স্টাফ রিপোর্টার (দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) আজ ২৪ আগস্ট ইয়াসমিন ট্র্যাজেডি দিবস। ১৯৯৫ সালের আজকের এই দিনে দিনাজপুরে কয়েক বিপথগামী পুলিশের ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হন কিশোরী ইয়াসমিন। এই ঘটনায় দোষীদের বিচার দাবিতে আন্দোলনে ফুঁসে ওঠে দিনাজপুরের সর্বস্তরের জনতা। এরপর থেকে এই দিনটি নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ইয়াসমিন ট্রাজেডি ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবসের ২৬ বছর পার হলেও এখনো নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নারীরা। তবে নারী নির্যাতনের বিচার সঠিকভাবে না হওয়া ও সহজভাবে আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেঁচে যাওয়ায় নারী নির্যাতন বাড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। অপরদিকে ইয়াসমিন ট্রাজেডির ২৬ বছর পার হলেও আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি ও টিয়ার শেলে আহতদের খোঁজখবর কেউ রাখে না বলে আক্ষেপ করেছেন সেই সময় আহত অনেকে। ১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট দিনাজপুরের ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটে। শুধু ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হননি কিশোরী ইয়াসমিন, পরদিন মরদেহ উদ্ধারের পর পুলিশ বলতে থাকে ‘মরদেহটি একজন পতিতার’। এতে ফেটে পড়ে দিনাজপুরের সাধারণ মানুষ। শুরু হয় তীব্রতর আন্দোলন। আন্দোলনের একপর্যায়ে বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ বিনা উস্কানিতে বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে সামু, কাদের, সিরাজ ৭ জনকে হত্যা করে। আহত হয় ৩ শতাধিক আন্দোলনকারী ও সাধারণ মানুষ।
আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলি ও টিয়ার শেলের আঘাতে গুরুতর আহত হন দিনাজপুর শহরের রামনগর এলাকার ইসমাইল হোসেনের ছেলে মাসুদ রানা (৫৭)। তিনি বলেন, ‘২৭ আগস্ট কয়েক হাজার আন্দোলনকারী একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলটি জেলা কারাগারের সামনে পৌঁছালে পুলিশ লিলি মোড় থেকে অতর্কিতভাবে গুলি ছোড়ে। এ সময় আমি জেল রোডের মোটরসাইকেলের দোকানে মোটরসাইকেল মেরামতের কাজ করছিলাম। পুলিশের ছোড়া একটি গুলি আমার বাম কানের কাছে লাগে। পরে আশপাশের লোকজন আমাকে উদ্ধার করে দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতালের কাছে নিয়ে গেলে হাসপাতালের সামনেই পৌরসভার কাছে আরেকদল পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। টিয়ার শেলের আঘাতে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। পরে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।’ তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘পুলিশের গুলি ও টিয়াল শেলের আঘাতে আহত হয়ে আমি প্রায় ৯ মাস হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিয়েছি। চিকিৎসা চলাকালীন তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা দিনাজপুরে এসে নিহত ও আহত পরিবারকে সহায়তা ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের সহায়তা পাইনি। আমি বর্তমানে বাহাদুরবাজারে একটি কাপড়ের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করি। ঠিকমতো কাজও করতে পারি না। হামলায় আহত হলাম অথচ আজ পর্যন্ত আমার কেউ খোঁজ নিল না। শুধু আমিই না আমার মতো বহু জন আহত হয়ে খুব কষ্টে দিন যাপন করছে। বছর ঘুরে আসে নেতারা দিবস উপলক্ষে ভাষণ দেন, কিন্তু আমাদের বিষয়ে কেউ চিন্তা করে না।’
দিনাজপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২১ আগস্ট পর্যন্ত ২৩৩ দিনে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, নির্যাতনে মামলা হয়েছে ২৯২টি। ২০২৪ সালে এই আদালতে মামলা হয়েছে ৯০১টি। দিনাজপুর মহিলা পরিষদের সভাপতি কানিজ রহমান বলেন, ‘আজ সারা দেশে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস পালিত হলেও দিনাজপুরে পালিত হচ্ছে ইয়াসমিন ট্রাজেডি। ইয়াসমিন ট্রাজেডির ২৬ বছরেও সমাজে এখনো নারীরা নানানভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। মূলত আইনের সঠিক প্রয়োগ ও আইনের বিভিন্ন ফাঁকফোকর দিয়ে দ্রুত জামিনে বের হয়ে যাওয়ায় নারীর প্রতি নির্যাতন বেড়েছে। নারী নির্যাতনকারীদের দ্রুত বিচার করা হলে সমাজের নারী নির্যাতন অনেকটা কমে যাবে বলে আমি মনে করি।’ এদিকে গত বছরের ৩ মে রাতে অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যু হয় ইয়াসমিনের মা শরীফা বেগমের।
ইয়াসমিন ট্রাজেডি দিবস উপলক্ষে উপলক্ষে দশমাইল মোড়ে অবস্থিত ইয়াসমিনের স্মৃতিসৌধে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে কাজ করা কয়েকটি সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ, ইয়াসমিনের কবর জিয়ারত, দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটি ৩টি আদালতে ১২৩ দিন বিচার কাজ শেষে ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট রংপুরের জেলা ও দায়রা জজ আব্দুল মতিন মামলার রায় ঘোষণা করেন। মামলার রায়ে আসামি পুলিশের এএসআই মঈনুল, কনস্টেবল আব্দুস সাত্তার ও পুলিশের পিকআপ ভ্যানচালক অমৃত লাল বর্মণের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ বিধান ‘৯৫-এর ৬ (৪) ধারায় ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুর আদেশ দেন। আলামত নষ্ট, সত্য গোপন ও অসহযোগিতার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এএসআই মঈনুলকে আরও ৫ বছরের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়।
অপর দিকে দন্ডবিধির ২০১/৩৪ ধারায় আলামত নষ্ট, সত্য গোপন, অসহযোগিতার অভিযোগে অভিযুক্ত আসামি দিনাজপুরের তৎকালীন পুলিশ সুপার আব্দুল মোতালেব, ডা. মহসীন, এসআই মাহতাব, এসআই স্বপন চক্রবর্তী, এসআই জাহাঙ্গীর, এএসআই মতিয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আদালত তাদের খালাস দেন। চাঞ্চল্যকর ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা মামলার দন্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয় ৮ বছর পর অর্থাৎ ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ২০০৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর মধ্য রাত ১২টা ১ মিনিটে মামলার অন্যতম আসামি গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী উপজেলার বিশ্রামপাড়ার জসিমউদ্দীনের ছেলে এএসআই মইনুল হক, নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার চন্দনখানা গ্রামের এসএম খতিবুর রহমানের ছেলে কনস্টেবল আব্দুস সাত্তারকে রংপুর জেলা কারাগারের অভ্যন্তরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। ২০০৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মধ্যরাত ১২টা ১ মিনিটে মামলার অপর আসামি নীলফামারী সদর উপজেলার রাজপুর গ্রামের লক্ষীকান্ত বর্মণের ছেলে পুলিশের পিকআপ ভ্যানচালক অমৃত লাল বর্মণকে রংপুর জেলা কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করা হয়।
ততকালীন সময়ে কিশোরী ইয়াসমিনকে এই ধর্ষণের মাধ্যমে হত্যাকান্ডকে কিছু হলুদ সাংবাদিক হলুদ পত্রিকা কিশোরী ইয়াসমিন পতিতা আখ্যা দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করে। তখন ক্ষুব্ধ জনতা কয়েকটি স্থানীয় পত্রিকা অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়। অবাক হওয়ার বিষয় সেই পত্রিকাগুলো অবাধে ছাপা হচ্ছে সেই হলুদ সাংবাদিক বিচার এবং সংবাদপত্র বন্ধের কোন ভূমিকা আর দেখা যায়নি।