(দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। সোমবার (২ জুন) বিকেলে রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম বিটিভি ও বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে একযোগে সম্প্রচারিত হয় তার বাজেট বক্তৃতা।
অর্থবছরের বাজেটে কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি, স্থানীয় শিল্পকে সহজতর করা, কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, এফডিআই আকর্ষণ, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি, কর পরিপালন ঘাটতি কমানো, ভ্যাটের হিসাব ব্যবস্থা সহজীকরণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বাজেট বক্তৃতায় উঠে এসেছে কর কাঠামো সংশোধন, প্রণোদনার পরিসর বৃদ্ধি, স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য কিছু স্বস্তিমূলক প্রস্তাব এবং রাজস্ব আয়ের নতুন কৌশল।
পুরো বাজেট বক্তৃতাটি নিম্নে হুবহু তুলে ধরা হলো:
প্রিয় দেশবাসী, আসসালামু আলাইকুম।
০১। শুরুতেই বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি মহান মুক্তিযুদ্ধের শহিদ এবং সম্ভ্রমহারা মা-বোনদের—যাদের চূড়ান্ত আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন দেশ। পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি গত বছরের জুলাই-আগস্ট মাসের বিপ্লবের অকুতোভয় শহিদগণকে যাঁরা দ্বিধাহীন ত্যাগের মহিমায় মৃত্যুকে ছাড়িয়ে আরোহণ করেছেন অনন্য উচ্চতায়। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন-এর কাছে আমি তাঁদের সকলের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
০২। ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের এক ক্রান্তিলগ্নে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। আমাদের উপর বর্তায় বিগত সরকারের রেখে যাওয়া প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার এবং নৈরাজ্য দূর করে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার কঠিন কাজটি। আমি স্বস্তি এবং আনন্দের সাথে জানাতে চাই, মাত্র ১০ মাসেরও কম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে সে লক্ষ্য পূরণে অনেকদূর এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থান এর পর যে আশায় আমরা বুক বেঁধেছিলাম তা খুব শীঘ্রই আমরা পূরণ করতে সক্ষম হবো ইনশাল্লাহ।
প্রিয় দেশবাসী
০৩। জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ভেঙে পড়া আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, শ্রমিক অসন্তোষ প্রশমিত করে শিল্প খাতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা এবং বিগত সরকারের সময়ে লাগামহীন দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার ফলে চরম সংকটাপন্ন ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের মত কঠিন চ্যালেঞ্জ আমাদের মোকাবিলা করতে হয়েছে। শুরু থেকেই আমরা সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে চেষ্টা করেছি এসব সমস্যার সমাধানপূর্বক দেশকে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে। প্রবাস আয়ের আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি, রপ্তানি আয়ের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি, কৃষি ও শিল্প খাতের উৎপাদন অব্যাহত থাকা এবং সঠিক মুদ্রা ও রাজস্বনীতির সমন্বিত প্রয়োগের সুফল হিসেবে আমরা ইতোমধ্যে কাঙ্ক্ষিত স্থিতিশীলতা অর্জনে অনেকদূর এগিয়েছি। তবে, পরিপূর্ণ স্থিতিশীলতা অর্জন করে অর্থনীতিকে স্বাভাবিক গতিতে ফিরিয়ে আনার পথে এখনো বেশ কিছু ঝুঁকি রয়েছে।
প্রিয় দেশবাসী
০৪। গত বছরের আগস্ট মাসে আমাদের সরকার যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে তখন আমাদের সামনে সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরে মানুষকে স্বস্তি দেয়া।
প্রিয় দেশবাসী
০৬। মূল্যস্ফীতির নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকা জরুরি। তবে এটি নিশ্চিত করতে হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল থাকা অত্যাবশ্যক। প্রবাস আয়ের প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক হওয়ায় এবং রপ্তানি স্থিতিশীল থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এপ্রিল মাসে বৃদ্ধি পেয়ে ২৭.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সে কারণে আমরা বিগত ১৪ মে তারিখে বাজারভিত্তিক মুদ্রাবিনিময় হার চালু করেছি।
প্রিয় দেশবাসী
০৭। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার। গত বছর আকস্মিক বন্যায় আউশ এবং আমন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চাইতে কম হওয়ায় খাদ্যশস্যের মজুদে কিছুটা ঘাটতি দেখা দেয়। এ ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে আমরা ৯ লক্ষ মেট্রিক টন চাল এবং ৭ লক্ষ মেট্রিক টন গম আমদানির সিদ্ধান্ত নেই। যার আওতায় ইতোমধ্যে ৮ লক্ষ ৫০ হাজার মেট্রিক টন চাল এবং ২ লক্ষ মেট্রিক টন গম আমদানি করা হয়েছে। পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করে কৃষি উৎপাদনের জন্য সারসহ অন্যান্য উপকরণে প্রয়োজনীয় ভর্তুকি দিচ্ছি। এছাড়া খাদ্য নিরাপত্তার গুরুত্ব বিবেচনায় সারের মজুদ বা বাফার স্টক বৃদ্ধি করা হয়েছে।
প্রিয় দেশবাসী
০৮। নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের পাশাপাশি অর্থনীতিকে সচল রাখতে জ্বালানির পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং একইসাথে তা যথাসম্ভব সাশ্রয়ী রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে নীতিগতভাবে আমরা বিদ্যুতের মূল্য আপাতত: না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বিদ্যুৎ খাতে প্রদত্ত ভর্তুকির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস করার লক্ষ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সার্বিক ব্যয় ১০ শতাংশ কমানোর পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। আমরা বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিগুলোও পর্যালোচনা করছি এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমাতে এনার্জি অডিট করার উদ্যোগ নিয়েছি। এ বছরের মধ্যেই অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৬৪৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করার এবং ২০২৮ সালের মধ্যে স্থানীয় কূপ থেকে অতিরিক্ত ১৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
০৯। আমদানির তুলনায় রপ্তানিতে অধিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ক্রমাগত উন্নতি সাধিত হচ্ছে। ২০২৫ সালের মার্চ মাসের শেষে চলতি হিসাবের ঘাটতি হ্রাস পেয়ে দাঁড়িয়েছে ০.৬৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। তবে সরকারের কৃচ্ছ্রসাধন নীতি চলমান থাকায় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর গতি কিছুটা শ্লথ হয়ে পড়েছে এবং এর ফলে প্রকল্পগুলোর জন্য প্রতিশ্রুত বৈদেশিক ঋণ ছাড়ে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। তবে, চলতি অর্থবছরের জুন নাগাদ আমরা বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর নিকট হতে আরও প্রায় ৩.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজেট সহায়তা পাবো মর্মে প্রত্যাশা করছি।
প্রিয় দেশবাসী
১০। মধ্যমেয়াদে অর্থনীতির গতি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই। অথচ তুলনীয় অনেক দেশের চাইতে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কম। রাজস্ব খাতকে আরও গতিশীল করতে এবং রাজস্ব আহরণে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করতে ইতোমধ্যে আমরা বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। অটোমেটেড ব্যবস্থার মাধ্যমে আয়কর রিটার্ন দাখিল সহজ করা হয়েছে, কর আদায় বৃদ্ধির লক্ষ্যে নতুন নতুন কর অফিস স্থাপন করা হচ্ছে এবং কর আহরণের মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি রাজস্ব কৌশল তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া, কর ব্যবস্থাপনাকে আরও কার্যকর এবং কর আদায়ের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে রাজস্ব ব্যবস্থাপনাকে রাজস্ব নীতি হতে পৃথক করার লক্ষ্যে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে।
১১। বিগত সরকারের সময়ে আর্থিক খাতে নজিরবিহীন লুটপাট এবং দুর্নীতির ফলে খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেলেও তা বারবার পুনঃতফশিলিকরণের মাধ্যমে আর্থিক খাতের প্রকৃত অবস্থা গোপন রাখা হয়েছিল। কিন্তু আমরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী Loan Lease Classification ও প্রভিশনিং ব্যবস্থা অবলম্বন করেছি। ফলে এ খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২০২৩ সালের জুন মাসের ১০.১১ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ২০.২০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এ খাতের প্রকৃত চিত্র উদ্ঘাটনের লক্ষ্যে Asset Quality Review (AQR) এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত অবস্থা নিরুপণের কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।
প্রিয় দেশবাসী
১২। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনে একটি উন্নত সমাজ বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে আমরা যে সকল কার্যক্রম গ্রহণ করেছি তার মূল লক্ষ্য হচ্ছে শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য কার্বনভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ যার মাধ্যমে আমূল পরিবর্তন হবে এ দেশের মানুষের জীবনমানের এবং মুক্তি মিলবে বৈষম্যের দুষ্টচক্র থেকে। যে স্বপ্নকে ধারণ করে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ভিত রচিত হয়েছিল, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে আগামী প্রজন্মের জন্য আমরা একটি সুন্দর, বাসযোগ্য আবাসস্থল রেখে যেতে চাই, জনগণের জীবনযাত্রায় নিয়ে আসতে চাই এক সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের ঢেউ। আমরা সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে এবারের বাজেট সাজাবার চেষ্টা করেছি।
১৩। আমাদের এবারের বাজেট কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত আমরা বিগত বাজেটের চেয়ে ছোট আকারের বাজেট আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাব করছি। প্রবৃদ্ধি-কেন্দ্রিক ধারণা থেকে সরে এসে আমরা চেষ্টা করেছি সামগ্রিক উন্নয়নের ধারণায় জোর দিতে। তাই প্রথাগত ভৌত অবকাঠামো তৈরির খতিয়ান তুলে ধরার পরিবর্তে আমরা এবারের বাজেটে প্রাধান্য দিয়েছি মানুষকে। মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, জীবিকার নিরাপত্তা এবং বৈষম্যহীন পরিবেশ—এ অত্যাবশ্যক উপাদানগুলো ছাড়া যে কোন রাষ্ট্র অকার্যকর হয়ে পড়ে, দুর্বল হয় সমাজের ভিত। এবারের বাজেটে তাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুশাসন, নাগরিক সুবিধা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বিষয়ের উপর বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্রমাগত যে সকল সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে তার সুবিধা ভোগ এবং যে সকল চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে তা মোকাবিলা করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার দিকেও মনোযোগ দেয়া হয়েছে।
প্রিয় দেশবাসী
১৪। জুলাই বিপ্লবে আত্মোৎসর্গকারীরা আমাদের সামনে একটি বিরল সুযোগ তৈরি করে দিয়ে গেছেন দেশকে সঠিক পথে পরিচালিত করে ভবিষ্যতের জন্য শক্ত ভিত গড়ার। আপনাদের সকলের সর্বাত্মক সহযোগিতায় সে লক্ষ্য পূরণের প্রত্যয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের অঙ্গীকার পূরণ করাই হবে আগামী দিনে আমাদের প্রধান লক্ষ্য।
তৃতীয় অধ্যায়: সুশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার
প্রিয় দেশবাসী
১৫। গত দেড় দশকে দুর্নীতি এবং সুশাসনের অভাবে দেশের প্রায় সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিল। তাই দেশকে পুনরায় সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে আমাদের অন্তর্বর্তী সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কারের রূপরেখা তৈরি এবং বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। ইতোমধ্যে সবগুলো কমিশন তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
দুর্নীতি প্রতিরোধ
প্রিয় দেশবাসী
১৬। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি নির্মূলের লক্ষ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর সংশোধন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে দুর্নীতি দমন সংক্রান্ত জাতিসংঘ কনভেনশন (UNCAC) অনুসরণে দুর্নীতি দমন কমিশন যথাযথভাবে কাজ করে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক গঠিত ‘দুদক সংস্কার কমিশন’ সম্প্রতি তাদের সুপারিশ প্রদান করেছে যা যাচাইপূর্বক দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে।
ভূমি আইন ও ভূমি ব্যবস্থাপনার সংস্কার
প্রিয় দেশবাসী
১৭। ভূমি সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তিতে ধীরগতি হ্রাসের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সে লক্ষ্যে ভূমি সংক্রান্ত ফৌজদারি এবং দেওয়ানি মামলা মোকদ্দমাগুলি হ্রাস করা এবং ভূমিসেবাকে সহজীকরণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। অটোমেটেড ভূমি ব্যবস্থাপনার আওতায় ভূমিসেবা ডিজিটালাইজড করা হয়েছে। ভূমি প্রশাসনের সকল সেবা পরিকাঠামোকে জনগণের নিকট পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ভূমি ব্যবস্থাপনার অটোমেশন প্রকল্প দ্রুতগতিতে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে।
নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার
প্রিয় দেশবাসী
১৮। অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হলো একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। গত দেড় দশকে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে ফেলা হয়েছে। তাই আমরা নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারের উপর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করেছি এবং এ লক্ষ্যে বিভিন্ন আইন, নীতিমালা, ও আদেশ সংশোধন ও সংস্কারের কার্যক্রম হাতে নিয়েছি।
বিচার ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সংস্কার
প্রিয় দেশবাসী
১৯। বিচার ব্যবস্থার উন্নয়নে সারা দেশের অধস্তন আদালতসমূহ তত্ত্বাবধান করার জন্য হাইকোর্ট বিভাগের ১৩ জন মাননীয় বিচারপতির সমন্বয়ে ১৩টি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টে বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও জবাবদিহিমূলক করার উদ্দেশ্যে সুপ্রীম কোর্টের বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করা হয়েছে।
নিরাপত্তা ও সুরক্ষা সেবার উন্নয়ন
প্রিয় দেশবাসী
২১। সুরক্ষা সেবার মানোন্নয়নে পাসপোর্ট প্রদানের ক্ষেত্রে পুলিশ প্রতিবেদন গ্রহণের শর্ত তুলে দেয়া হয়েছে। কারাগারকে সংশোধনাগারে রূপান্তরের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কারা ও সংশোধন পরিষেবা আইন, ২০২৫ প্রণয়নের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে।
আর্থিক খাতের পুনর্গঠন ও সংস্কার
প্রিয় দেশবাসী
২২। বিগত ১৫ বছরে আর্থিক খাতে নজিরবিহীন অপশাসনের মাধ্যমে এ খাতকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ৫ আগস্ট ২০২৪ -এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে, ব্যাংকিং খাতের দীর্ঘদিনের কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও আমানতকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে সরকার গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি, তারল্য সংকট, দেউলিয়াত্ব বা অস্তিত্বের জন্য হুমকি এমন সকল ঝুঁকির সময়োপযোগী সমাধান এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণে ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ, ২০২৫ প্রণয়ন করা হয়েছে। সংস্কারের অংশ হিসেবে তিনটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে, যার প্রধান উদ্দেশ্য হলো: (ক) ব্যাংকিং খাত সংস্কার কর্মসূচির ভিত্তি তৈরি করতে ব্যাংকগুলোর সম্পদের ব্যাপক গুণগত পর্যালোচনা করা, (খ) নীতি ও প্রবিধানসমূহের কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিতকরণে এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সুশাসন বজায় রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা এবং (গ) দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চুরি/পাচার হওয়া সম্পদ উদ্ধারে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা।
প্রিয় দেশবাসী
২৩। বিগত সরকারের অনিয়ম, কারসাজি ও দুর্নীতির ফলে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে পুনরায় গতি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোতে সরকারের শেয়ার কমিয়ে পুঁজিবাজারে অন্তর্ভুক্তকরণ, বেসরকারি খাতের দেশীয় বড় কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির জন্য উৎসাহ প্রদান, বাজারে কারসাজি রুখতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন, অনিয়মের সাথে জড়িত সকলকে আইনের আওতায় আনা, এবং ব্যাংক ঋণের উপর নির্ভরতা কমাতে পুঁজিবাজার থেকে বন্ড ও ইক্যুইটির মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহের সুযোগ বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়ে কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও সেবার উন্নয়ন
প্রিয় দেশবাসী
২৪। সরকারের নীতি ও কর্মকৃতির সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য বর্তমানে সকল মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের বাজেট প্রণয়নের কাজ iBAS++ এর মাধ্যমে সম্পন্ন করা হচ্ছে। iBAS++ সিস্টেম ব্যবহার করে বর্তমানে প্রায় ১৪ লক্ষ সরকারি চাকরিজীবী EFT এর মাধ্যমে সরাসরি তাদের ব্যাংক একাউন্টে বেতন পাচ্ছেন। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রেও EFT ব্যবহার করা হচ্ছে।
২৫। সরকারি অনুদান ও সাহায্য মঞ্জুরীর সঠিক তথ্য সংরক্ষণ এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে ১৭২টি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও এর অধীন বাস্তবায়িত প্রকল্পের বিপরীতে প্রজাতন্ত্রের সরকারি হিসাবে Personal Ledger (PL) অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। এছাড়া, সরকারি ক্রয় কার্যক্রমে অধিকতর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘Public Procurement Act’ সংশোধন করা হয়েছে। ঘরে বসে ঝামেলাবিহীন উপায়ে এক ঠিকানায় সকল সরকারি সেবা অনলাইনে প্রদানের লক্ষ্য নিয়ে অচিরেই ‘নাগরিক সেবা’ শীর্ষক প্ল্যাটফর্ম চালু করা হবে। এ উদ্যোগের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক তরুণ-তরুণীর উদ্যোক্তা হিসেবে আয়ের সুযোগও তৈরি হবে।
প্রিয় দেশবাসী
২৬। বিগত সরকারের রেখে যাওয়া সংকটাপন্ন অর্থনীতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক বিষয়ে ‘Re-strategising the Economy and Mobilizing Resources for Equitable and Sustainable Development’ শীর্ষক টাস্কফোর্স থেকে এবং দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিষয়ে শ্বেতপত্র কমিটি থেকে ইতোমধ্যে সুপারিশ পাওয়া গেছে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এবং পরবর্তী অধ্যায়ে বিবৃত খাতভিত্তিক অগ্রাধিকার নির্ধারণের ক্ষেত্রে এ সকল সুপারিশসমূহ বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।
প্রিয় দেশবাসী
২৭। আমি এখন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেট এবং আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট আপনাদের কাছে পেশ করছি।
চতুর্থ অধ্যায়: ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেট
প্রিয় দেশবাসী
২৮। সার্বিক রাজস্ব আহরণ ও ব্যয়ের অগ্রগতি বিবেচনায় নিয়ে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট সংশোধন ও সমন্বয় করতে হয়েছে।
২৯। প্রস্তাবিত সংশোধিত রাজস্ব আয়: চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেটে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা মূল বাজেট হতে ২৩ হাজার কোটি টাকা হ্রাস করে ৫ লক্ষ ১৮ হাজার কোটি টাকা রাখার প্রস্তাব করছি।
৩০। প্রস্তাবিত সংশোধিত ব্যয়: চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সরকারি ব্যয় ৫৩ হাজার কোটি টাকা হ্রাস করে ৭ লক্ষ ৪৪ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করছি। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার ২ লক্ষ ৬৫ হাজার কোটি টাকা হতে ৪৯ হাজার কোটি টাকা হ্রাস করে ২ লক্ষ ১৬ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করছি।
৩১। সংশোধিত বাজেট ঘাটতি ও অর্থায়ন: চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি প্রাক্কলন করা হয়েছিল ২ লক্ষ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে ঘাটতি প্রস্তাব করা হচ্ছে ২ লক্ষ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপি’র ৪.১ শতাংশ।
পঞ্চম অধ্যায়: ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট
প্রিয় দেশবাসী
৩২। সম্পদের সুষম বণ্টন ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়া এবারের বাজেটের অন্যতম লক্ষ্য। পাশাপাশি, রাজস্ব আয় ও সরকারি ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে একটা যৌক্তিক ও বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট প্রণয়নও হবে এ বাজেটের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য। সে পরিপ্রেক্ষিতে আমি এখন আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট কাঠামোর ওপর আলোকপাত করছি।
৩৩। রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কর অব্যাহতি যৌক্তিকীকরণসহ মধ্যমেয়াদে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করতে জনবল বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া, কর অব্যাহতি সুবিধা ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনা, কর জাল সম্প্রসারণ, বিভিন্ন পণ্য ও পরিষেবায় যথাসম্ভব একই হারে ভ্যাট নির্ধারণ করার বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনাধীন রয়েছে।
৩৪। প্রস্তাবিত রাজস্ব আয়: আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মোট ৫ লক্ষ ৬৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের প্রস্তাব করছি, যা জিডিপির ৯.০ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এর মাধ্যমে ৪ লক্ষ ৯৯ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য উৎস হতে ৬৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করার প্রস্তাব করছি।
৩৫। প্রস্তাবিত ব্যয়: আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য মোট ৭ লক্ষ ৯০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করছি, যা জিডিপি’র ১২.৭ শতাংশ। এর মধ্যে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট ৫ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ২ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করছি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই যে, ২০১৫ সালের পর অদ্যাবধি কোন বেতন কাঠামো প্রণীত না হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এবারের বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধার পরিমাণ বৃদ্ধির প্রস্তাব করছি।
৩৬। প্রস্তাবিত বাজেট ঘাটতি ও অর্থায়ন: আগামী অর্থবছরে আমাদের সামগ্রিক বাজেট ঘাটতি ও ঋণ সহনীয় পর্যায়ে থাকবে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লক্ষ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপি’র ৩.৬ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ঘাটতির মধ্যে ১ লক্ষ ২৫ হাজার কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস হতে এবং ১ লক্ষ ১ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস হতে নির্বাহ করার প্রস্তাব করছি। আগামী অর্থবছরে সুদ পরিশোধ বাবদ মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লক্ষ ২২ হাজার কোটি টাকা।
প্রিয় দেশবাসী
৩৭। এখন আমি খাতভিত্তিক সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা উপস্থাপন করছি।
ষষ্ঠ অধ্যায়: খাতভিত্তিক অগ্রাধিকার
প্রিয় দেশবাসী
শিক্ষা
৩৮। একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামো বিনির্মাণে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। তাই, এবারের বাজেটে বিজ্ঞানভিত্তিক, প্রযুক্তিনির্ভর ও কর্মোপযোগী শিক্ষার পরিবেশ তৈরি এবং যুব কর্মসংস্থানকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা
প্রিয় দেশবাসী
৩৯। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়েছে, যার মূল লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীদের জন্য পড়াশোনার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি ও মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান। প্রাথমিক শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে চলতি অর্থবছরে সারাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ৫ হাজার ৯৪৬টি শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ, ১৭ হাজার ১৬৪টি ওয়াশব্লক নির্মাণ, ৪ হাজার ৪৫০টি টিউবওয়েল স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া, চলতি শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত ৯ কোটি ১৯ লক্ষ ৫০ হাজার ৪৯২টি বই বিতরণ করা হয়েছে।
৪০। প্রাথমিক স্তরে শতভাগ শিক্ষার্থীকে ইএফটি’র মাধ্যমে উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে ‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ফিডিং কর্মসূচি’-এর জন্য ২ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করছি।
৪১। প্রাথমিক ও গণশিক্ষার গুরুত্ব বিবেচনায় আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এ খাতে ৩৫ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করছি।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা
প্রিয় দেশবাসী
৪২। উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী, আধুনিক ও বিশ্বমানে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্তর্জাতিক মানের Outcome Based Education (OBE) পদ্ধতিতে কারিকুলাম হালনাগাদ করা হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের আওতায় ৬২টি প্রকল্পের মাধ্যমে ১ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা ব্যয়ে শিক্ষা অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এছাড়া চলতি অর্থবছরে মাধ্যমিক পর্যায়ে ৫১ লক্ষ, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ৮ লক্ষ এবং স্নাতক পর্যায়ে ১ লক্ষ ৬৫ হাজার অসচ্ছল মেধাবী শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সংশোধিত পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের মাঝে সরবরাহের লক্ষ্যে ১ হাজার ৬২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করছি। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বোনাস বৃদ্ধি এবং গ্রাচ্যুইটি প্রদানসহ সকল স্তরের শিক্ষকদের মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে।
৪৩। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় মোট ৪৭ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করছি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৪৪ হাজার ১০৮ কোটি টাকা।
কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা
প্রিয় দেশবাসী
৪৪। বর্তমানে কারিগরি শিক্ষায় এনরোলমেন্টের হার ১৯ শতাংশ। ২০২৫ সালের মধ্যে এটি ২০ শতাংশে উন্নীত করতে প্রতিটি বিভাগীয় পর্যায়ে মহিলা পলিটেকনিক ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, জেলা পর্যায়ে পলিটেকনিক এবং উপজেলা পর্যায়ে টেকনিক্যাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।
৪৫। মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়নে ১ হাজার ১৩৫টি মাদ্রাসা ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে এবং ৫১৩টি বহুতল ভবনের কাজ চলমান রয়েছে। ৪৯৩টি মাদ্রাসায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া, ইবতেদায়ী পর্যায়ে বৃত্তি প্রদান এবং মাদ্রাসাসমূহ এমপিওভুক্তি বাবদ ৭২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করছি।
৪৬। কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ এর জন্য ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ১২ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করছি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ১১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ
প্রিয় দেশবাসী
৪৭। ২০৩০ সালের মধ্যে সকল নাগরিককে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনতে সেবার পরিধি বৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন ও দক্ষ জনবল নিয়োগে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের শূন্য পদ পূরণে চিকিৎসক, সেবিকা, টেকনিশিয়ান, ফার্মাসিস্ট ও স্বাস্থ্য সহকারীদের নিয়োগ ত্বরান্বিত করা হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় পদ সৃষ্টির সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে আগামী অর্থবছরে তাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদানের লক্ষ্যে অতিরিক্ত ৪ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা এবং সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির জন্য ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করছি।
৪৮। উন্নত দেশসমূহের চাহিদা অনুযায়ী কেয়ারগিভার খাতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা সম্ভব হলে একদিকে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ প্রসারিত হবে এবং একইসাথে প্রবাস আয় অর্জনের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। এ লক্ষ্যে কেয়ারগিভারদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি নার্সিং শিক্ষায় পিএইচডি কোর্স চালু এবং আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য একটি নার্স শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার বিষয় বিবেচনায় রয়েছে।
৪৯। জাতীয় উন্নয়নে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব বিবেচনায় ২০২৫-২৬ অর্থবছরে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জন্য ৪১ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করছি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এ বাবদ বরাদ্দ ছিল ৪১ হাজার ৪০৭ কোটি টাকা।
কর্মসংস্থান ও দক্ষতা উন্নয়ন
তরুণ উদ্যোক্তা এবং যুবসমাজের জন্য আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি
প্রিয় দেশবাসী
৫০। যুব সমাজের অমিত শক্তি ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দক্ষ যুবশক্তি গড়ে তোলা এবং তাদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। ‘এসো দেশ বদলাই, পৃথিবী বদলাই’ প্রতিপাদ্যকে ঘিরে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে ‘তারুণ্যের উৎসব ২০২৫’ উদ্যাপন করা হয়েছে। আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে সারাদেশে সফল যুব উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণের সিলিং বৃদ্ধি করে ৫ লক্ষ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। এছাড়া, তরুণ উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল গঠন করার প্রস্তাব করছি। তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য এমন তহবিল এবারই প্রথম। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত ও শহিদ পরিবারের সদস্যদের জন্যও আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। তরুণ-যুবাদের দেশের উন্নয়নে আরও গভীরভাবে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে আগামী অর্থবছরে ‘তারুণ্যের উৎসব’ উদ্যাপনের জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করছি।
দক্ষতা উন্নয়ন
৫১। দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীকে অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণ কারিকুলাম তৈরি করে বিশ্বমানের কারিগরি প্রশিক্ষণ সনদপত্র প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি চাহিদা নিরূপণ, চাহিদা অনুযায়ী কারিকুলাম প্রণয়ন এবং কারিকুলাম অনুযায়ী শিক্ষা/ প্রশিক্ষণ প্রদান করে Job Placement নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিল্প প্রতিষ্ঠান, প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ও একাডেমিয়া-এর মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের কার্যক্রম চলমান আছে।
বৈদেশিক কর্মসংস্থান
প্রিয় দেশবাসী
৫২। বিদেশগামী কর্মীদের বহির্গমন প্রক্রিয়াকরণের সকল কাজ ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পন্ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ৬টি জেলায় বহির্গমন ছাড়পত্র প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে সকল জেলা পর্যায়ে এ সুবিধা বিস্তৃত করা হবে।
-অনলাইন ডেস্ক