স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুরুতে মানুষের মধ্যে নানা সংশয় ও উদ্বেগ ছিল। তা এখন আর নেই। যেকোনো ভাইরাসজনিত মহামারি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চরিত্র বদলায়। ভাইরাসগুলোর তাদের সংক্রমণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা এবং প্রায় শতভাগ মানুষ টিকার আওতায় আসার কারণে করোনা পরিস্থিতিও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তাই নতুন কোনো ভ্যারিয়েন্ট না এলে করোনার সেই প্রাণঘাতী রূপ নিয়ে ফিরে আসার সম্ভাবনা খুব কম।
তারা বলছেন, বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে সেই ভয়াবহতা না থাকলেও মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা কিন্তু থেমে নেই। করোনায় সংক্রমিত হয়ে এখনও অনেকেই বিভিন্ন ধরনের শারীরিক-মানসিক ডায়াবেটিস, স্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ, দীর্ঘমেয়াদি অসংক্রামক রোগ সমস্যায় ভুগছেন। আবার অনেকে করোনার সময়ে জীবিকা হারিয়েছেন, অর্থনৈতিক বৈষম্যও বেড়েছে। দেশে এখনও কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা আছে। সেদিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ তাদের।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়ে করোনাভাইরাস বিশ্বজুড়ে। অসংখ্যবার মিউটেশন করে শক্তিশালী ভ্যারিয়েন্ট তৈরি করছে করোনা। আর দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। প্রথম রোগী শনাক্তের ১০ দিন পর ১৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সংক্রমণ ঠেকাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। এরপর লকডাউন করা হয় দেশজুড়ে।
বন্ধ থাকে সরকারি অফিস-আদালত, যান চলাচল, হোটেল-রেস্তোরাঁ, হাটবাজার, আমদানি-রফতানি, পর্যটন স্পটসহ সবকিছু। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অফিস বন্ধ রেখে বাসা থেকে কর্মীদের কাজ করার ব্যবস্থা করে। প্রথম ঢেউ নিয়ন্ত্রণে আসে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। একই বছরের মার্চে ডেল্টা ধরনের মাধ্যমে আসে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ।
গত বছরের জুলাইয়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়। এক পর্যায়ে শনাক্তের হার ৩৩ শতাংশ ছাড়ায়। দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে আসার পর প্রতিবেশী দেশ ভারতে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রকোপে সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। দেশে এ ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়লে পরে আবার বাড়তে শুরু করে রোগীর সংখ্যা। আক্রান্ত বাড়লে হাসপাতালগুলোয় স্থান সংকুলান কঠিন হয়ে পড়ে। আইসিইউর জন্য রোগী নিয়ে হাসপাতালের দুয়ারে ঘুরতে থাকেন স্বজনরা। গ্রামে-গঞ্জে বাড়তে থাকে সংক্রমণ। উপসর্গ নিয়ে করোনা টেস্ট করতে আসা মানুষের ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয় পরীক্ষাগারে দায়িত্বরত কর্মীদের।
৬৪ জেলার অধিকাংশটিতেই আইসিইউ সাপোর্ট না থাকায় সংকটাপন্ন রোগীদের জীবন বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। রোগী বাড়তে থাকলে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কনভেনশন সেন্টারকে ফিল্ড হাসপাতালে রূপান্তর করে সেবাদান শুরু হয়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার চীন থেকে টিকা কেনার চুক্তি করে। এ ছাড়া কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশন্স (কোভ্যাক্স) থেকে টিকা সহায়তা চাওয়ার উদ্যোগ নেয় সরকার। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পাওয়া টিকায় গতি পায় টিকা কার্যক্রম।
একদিনে ১ কোটি ডোজ টিকা দেওয়ার উদাহরণ তৈরি করে বাংলাদেশ। এরই ধারাবাহিকতায় শুরু হয় করোনা টিকার তৃতীয় ডোজ অর্থাৎ বুস্টার ডোজ প্রদান। এ ছাড়া গত বছরের ২০ ডিসেম্বর থেকে দেশব্যাপী করোনা টিকার চতুর্থ ডোজের কার্যক্রম শুরু হয়। তবে গত বছরের শেষের দিকে করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের সাব-ভ্যারিয়েন্ট বিএফ-৭-এর সংক্রমণ নিয়ে কিছুটা উৎকণ্ঠা দেখা দিলে চীনসহ চারটি দেশ থেকে আসা যাত্রীদের স্থল, নৌ ও বিমানবন্দরে বিশেষ পরীক্ষার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু সংক্রমণ তেমনটা বাড়েনি। এমনকি দেশে গত কয়েক মাস ধরে করোনা সংক্রমণের হার এক শতাংশের কম-বেশির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৬ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। তবে কারও মৃত্যু হয়নি। সোমবার শনাক্তের হার হয়েছে শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ, যা আগের দিন শূন্য দশমিক ৫৯ শতাংশ ছিল। সবশেষ ১৩ ফেব্রুয়ারি দেশে কোভিডে ১ জনের মৃত্যুর খবর এসেছিল। তারপর গত ২১ দিন ধরে কোনো মৃত্যু হয়নি।
গত সোমবার পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, মৃত্যু ও সুস্থতার হিসাব রাখা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারস থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে মৃতের সংখ্যা পৌঁছেছে ৬৮ লাখ ৫ হাজার ২৫১ জনে। আর আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৬৮ কোটি ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৯৮৭ জনে।
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনায় আক্রান্তদের ১২ শতাংশ ডিপ্রেশনে (বিষণ্নতা) ভুগছেন। আর কোভিডে আক্রান্ত চিকিৎসকদের ৪০ ভাগ চিকিৎসক এবং ৩৪ ভাগ নার্সরা লং কোভিডে ভুগছেন।
করোনার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে ‘ মাল্টিটিউড অব ইস্যুস ইন কোভিড : রেনাল, কার্ডিয়াক অ্যান্ড মেটাবোলিক ইনফ্লুয়েন্স’ ও ‘লং টার্ম হেলথ কনসিকোয়েন্সেস অ্যাস এ পোস্ট কোভিড-১৯ সিকোয়াল ইন হেলথ কেয়ার ওয়ার্কার্স’ শীর্ষক গবেণায় বলা হয়, করোনায় আক্রান্ত কিডনি রোগীদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। ডায়ালাইসিসের রোগীদের করোনা হলে মৃত্যুঝুঁকি ৫০ ভাগ। ক্রনিক কিডনি ডিজিজের রোগীদের মৃত্যুঝুঁকি সাধারণ মানুষের চেয়ে ১০ গুণ বেশি।
গবেষণায় আরও বলা হয়, ডায়াবেটিস, স্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ, দীর্ঘমেয়াদি অসংক্রামক রোগ, অন্যদিকে কোভিড নিউমোনিয়া, একটি সংক্রামক রোগ। কোভিড হলে এই দুই ধরনের রোগের কিছু জটিলতা দেখা যায় এবং একটি রোগ অন্যটিকে প্রভাবিত করে। তাই কোভিড নিউমোনিয়া হলে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অন্যদিকে যাদের ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ আছে তাদের কোভিড জটিলতাও বেশি হয়।
অল্প সময়ে দেশের মানুষকে টিকার আওতায় আনায় সংক্রমণের হার কমেছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি সময়ের আলোকে বলেন, যেকোনো ভাইরাসজনিত মহামারি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চরিত্র বদলায়। ভাইরাসগুলো তাদের সংক্রমণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আর মানুষের শরীরেও এক ধরনের ভাইরাসরিবোধী প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে।
তিনি বলেন, করোনার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, মানুষ টিকা নেওয়ায় এক ধরনের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। আবার যারা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এর ফলে তাদের শরীরে আরেক ধরনের প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়েছে। ফলে সেই আগ্রাসী মনোভাব আর নেই। তাই আমরা মনে করতেই পারি আগের সেই ভয়ংকর রূপ নিয়ে করোনা আবার আসবে সেই সম্ভাবনা তেমন নেই। তবে সতর্ক থাকতে হবে।
এ ব্যাপারে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, সারা বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ এখন টিকার আওতায় এসেছে। তার চেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ কোনো না কোনোভাবে করোনায় সংক্রিমত হয়েছে। ফলে বলা যেতে পারে করোনাভাইরাস এক ধরনের কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। তবে যদি কোনো সময় নতুন কোনো ভ্যারিয়েন্ট আসে তা হলে কোনো জায়গায় কিংবা বাংলাদেশেও হঠাৎ করে সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে।
তিনি বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে বর্তমানে যেসব টিকা দেওয়া হচ্ছে নতুন কোনো ভ্যারিয়েন্ট এলেও তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। এ ছাড়া করোনা নিয়ন্ত্রণে এন্ট্রি ভাইরালসহ বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি, ওষুধ এবং দ্রুত শনাক্ত করার বেরিয়ে গেছে। আর ২০১৯ সালে চীনে যে প্রাণঘাতী রূপ নিয়ে এসেছিল তা আর নেই, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। চিকিৎসা পদ্ধতি ও মানুষের চেষ্টার কারণেই করোনা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। -অনলাইন ডেস্ক