(দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) দেশের হাসপাতালে শারীরিকভাবে 'সংকটাপন্ন' অবস্থায় চিকিৎসাধীন থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ভিভিআইপি ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়ে অবিলম্বে তা কার্যকরের জন্য সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে নির্দেশনা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ।
মঙ্গলবার (২ ডিসেম্বর) সকালে উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠকের পর প্রেস ব্রিফিংয়ে সরকারের এ সিদ্ধান্ত জানান উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তবে ব্রিফিংয়ে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দেওয়ায় এ সম্পর্কে বিস্তারিত আর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘বর্তমান শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় হাসপাতালে তাঁর নির্বিঘ্ন চিকিৎসা, প্রয়োজনে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা, তাঁর নিরাপত্তা ও যাতায়াতের সুবিধা এবং উচ্চ মর্যাদা বিবেচনায় তাঁকে রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (ভিভিআইপি) ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।’
ভিভিআইপি হিসেবে ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারির পর রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মতো খালেদা জিয়ার নিরাপত্তায় এসএসএফ মোতায়েন করা হতে পারে বলে জানা যাচ্ছে।
সরকারের এ সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর প্রশ্ন উঠেছে যে, খালেদা জিয়ার ছেলে ও তার দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দেশে ফিরলে এসএসএফ-এর নিরাপত্তা সুবিধা পাবেন কি না।
যদিও তারেক রহমান কবে দেশে ফিরবেন তা এখনো পর্যন্ত নিশ্চিত নয়। কারণ তিনি নিজেই ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে জানিয়েছেন যে, তার দেশে ফেরার বিষয়টিতে 'সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ অবারিত ও একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়'।
তবে সোমবার রাতে দলের এক বৈঠকের পর দলটির মুখপাত্র ও স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেছেন, তারেক রহমান শিগগিরই দেশে ফিরবেন।
বিভিন্ন নেতাদের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্য ও খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে নেওয়া সরকারের পদক্ষেপ থেকে অনেকের ধারণা, সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলে দেশে ফিরবেন তারেক রহমান। তিনি ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর সপরিবারে লন্ডন গিয়েছিলেন।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সরকার 'ভিভিআইপি' ঘোষণা করার পরে দুপুরের পরপর ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে তার নিরাপত্তায় স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স বা এসএসএফ সদস্যরা কাজ করতে শুরু করেছে।
এসএসএফ অধ্যাদেশে 'খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি'কে শারীরিক নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়টি বলা আছে। ওই একই অধ্যাদেশে ভিভিআইপি মানে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধান ছাড়াও বিদেশি রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান কিংবা সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে ঘোষিত অন্য যেকোনো ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে বলে আইনজীবীরা বলছেন।

ফলে সরকার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খালেদা জিয়াকে ভিভিআইপি ঘোষণা করায় তিনি এসএসএফ সুবিধা পাবেন।
এখন প্রশ্ন হলো, খালেদা জিয়া ভিভিআইপি হিসেবে এসএসএফ সুবিধা পেলে তার আওতায় তারেক রহমানও আসবেন কি-না। অর্থাৎ দেশে ফিরলে তিনিও এসএসএফ সুবিধা পাবেন কি-না।
বিএনপি চেয়ারপারসনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ফজলে এলাহী আকবর মঙ্গলবার সকালে বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, তারেক রহমান দেশে ফেরার পর তার নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে এসএসএফ সুবিধা দেওয়ার একটি প্রস্তাব সরকারকে দেওয়ার পরিকল্পনা তাদের আছে।
যদিও বিএনপিরই একজন নেতা বলেছেন, রাষ্ট্র বা সরকার ঘোষিত ভিভিআইপি হিসেবে খালেদা জিয়ার জন্য যে নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা থাকবে সেটি তার পরিবারের সদস্যদের জন্যও প্রযোজ্য হবার কথা বলে তারা মনে করেন।
‘ফলে তারেক রহমান এমনিতেই ওই সুবিধা পাওয়ার কথা,’ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন তিনি। তবে তিনি তার নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন।
এর আগে তারেক রহমান তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে তার দেশে ফেরার বিষয়টিতে তার একক নিয়ন্ত্রণ নেই জানানোর পর নিরাপত্তা বিষয়টিকেই এর প্রধান কারণ বলে অনেকে ধারণা করেছিলেন।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে তিন ধরনের বিশেষ ব্যক্তি আছেন- ভিভিআইপি, ভিআইপি ও সিআইপি। এর মধ্যে ভিভিআইপি ও ভিআইপি নির্ধারণ করা হয় রাষ্ট্রীয় বিবেচনায় আর সিআইপি নির্বাচন করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।
দেশের প্রধান দুই ভিভিআইপি হলেন প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী। তাদের নিরাপত্তায় বিশেষভাবে প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট আর স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স বা এসএসএফ কাজ করে থাকে। এছাড়া রাষ্ট্র কাউকে ভিআইপি ঘোষণা করলে তার ক্ষেত্রেও নিরাপত্তা দেবে এসএসএফ।
এখন খালেদা জিয়াকে ভিভিআইপি ঘোষণা করে সরকার প্রজ্ঞাপন জারির পর ভিভিআইপিদের নিরাপত্তায় জড়িত সংস্থাগুলো তার জন্যও কাজ শুরু করবে। ফলে তার এসএসএফ সুবিধা পাওয়া এখন প্রায় নিশ্চিত।
জেনারেল এরশাদের শাসনামলে রাষ্ট্রপ্রধানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রেসিডেনশিয়াল সিকিউরিটি ফোর্স গঠন করা হয়েছিল। পরে ১৯৯১ সালে সংসদীয় পদ্ধতিতে ফেরার পর প্রেসিডেনশিয়াল সিকিউরিটি ফোর্স (পিএসএফ) সংশোধন করে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স এসএসএফ গঠন করা হয়েছিল। এসএসএফকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার বা নিরাপত্তা রক্ষায় প্রয়োজনে গুলি চালানোর মতো ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
যদিও ফেরি আটকে রাখায় স্কুল ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনার পর একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ৩১ জুলাই হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ বলেছিল যে, 'শুধু রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভিভিআইপি হিসেবে গণ্য, আর কেউ নন।'
অবশ্য আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও অন্য কোনো ব্যক্তিকে 'ভিভিআইপি' ঘোষণার এখতিয়ার সরকারের আছে।
সোমবার রাত ১২টা ২৯ মিনিটে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুইয়া ফেসবুকে তার ভেরিফায়েড পাতায় খালেদা জিয়ার ছবিসহ পোস্ট দিয়ে জানান যে 'বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে 'অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি' (VVIP) হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। এ–সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন আজ প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে জারি করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী (SSF) নিয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা অবিলম্বে কার্যকর হবে।’
কিন্তু মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত এ ধরনের কোনো প্রজ্ঞাপনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এমনকি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের ওয়েবসাইটেও এমন কোনো প্রজ্ঞাপন তখন পর্যন্ত দেখা যায়নি।
তবে সকালে উপদেষ্টা পরিষদের বিশেষ বৈঠকের পর জানানো হয় যে, এই বৈঠকে খালেদা জিয়াকে ভিভিআইপি ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ফজলে এলাহী আকবরও মঙ্গলবার বেলা ১২টা ২৫ মিনিটে বিবিসি বাংলাকে বলেন, তখনো পর্যন্ত সরকারি কোনো গেজেট হয়নি।
যদিও উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, খালেদা জিয়াকে ভিভিআইপি ঘোষণার বিষয়টি নিয়ে বিএনপি দলগতভাবে অবগত রয়েছে।

কিন্তু তারেক রহমানকেও এসএসএফ সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে সরকারের সাথে কোনো আলোচনা হয়েছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে আকবর বলেন, এ বিষয়ে সরকারের কাছে একটি প্রস্তাবনা দেওয়ার পরিকল্পনা তাদের আছে।
বিএনপির ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারেক রহমানেরই তার দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা। দলটির নেতারা অবশ্য আগে বলেছিলেন যে, নভেম্বরেই দেশে ফিরবেন তারেক রহমান।
কিন্তু ২৯ নভেম্বর তারেক রহমান নিজেই জানান যে, এ বিষয়ে তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টিতে 'একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ অবারিত ও একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়'।
এমনকি ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা তারেক রহমান বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়েছে কি-না বা আবেদন করেছেন কি- না কিংবা এ ধরনের কোনো প্রক্রিয়া চলছে কি-না তা নিয়ে সেটি তিনি বা তার দল পরিষ্কার করেননি।
সরকারের দিক থেকেও এ বিষয়ে এখনো কিছু বলা হয়নি। যদিও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন রোববার বলেছেন, তারেক রহমান দেশে ফিরে আসতে চাইলে একদিনেই তাকে ট্রাভেল পাস দেওয়া সম্ভব হবে।
তিনি তখন বলেছিলেন, ট্রাভেল পাসের নিয়ম হলো যখন পাসপোর্ট থাকে না বা মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে বলে তখন কেউ যদি আসতে চায় (দেশে ফিরতে চায়), তাহলে ওয়ান টাইম পাস দেওয়া হয় একবার দেশে আসার জন্য।
এখন খালেদা জিয়ার নিরাপত্তা সুবিধার আওতায় তার পরিবাররে সদস্য হিসেবে তারেক রহমানও এসএসএফ সুবিধা পেলে সেটি তার ঢাকায় বিমানবন্দরে অবতরণের মুহূর্ত থেকেই কার্যকর হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। সূত্র: বিবিসি বাংলা