(দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) পটুয়াখালীর একটি ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক জাহিদুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। এমপিওভুক্ত হওয়ার পর থেকে মাসের প্রথম সপ্তাহে বেতন ভাতা পেয়ে আসছেন। ফলে আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটছিলো তার। কিন্তু গত জানুয়ারি থেকে বেতনভাতা প্রাপ্তি সহজিকরণের লক্ষ্যে শুরু হওয়া ইলেক্ট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (ইএফটি) পদ্ধতি জাহিদুলদের মতো লাখ লাখ স্কুল-কলেজের শিক্ষককে বেকায়দায় ফেলেছে। দ্রুত সময়ে ও ঝামেলামুক্তির বদলে এখন বেতন পাওয়া নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছেন লাখ লাখ শিক্ষক। কেউ তিন থেকে চার মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না। কারও আবার প্রথম দুই মাস বন্ধ থাকার পর চালু হয়েছে বেতন। এতে সামাজিক-পারিবারিকভাবে নাজেহাল হতে হচ্ছে বিপুল সংখ্যক শিক্ষককে।
ভুক্তভোগী শিক্ষকরা বলছেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদফতরের অদক্ষতা ও সংশ্লিষ্ট দফতরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের উদাসীনতার কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে মে মাসের অর্ধেক শেষ হয়ে গেলেও এখনো এপ্রিল মাসের বেতন পাননি চার লাখের বেশি শিক্ষক ও কর্মচারী। জানুয়ারি থেকে বেতন না পাওয়া শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার বলে জানা গেছে।
এদিকে এখনো বেতন না পাওয়া শিক্ষকরা কবে নাগাদ এপ্রিলের টাকা পাবেন, পরবর্তীতে মে মাসের বেতন-উৎসব ভাতা আদৌ ঈদের আগে পাবেন কি না তার নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না কেউ। ফলে কোরবানি নিয়ে অজানা শঙ্কা শুরু হয়েছে শিক্ষকদের মাঝে।
শিক্ষক নেতারা অভিযোগ করছেন, অর্থ বরাদ্দ থাকার পরও মাউশির মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টরা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে শিক্ষকদের বিপদের মধ্যে ফেলেছেন। একজন কর্মকর্তার অসুস্থতার দোহাই দিয়ে লাখ লাখ শিক্ষকদের বেতন ভাতা দেওয়া হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, এ নিয়ে স্পষ্ট কোনো বক্তব্যও মাউশির পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে না। তাই শনিবার থেকে জাতীয়করণের দাবিতে শুরু হওয়া অবস্থান কর্মসূচি থেকে প্রয়োজনে মাউশি ঘেরাও করতে যাবেন শিক্ষকরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাউশির একজন উপপরিচালক বলেন, ‘এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের এমন পরিস্থিতি সত্যিই মেনে নেওয়ার মতো না। কিন্তু সবার জন্য ইএফটি চালু করতে গিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছে। আরও কয়েকমাস ইএফটি জটিলতায় ভুগতে হতে পারে।’
শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নিয়ে জটিলতার বিষয় নিয়ে কথা বলতে মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আজাদ খানের মোবাইল নাম্বারে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি'র (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক শেখ কাওছার আহমেদর বলেন, ‘ডিজিটালের চেয়ে তো এনালগেই ভালো ছিলেন শিক্ষকরা। ইএফটিতে সামান্য ত্রুটি ধরে সেগুলো ঠিক করতে মাসের পর মাস লাগাচ্ছে। অন্যদিকে শিক্ষকরা না খেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এ নিয়ে মাউশির ডিজিসহ কারও কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। এখনো ১০ হাজারের মতো শিক্ষক জানুয়ারি থেকে বেতন পাচ্ছে না। কীভাবে তাদের জীবন চলছে কেউ ভাবছে না।’
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর ঘেরাওয়ের কর্মসূচি আসছে
চলতি মাসে এপ্রিলের বেতন পাওয়া নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শনিবার জাতীয়করণের দাবিতে প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি থেকে প্রয়োজনে হাজার হাজার শিক্ষক মাউশি ঘেরাও করতে যাবে।’
কবে থেকে শুরু হলো ইএফটির যন্ত্রণা?
গত ১ জানুয়ারি এক লাখ ৮৯ হাজার এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারী ইএফটির মাধ্যমে সরকারি অংশের বেতন-ভাতা পেয়েছেন। দ্বিতীয় ধাপে ৬৭ হাজার, তৃতীয় ধাপে ৮৪ হাজার, চতুর্থ ধাপে আট হাজার দুই শতাধিক ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসের বেতন পেয়েছেন। এ ছাড়া বহু শিক্ষক এখনো ইএফটিতে যুক্ত হতে পারেননি। এরমধ্যে ঈদ চলে আসায় শিক্ষকদের মধ্যে বেতন-ভাতা নিয়ে অনিশ্চয়তা শুরু হয়। অনেকে পরিবার পরিজনকে ঈদের পোশাকও কিনে দিতে পারেননি। পরবর্তীতে মার্চ মাসের বেতন ঈদের আগে শুক্রবারও ব্যাংক খোলা রাখতে হয়। তবুও সবাই বেতন-বোনাস তুলতে পারেননি। এতদিনেও ইএফটির জটিলতা নিরসন করতে না পারায় আবার তাদের এপ্রিলের বেতন আটকে গেছে।
সূত্র জানায়, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ইএফটির মাধ্যমে বেতন-ভাতা পান। তবে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার প্রস্তাব মাউশি অধিদপ্তর থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়, চিফ অ্যাকাউন্টস অফিস হয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে যায়। সরকারি কোষাগার থেকে ছাড় হলেও তা রাষ্ট্রায়ত্ত আটটি ব্যাংকের মাধ্যমে ‘অ্যানালগ’ পদ্ধতিতে ছাড় হতো। এই অর্থ তুলতে শিক্ষকদের ভোগান্তিতে পড়তে হতো। ফলে ইএফটিতে বেতন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু ইএফটিতে বেতন দিতে গিয়ে এখন মহাসংকটে পড়েছে মাউশি অধিদপ্তর জনবল সংকটে।
যেসব ভুলে বিড়ম্বনায় লাখ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী
ইএফটি জটিলতায় বেতন না পাওয়া শিক্ষক-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রথম দফায় ইএফটিতে শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে যাদের এনআইডি, এমপিও শিট, ব্যাংকের তথ্যের মিল ছিল তারা বেতন পেয়েছেন।
আবার অনেকের এনআইডি, এমপিও শিট, ব্যাংকের তথ্যের সামান্য ভুল, ডট, কমা, স্পেস, আক্ষরিক ভুলের কারণে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ধাপের শুধু ডিসেম্বর মাসের বেতন পেয়েছেন।
অনেকের জন্ম তারিখ, জন্ম সাল, নামের বানান ইত্যাদি শিক্ষা সনদের সঙ্গে অমিল আছে। তারা এগুলো সংশোধনের জন্য জমা দিয়েছেন। আবার কেউ সংশোধন করে মাউশিতে আবেদন করেছেন। নির্ধারিত সময়ে তথ্য জমা দিলেও এখনো স্কুল-কলেজ মিলে প্রায় ১০ হাজারের মতো শিক্ষক বেতন পাচ্ছেন না।
শিক্ষকরা বলছেন, গত মার্চে প্রায় সাড়ে তিন লাখ শিক্ষক ইএফটিতে বেতন ভাতা-পেয়েছেন। সেখান থেকে যারা অবসরে গেছেন বা মারা গেলে সফটওয়্যারে অটোমেটিক তাদের বেতন স্থগিত হয়ে যাওয়ার কথা। সেক্ষেত্রে বাকিদের তথ্য ঠিক করতে না পারলেও ওই সাড়ে তিন লাখের এপ্রিলের বেতন যথাসময়ে পাওয়ার কথা। সেটাও পারেননি মাউশির কর্মকর্তারা।
এপ্রিলের বেতন পেতে মে মাসও শেষ হতে পারে
মাউশির কর্মকর্তারা বলছেন, সাধারণত ইএমআইএস সেলের কাজ শেষ হওয়ার পরও বেতন পেতে কমপক্ষে চার-পাঁচ দিন সময় লাগে। যেহেতু দ্বিতীয় সপ্তাহেও কাজ করা শেষ হয়নি সেক্ষেত্রে এপ্রিলের বেতন মে মাসের শেষ সপ্তাহেও চলে যেতে পারে।
অন্যদিকে মে মাসের বেতনের সঙ্গে উৎসব ভাতা যোগ হবে সেক্ষেত্রে জটিলতা আরও বাড়তে পারে। ফলে ঈদের আগে বেতন-বোনাস দেয়া নিয়ে রমজানের ঈদের মতো পরিস্থিতি হতে পারে।
দক্ষ জনবলের অভাবে ধুঁকছে মাউশি!
শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়ার বিষয় নিয়ে কাজ করে মাউশি অধিদপ্তরের এডুকেশন ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (ইএমআইএস) সেল। এই সেলের দায়িত্বে থাকা সিনিয়র সিস্টেম অ্যানালিস্ট খন্দকার আজিজুর রহমান ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। অন্য কেউ এই কাজের সঙ্গে যুক্তও নন। তাই তিনি সুস্থ না হলে বেতনের বিল প্রস্তুত করা সম্ভব হচ্ছে না।
ভুক্তভোগীরা বলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ইএফটিতে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। মাউশি অধিদপ্তরে যেহেতু দক্ষ জনবল নেই, তাই তারা সরকারের অন্য কোনো দপ্তর বা আইটি বিশেষজ্ঞের সহায়তা নিতে পারত। সেটা না করে সবাইকে বিপদের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আহমেদ বলেন, ‘যিনি অসুস্থ তার তো হাত দিয়ে কাজ করতে হবে না, কাজ করবে যন্ত্র। এই দফতরে অন্য কেউ এই কাজ করতে পারবেন না এটা হতে পারে না। ওই কর্মকর্তা না থাকলে কি লোকজন বেতন পাবেন না?’
জানা গেছে, শিক্ষকদের দ্রুত বেতনের ফয়সালা করতে মাউশির ডিজি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দফায় দফায় বৈঠক করছেন। কিন্তু ইআইএমএস সেলের অসুস্থ কর্মকর্তা ছাড়া অন্য কেউ এই কাজ করতে পারছেন না বলে এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। -নিউজ ডেস্ক