(দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) পর্যটকদের ওপর জঙ্গি হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে রীতিমত সংঘাতে জড়িয়েছে ভারত-পাকিস্তান। দুই দেশ একে অন্যের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাসহ নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। এরমধ্যে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ভারতের বিরুদ্ধে দেওয়া আটটি পদক্ষেপের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আকাশসীমা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি। কারণ ভারত থেকে অনেক রুটে পাকিস্তানের আকাশ ব্যবহার করে গন্তব্যে যেতে হয়। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হঠাৎ এমন নিষেধাজ্ঞার কারণে ভারতকে বেশি সমস্যার মুখে পড়তে হবে। তাদের খুঁজতে হবে বিকল্প রুট। এতে করে সময় বেশি লাগায় জ্বালানি খরচ বাড়বে। অন্যদিকে বাড়াতে হতে পারে ভাড়া। ফলে যাত্রীদের ওপর ভাড়ার চাপ বাড়বে।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, সড়ক পথের মতো আকাশপথেও বিকল্প রুটে চলাচল করার ব্যবস্থা আছে। সেই নির্দেশিকাও সংশ্লিষ্টদের জানা আছে। সেক্ষেত্রে নতুন কোনো দেশের ওপর দিয়ে রুট ব্যবহার করে চলতে চাইলে ভারতকে বিমানের রেজিস্ট্রেশন ব্যবহার করে ওই দেশের অনুমতি নিতে হবে। তাই পাকিস্তান আকাশসীমা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিলেও ভারতের বিমান পরিচালনার ক্ষেত্রে সমস্যা হবে না। তবে খরচ বাড়বে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ বিমানের সাবেক পরিচালক কাজী ওয়াহিদ উল আলম বলেন, পাকিস্তান-ভারতের এমন সিদ্ধান্তে বাংলাদেশে কোনো প্রভাব পড়বে না। সেটা প্রত্যাশাও করি না। কিন্তু পাকিস্তানের এমন সিদ্ধান্তে বেশি সমস্যায় পড়বে ভারত।
আরেক এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ বিমানের সাবেক পরিচালক নাফিজ ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, পাকিস্তান ভারতের বিমান চলাচলে আকাশসীমা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দিলেও অনেক এয়ারওয়ে বা ফ্লাইট পাথ আছে সেগুলো ব্যবহার করতে পারবে। সেক্ষেত্রে দেশটির বিমান পরিচালনায় সমস্যা হবে না।
যে পরিস্থিতিতে এলো আকাশসীমা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা
চলতি সপ্তাহে জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে পর্যটকদের ওপর জঙ্গি হামলা হয়েছে। এমন নারকীয় হত্যাযজ্ঞ নিয়ে বিশ্বজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। অবশ্য এরজন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে ভারত শক্ত হাতে দমনের কথা বলছে। এরই অংশ হিসেবে ভিসা বন্ধসহ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একাধিক পদক্ষেপ ঘোষণা করে ভারত। পাকিস্তানও পাল্টা সিদ্ধান্ত নিয়ে ভারতীয় বিমানসংস্থাগুলির জন্য আকাশসীমা বন্ধ করে দেওয়াসহ একাধিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে ভারতের মালিকানাধীন বা ভারত নিয়ন্ত্রিত কোনও বিমান পাকিস্তানের ওপর দিয়ে যেতে পারবে না।
অবশ্য দুই দেশের মধ্যে এমন সিদ্ধান্ত এটাই প্রথম নয়। এর আগেও এই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে ইসলামাবাদ। ২০১৯ সালে বালাকোটে ভারতের বিমান হামলার পর পাকিস্তান কয়েক মাসের জন্য আকাশসীমা বন্ধ রেখেছিল। পরে আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছিল। পহেলগাঁও হতাহতের পর আবারও এমন পদক্ষেপ নেওয়া হলো পাকিস্তানের তরফ থেকে।
যে প্রভাব পড়তে পারে ভারতের বিমানখাতের ওপর
প্রাপ্ততথ্য অনুযায়ী, দিল্লিসহ উত্তর ভারতের যেকোনো শহর থেকে পশ্চিমের কোনও দেশে যেতে পাকিস্তানের আকাশ ব্যবহার করা হয়। ওই পথে আন্তর্জাতিক বিমান চালায় এয়ার ইন্ডিয়া, ইন্ডিগো, এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস এবং স্পাইসজেটের মতো প্রতিষ্ঠান। পাকিস্তান বৃহস্পতিবার আকাশসীমা বন্ধ করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করতেই এই সংস্থাগুলি ভবিষ্যতের সমস্যার কথা জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাকিস্তানের আকাশপথ ব্যবহার করতে না পারলে উত্তর আমেরিকা, ব্রিটেন-সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং পশ্চিম এশিয়ার দিকে বিমান চালাতে সমস্যা হবে। বিকল্প পথে যাত্রার সময়ও হবে দীর্ঘ।
অন্যদিকে পাকিস্তানের ওপর দিয়ে না গেলে উত্তর ভারত থেকে পশ্চিমের দিকে বিমানগুলিকে যেতে হবে আরব সাগরের ওপর দিয়ে। এটিই প্রধান বিকল্প পথ। তবে এর বাইরেও বিকল্প রুটে চলতে পারবে ভারতীয় বিমান।
আমেরিকা এবং ইউরোপের বিমানগুলো বিকল্প পথ ধরলে গন্তব্যে পৌঁছাতে স্বাভাবিকের চেয়ে অন্তত দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা বেশি সময় লাগবে।
তবে আরব সাগর দিয়ে ঘুরে যেতে হলে বাড়তি জ্বালানি খরচ হবে বিমানগুলোর। এর ফলে যাত্রার খরচও আগের চেয়ে বেড়ে যাবে। মনে করা হচ্ছে, পাকিস্তানের সিদ্ধান্তের ফলে ভারতে বিমান ভাড়া ৮ থেকে ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে চলেছে। এই পরিস্থিতি যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে আগামী দিনে ভাড়া আরও বাড়তে পারে।
অন্যদিকে বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে হলে বিমানগুলোতে বেশি জ্বালানি রাখতে হবে। তার ফলে সার্বিকভাবে বিমানের ভারসাম্য বজায় রাখতে হয় যাত্রীসংখ্যা, নয়তো জিনিসপত্রের ওজন কমাতে হবে। যাত্রীসংখ্যা কমিয়ে দিতে হলে বিমানসংস্থাগুলোর আয় কমবে। ফলে সেগুলো অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
পাকিস্তানের এমন সিদ্ধান্তের ফলে ভারতের বিমান চলাচলে কোন ধরনের সমস্যা হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ বিমানের সাবেক পরিচালক কাজী ওয়াহিদ উল আলম বলেন, প্রথমত পাশ্ববর্তী দুই দেশের এই সিদ্ধান্তে আমাদের ওপর কোনো প্রভাব আসবে বলে মনে করি না। এই পরিস্থিতিতে ক্ষতির প্রভাব ভারত-পাকিস্তানের ওপর পড়বে। এক্ষেত্রে বেশিরভাগই ভারতের ওপর পড়বে। কারণ তাদের অনেক বিমান পাকিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহার করে চলে। ভারতের অনেক বিমান বাংলাদেশের আকাশও ব্যবহার করে।
তিনি আরও বলেন, বিকল্প রুটে চলতে গিয়ে ভারতের বিমানের সময় বেশি লাগবে; জ্বালানি খরচ বাড়বে। হঠাৎ করে ভাড়া বাড়াতে না পারলেও বিমানের ঠিকই খরচ বাড়বে। যাত্রীদের সময়ও নষ্ট হবে। তবে পাশ্চাত্যের দিক খোলা থাকায় পাকিস্তানের সমস্যা কম হবে। কিন্তু পূর্বের দিকে যেতে হলে তাদেরও বিকল্প রুট ব্যবহার করতে হবে।
তবে আরেক এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ বিমানের সাবেক পরিচালক নাফিজ ইমতিয়াজ উদ্দিন মনে করেন বিমান চলাচলের জন্য যেহেতু একাধিক ‘ফ্লাইট পাথ’ খোলা থাকে তাই চাইলেই বিকল্প রুট ব্যবহারের সুযোগ পাবে ভারত। এক্ষেত্রে কোথাও কোথাও হয়তো স্বাভাবিকের চেয়ে ২০ মিনিট বা কিছুটা বেশি সময় বাড়তি লাগতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অথোরিটির কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নির্ধারিত ফি দিয়ে বিমান পরিচালনা করা হয়। এক্ষেত্রে পাকিস্তান তাদের আকাশ বন্ধ করলেও ভারতের বিমান অনেক ‘ফ্লাইট পাথ’ দিয়ে নির্বিঘ্নে চলতে পারবে। তখন যে দেশের ওপর দিয়ে যাবে সে দেশের অনুমতি নিয়ে ফ্লাইট চালাতে হবে। এয়ারক্রাফটের রেজিস্ট্রেশন ধরে তারা অনুমতি দেবে।
যদি সময় বেশি লাগে সেক্ষেত্রে জ্বালানি খরচ বাড়তি লাগলে তা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে বহন করতে হবে বলেও জানান এই বিশেষজ্ঞ।
নাফিজ ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, খরচ বাড়লে ভাড়া বাড়তে পারে। তবে এটা নির্ভর করবে চাহিদার ওপর। কারণ যাত্রীর চাপ থাকলে তখন ভাড়া বাড়লেও সেটা পরিশোধ করে গন্তব্যে যাবেন। কিন্তু বিকল্প ‘ফ্লাইট পাথ’ যদি ঝুঁকিপূর্ণ হয়; তখন বিমানের ইন্সুরেন্সের খরচ বেশি হয়। তবে স্বাভাবিক থাকলে তখন ইন্সুরেন্সের খরচে প্রভাব পড়ে না।