(দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) সম্প্রতি নতুন মোড় নিয়েছে বিশ্ব রাজনীতি। ক্ষমতার পালাবদলে পরিবর্তন এসেছে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, পরিবর্তিত হচ্ছে কূটনৈতিক সম্পর্কও। আর এসবের বেড়াজালে পড়ে অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত। একদিকে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের ক্ষমতা বদল, অন্যদিকে কোনো প্রতিবেশীর সঙ্গেই নেই তেমন সুসম্পর্ক। প্রতিবেশী পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে পুরনো সেই বৈরিতা তো আছেই।
এদিকে ভারতকে ‘অসহযোগী’ দেশ হিসেবে ঘোষণা করেছে মার্কিনীরা। একইসঙ্গে ট্রাম্পের কঠোর অভিবাসন নীতি; আবার মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতায় ভারতের উদ্বেগ বেড়েছে। আর এর মধ্যে ভারতের ‘সবচেয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত দেশ’ মর্যাদা প্রত্যাহার করেছে সুইজারল্যান্ড। মধ্যপ্রাচ্যের চলমান অস্থিরতায় অনেকটা বিপাকে পড়েছে ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইরান। এতেও উদ্বেগে ভারতীয় কূটনীতিকরা। সব মিলিয়েই বিশ্ব রাজনীতিতে ভারতের অবস্থান এখন টালমাটাল বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ভারতকে ‘অসহযোগী’ দেশ ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের
‘অসহযোগী’ দেশের তালিকায় ভারতকে অন্তর্ভুক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ও শুল্ক প্রয়োগ সংস্থা (আইসিই)। এ তালিকায় ভারত ছাড়া রয়েছে ভুটান, কিউবা, ইরান, পাকিস্তান, রাশিয়া এবং ভেনেজুয়েলা।
আইসিই জানিয়েছে, এই দেশগুলো সাক্ষাৎকার গ্রহণ, সময়মতো ভ্রমণ নথি ইস্যু এবং নির্ধারিত ফ্লাইটে তাদের নাগরিকদের ফেরত নিতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে।
সংস্থাটির তালিকা অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৪ লাখ ৫০ হাজার অবৈধ অভিবাসীকে বিতাড়িত করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৮ হাজার অভিবাসীই ভারতীয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রায় ৯০ হাজার ভারতীয়কে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টাকালে আটক করা হয়েছে। এদের অধিকাংশই পাঞ্জাব, গুজরাট এবং অন্ধ্র প্রদেশের বাসিন্দা বলে জানিয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া।
যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আগামী এক মাসের মধ্যে দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণায় অভিবাসন নীতি কঠোর করার অঙ্গীকার করেছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বৃহত্তম প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া পরিচালনার পরিকল্পনা করেছেন। ফলে চূড়ান্ত আদেশপ্রাপ্ত হাজার হাজার ভারতীয় অভিবাসীকে ফেরত পাঠানো হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ ভারত-মার্কিন কূটনৈতিক সম্পর্কেও চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
ভারতকে দেওয়া মর্যাদা প্রত্যাহার করল সুইজারল্যান্ড
দ্বৈত কর পরিহার চুক্তির (ডিটিএএ) আওতায় ভারতের ‘সবচেয়ে অনুকূল’ বা ‘সবচেয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের’ (এমএফএন) মর্যাদা প্রত্যাহার করেছে সুইজারল্যান্ড।
দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, ভারতের সুপ্রিম কোর্টে নেসলে মামলার রায়ের প্রেক্ষাপটে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
০২৩ সালের অক্টোবরে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একটি মামলায় রায় দেন, কোনো দেশ ওইসিডিতে (অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা) যোগ দিলে এমএফএন ধারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হয় না। বরং পূর্ববর্তী কর চুক্তি প্রাধান্য পায় এবং এটি কার্যকর করতে ‘প্রজ্ঞাপন’ প্রয়োজন।
ভারত লিথুয়ানিয়া এবং কলম্বিয়ার সঙ্গে এমন একটি কর চুক্তি করেছিল, যেখানে নির্দিষ্ট ধরনের আয়ের ওপর করহার ছিল ওইসিডিভুক্ত দেশগুলোর তুলনায় কম। পরে এই দেশগুলো ওইসিডিতে যোগ দেয়।
তখন সুইজারল্যান্ড দাবি করেছিল, ভারতের সঙ্গে তাদের চুক্তিতে এমএফএন ধারা অনুযায়ী করের হার ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ হতে হবে। কিন্তু ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, কোনো দেশ ওইসিডি-তে যোগ দিলেই এমএফএন ধারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হয় না। বরং পূর্ববর্তী কর চুক্তি অগ্রাধিকার পায়, যদি না এমএফএন ধারা ‘আয়কর আইনের ধারা ৯০’ অনুযায়ী প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা থাকে।
নেসলে মামলায় ২০২১ সালে দিল্লি হাইকোর্ট এমএফএন ধারা কার্যকর করার পক্ষেই রায় দিয়েছিল। তবে, ২০২৩ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের রায় উল্টে দিয়ে জানায়, প্রজ্ঞাপন ছাড়া এমএফএন ধারা কার্যকর হতে পারে না।
সুইজারল্যান্ডের মতে, এই রায় তাদের প্রত্যাশার বিরুদ্ধে গেছে এবং এতে নেসলেসহ অন্যান্য কর সংক্রান্ত বিষয়ে তাদের অবস্থান দুর্বল হয়েছে।
গত ১১ ডিসেম্বর সুইস অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ভারতীয় করদাতাদের জন্য সুইজারল্যান্ডে ডিভিডেন্ডের ওপর করহার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পদক্ষেপ ভারতীয় কোম্পানি এবং সুইস বিনিয়োগের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। এটি বিশেষত সুইজারল্যান্ডে ভারতীয় কোম্পানিগুলোর সাবসিডিয়ারির জন্য করের বোঝা বাড়াবে।
মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতায় ভারতের উদ্বেগ বাড়ছে!
সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের পতন ইরানের জন্য সবচেয়ে বড় ধাক্কা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। বাশার আল-আসাদের পরিবার ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে ইরানের প্রধান আঞ্চলিক মিত্র। শুধু তাই নয়, ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ইরান এবং ইরাকের মধ্যে যুদ্ধে সিরিয়াই একমাত্র আরব দেশ ছিল যারা ইরানকে সমর্থন করেছিল। বাকি আরব দেশগুলো কিন্তু ইরাকের সঙ্গে ছিল।
এরপর ২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলে বাশার আল-আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বাড়তে থাকে, কিন্তু ইরান তার সঙ্গ ছাড়েনি। এদিকে, ইরান কিন্তু সিরিয়া হয়ে লেবাননে হিজবুল্লাহ এবং গাজায় হামাসকে সহায়তা পাঠাত।
আফতাব কমল পাশা জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ওয়েস্ট এশিয়া স্টাডিজের অধ্যাপক। অধ্যাপক পাশা মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ইরানের সমস্যা হয়তো বেড়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেক কিছুই সে দেশের অনুকূলে যাবে।
অধ্যাপক পাশা বলছেন, ‘প্রথমত, ইরান দুর্বল হয়নি। ইরান হিজবুল্লাহকে ৩০০০ কোটি ডলার দিয়েছে। সিরিয়াকেও তারা ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। এখন এই সমস্ত অর্থ নিজেকে শক্তিশালী করার জন্য ব্যয় করবে ইরান। এতে তাদের পরমাণু কর্মসূচি ত্বরান্বিত হবে।’
এর পাশাপাশি, অন্য একটা বিষয়ও উল্লেখ করেছেন অধ্যাপক পাশা। তার কথায়, ‘এরদোয়ান হয়তো এখনো মনে করতে পারেন যে, তিনি জয়ী হয়েছেন, কিন্তু তার পুরো মনোযোগ ২০২৮ সালের নির্বাচনের দিকে। সিরিয়ায় কিন্তু এই অস্থির অবস্থা বজায় থাকবে। আমি মনে করি, সিরিয়াকে অনেক ভাগে ভাগ হতে পারে। কিছু এলাকা ইসরায়েলের দখলে চলে যাবে।’
‘ইসরায়েল ইতিমধ্যেই সেই কাজ শুরুও করে দিয়েছে। কিছু অংশ তুরস্কের দখলে চলে যাবে। সুন্নি ও আলবীয় একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে দেবে। কুর্দিরাও তাদের ভাগ দাবি করবে। এই অবস্থায় ইরানের পক্ষে সিরিয়ায় প্রবেশ করা কিন্তু কঠিন কাজ হবে না।’
পশ্চিম এশিয়ায় ইরান দুর্বল হলে ভারতের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন অধ্যাপক পাশা।
বাংলাদেশে ক্ষমতা বদলে এশিয়ায় খর্ব হয়েছে ভারতের আধিপত্য!
গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশে গণআন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। আর এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের পতন ঘটে। এটি ভারতের জন্য এক বড় ধরনের ধাক্কা। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ওপর দীর্ঘকাল ধরে যে রাজনৈতিক প্রভাব এবং আধিপত্য ভারত গড়ে তুলেছিল, তা বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ভেঙে পড়েছে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে ভারত সরকারের মধ্যে এক ধরনের হতাশা দেখা যাচ্ছে। তাই গত ৫ আগস্ট থেকেই বাংলাদেশ নিয়ে একের পর এক মিথ্যাচার করে যাচ্ছে ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো। একইসঙ্গে দেশটির রাজনীতিবিদরাও বর্তমান বাংলাদেশ নিয়ে বিষেদগার করছে। সেখানে বাংলাদেশ হাই কমিশনের ওপর হামলার মতো ঘটনাও ঘটেছে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো যেমন— শ্রীলঙ্কা, নেপাল এবং মালদ্বীপেও ভারতের প্রভাব কমে আসছে।
এদিকে, শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ায় দুই দেশের সম্পর্কেও প্রভাব পড়েছে। ভারতের কাছে হাসিনাকে ফেরত দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। আর এ নিয়ে প্রায়ই কথা বলছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। বৈশ্বিক রাজনীতি এবং কূটনীতিতে ভারত এখন অনেকটাই বিপর্যস্ত। ক্ষমতার পরিবর্তনের ফলে ভারতের এখন নিজেদের স্বার্থ রক্ষা অনেকটাই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ভবিষ্যতে এই চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে বলেই -নিউজ ডেস্ক