(দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) ৫ আগস্ট, দেশের ইতিহাসে অমর এক দিন। ২০২৪ সালের এই দিনে, ছাত্র-জনতার সম্মিলিত গণঅভ্যুত্থানে শেষ হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় সাড়ে ১৫ বছরের শাসন। দিনটি ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যেখানে ছাত্রদের সংগ্রামের মাধ্যমে দেশ পেয়েছে এক নতুন প্রভাত। এই দিনেই শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন এবং গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তবে, এই ইতিহাস রচনা কোনো হঠাৎ ঘটনার ফল নয়। এর পেছনে রয়েছে বছরের পর বছর ধরে গড়ে ওঠা প্রতিরোধ, অগণিত শহীদের আত্মত্যাগ এবং এক অবিস্মরণীয় গণ-অভ্যুত্থান।
কোটা আন্দোলনের সূচনা এবং বিস্তার
২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে প্রথম আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তবে ২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্টের এক রায়ে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিলকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এই সিদ্ধান্তের পরপরই ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে, এরপরে ৯ জুন আন্দোলন পুরো দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় প্রতিবাদ, এবং শিক্ষার্থীরা সরকারের কাছে ৩০ জুনের মধ্যে আলটিমেটাম দেয়, যে সময়ের মধ্যে তাদের দাবি মানা না হলে আন্দোলন আরও তীব্র হবে।
মাঠে নামেন ছাত্ররা, প্রাথমিকভাবে কোটা সংস্কারের দাবি থেকে আন্দোলন শুরু হলেও তা পর্যায়ক্রমে সরকারের নানা অন্যায় সিদ্ধান্ত এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলে যায়। ছাত্রদের মধ্যে এই ক্ষোভ তীব্র হয়ে ওঠে এবং আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, দেশব্যাপী শাহবাগ, জাহাঙ্গীরনগর, রেললাইন, মহাসড়কসহ অনেক স্থানে অবরোধ শুরু হয়।
বাংলা ব্লকেড– ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম
২০২৪ সালের ৭ জুলাই, ছাত্রদের মধ্যে নতুন এক ঐক্য গড়ে ওঠে। তারা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে এবং ঘোষণা করে ‘বাংলা ব্লকেড’। এ কর্মসূচির মাধ্যমে রাজধানী ঢাকা কার্যত অচল হয়ে পড়ে। ৮ জুলাই, আন্দোলনের জন্য একটি কেন্দ্রীয় সমন্বয় টিম গঠন করা হয়, যা আন্দোলনের আরও সাংগঠনিক গতি এনে দেয়। ছাত্রদের ঐক্য এবং সংগঠিত কর্মকাণ্ড আন্দোলনকে আরও বেগবান করে তোলে।
‘তুমি কে? আমি কে?’ স্লোগানে জেগে ওঠে দেশ
১৪ জুলাই শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদের রাজাকার বংশধর বলে কটাক্ষ করেন, এই বক্তব্যের পর সারাদেশে এক নতুন জোয়ার উঠে। ছাত্ররা প্রতিবাদ হিসেবে ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার রাজাকার!’ স্লোগান তুলে তাদের আন্দোলনকে আরও তীব্র করে তোলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে এবং দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসেও এক ধরনের জাগরণ ঘটে।
রক্তে লেখা ইতিহাস
১৬ জুলাই, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ছাত্র আবু সাঈদ। তার বুক পেতে গুলি খাওয়ার দৃশ্য সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে তীব্র প্রতিবাদ ও বেদনা ছড়িয়ে পড়ে। একই দিনে চট্টগ্রামে নিহত হন ওয়াসীম, শান্ত, ফারুক, এবং ঢাকায় শাহজাহানসহ আরও অনেক ছাত্র-জনতা। এই ঘটনাগুলো আন্দোলনকে এক নতুন পর্যায়ে নিয়ে যায়, যেখানে শুধু ছাত্রদের নয়, পুরো দেশের জনগণের মনেও গভীর ক্ষোভ এবং তীব্র প্রতিবাদ গড়ে ওঠে।
সরকারের দমন-পীড়ন এবং জাতির ঐক্য
১৮ জুলাই, ছাত্রদের ডাকে সারাদেশে শুরু হয় ‘কমপ্লিট শাটডাউন’। সরকারের পক্ষ থেকে মোবাইল এবং ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং কারফিউ জারি করা হয়। সেনা মোতায়েন হয়, কিন্তু আন্দোলন থেমে যায়নি। প্রবাসী বাংলাদেশিরা আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়ে টেকনিক্যাল সহায়তা প্রদান করেন, যা আন্দোলনকে গতি দেয়।
একের পর এক হত্যাকাণ্ড, গুম এবং শ্বাসরুদ্ধকর দমন-পীড়নের পরও ছাত্ররা আন্দোলন চালিয়ে যায়। পুলিশ এবং বিজিবির গুলিতে ১৯ জুলাই দুই শতাধিক ছাত্র-জনতা নিহত হয়। হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালিয়ে শিশু রিয়া মারা যায়, যেটি আন্দোলনকারীদের আরও উজ্জীবিত করে।
পদত্যাগের দাবি এবং গণভবনে বিজয়
২ আগস্ট থেকে আন্দোলনকারীরা ‘শেখ হাসিনার পদত্যাগ চাই’ এক দফা আন্দোলন শুরু করেন। সারাদেশে লাল কাপড় বেঁধে মিছিল করা হয়, শহীদদের জন্য কফিন মিছিল এবং গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ৫ আগস্ট, লাখো মানুষ ঢাকায় এসে একত্রিত হন। পুলিশ গুলি চালালে অনেক প্রাণ হারায়, কিন্তু সেনাবাহিনী গুলি চালাতে অস্বীকার করে। দুপুর দেড়টায় শেখ হাসিনা এবং তার বোন শেখ রেহানা ভারতে পালিয়ে যান। এরপর বিকেলে সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা দেন।
অন্তর্বর্তী সরকার ও নতুন সূচনা
৮ আগস্ট রাতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে শপথ নেন। এতে গঠিত হয় একটি উপদেষ্টা পরিষদ, যার লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, অর্থনীতি পুনর্গঠন এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া। এই সরকারের ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশে নতুন একটি রাজনৈতিক অধ্যায় শুরু হয়।
ফ্যাসিবাদী শাসনের পর্যালোচনা
২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনার শাসনামলে বিরোধী দল দমন, গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, এবং নির্বাচন ব্যবস্থার ধ্বংস ঘটে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে গণরায় উপেক্ষিত হয়, যা আন্তর্জাতিকভাবে ‘ডামি নির্বাচন’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। সর্বশেষ, ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে সরকারের ব্যবহৃত কৌশলগুলোর ফলে এই আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
বিজয়ের উৎসব, তবে শোকও
৫ আগস্ট, গণভবনে বিজয়ী জনতার ঢল নামে। রাস্তায় রাস্তায় সেজদা করে মানুষ আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানায়। মিষ্টি বিতরণ, কোলাকুলি এবং চোখে জল– ছিল এক করুণ অথচ গর্বের জয়োৎসব। তবে আন্দোলনে শহীদ হওয়া ছাত্র-জনতা এবং আহতদের পরিবারে ছিল দীর্ঘশ্বাস আর শোক।
ইতিহাস রচনা হয়েছে ছাত্রদের হাতে
শহীদ আবু সাঈদ, তামীম, রিয়া গোপসহ শত শত ছাত্র-জনতার রক্তে লেখা হয়েছে এক নতুন ইতিহাস। একদিকে পতন ঘটেছে ফ্যাসিস্ট স্বৈরশাসনের, অন্যদিকে নতুন এক স্বপ্নের সূচনা হয়েছে। -ডেস্ক রিপোর্ট