সালের আগস্ট মাস থেকে হাইকোর্ট বিভাগের তিনজন বিচারপতিকে বিচারকাজ থেকে দূরে রাখা হয়েছে। সেসময় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরামর্শ করে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আর বুধবার আরো ১২ জন বিচারপতিকে বিচার কাজ থেকে দূরে রেখেছেন প্রধান বিচারপতি।
২০১৪ সালের অক্টোবরে ষোড়শ সংশোধনী, হাইকোর্টে তা বাতিল, সুপ্রিম কোর্টে হাইকোর্টের আদেশ বহাল ও উচ্চ আদালতে রিভিউ থাকায় শেষোক্ত ১৫ জনের ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যায়নি। এখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বহাল হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের নিস্পত্তি হবে বলে জানান আইনজীবীরা।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কার্যকর থাকলে এতদিনে আরও ১৫ জন বিচারপতির ব্যাপারে তদন্ত হতে পারত। তিনজন বিচারপতিকে তো চার বছর ধরে বসিয়ে রেখে বেতন ভাতা দেয়া হচ্ছে। সব পেশায়ই পেশাগত অসদাচারণ এবং অনৈতিক কাজের অভিযোগে ব্যবস্থা নেয়ার বিধান আছে। বিচারপতিরাও তার বাইরে নয়।
তবে অ্যাডভোকেট মনজিল মেরসেদ বলেন, আসলে ষোড়শ সংশোধনী হাইকোর্ট বাতিল এবং আপিল বিভাগ তা বহাল রাখায় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আগে থেকেই বহাল ছিল। কারণ রিভিউয়ের ফলে আপিল বিভাগ তো হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করেনি। তারপর নানা জটিলতায় কাউন্সিলকে কার্যকর করা হয়নি৷ এখন তো কাউন্সিল বহাল হয়ে গেল।
তবে নিম্ন আদালতের বিচারকদের ব্যাপারে সুপ্রিম জুডিশয়াল কাউন্সিল নয়, সুপ্রিম কোর্ট ব্যবস্থা নেয়। এজন্য প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি জেনালের অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন কমিটি আছে। আইন মন্ত্রণালয় বা জেলা আদালতের মাধ্যমে অভিযোগ আসে। কিন্তু অনেক সময় ওই অভিযোগ আটকে রাখা হয়। সুপ্রিম কোর্টে পাঠানো হয় না।
মনজিল মোরসেদ বলেন, এই কারণেই আমরা স্বাধীন বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় করার কথা বলেছি। যা সুপ্রিম কোর্টের অধীনে থাকবে। আর কোনো দাবি বা আন্দোলনের মুখে বিচারক বা বিচারপতিদের অভিসংশন বা অপসারণ করা যাবে না। অভিযোগ থাকতেই পারে। অভিযোগের ভিত্তিতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল তদন্ত করে দেখবে। তাদের তদন্তের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত হবে। আন্দোলন বা দাবির মুখে বিচারপতিদের অপসারণ করলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকবে না। সূত্র: ডয়চে ভেলে