প্রতিনিধি ২৫ এপ্রিল ২০২৩ , ৮:৩৮:২৫ প্রিন্ট সংস্করণ
মোঃ কায়ছার আলী (দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডট কম) “স্মৃতির পবিত্র অঙ্গণে কোভিড- ১৯ এর কারণে সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসবে প্রীতির বন্ধন একটু দেরিতে হলো। বিগত ৫৫ বছরের সকল ছাত্র-ছাত্রীকে একাকার ও অকৃত্রিমতার বন্ধনে আবদ্ধ করেছে আমাদের জীবনের সফলতার শেকড় আদর্শ কলেজ, দিনাজপুর। দিনাজপুর শহরের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তে দুটো কলেজ থাকায় শহরের প্রাণকেন্দ্রে, সময়ের প্রয়োজনে দৃষ্টি প্রদীপ হয়ে জন্ম নিয়েছে আদর্শ কলেজ। ১৯৬৯ সাল থেকে আদর্শ কলেজের পথচলা শুরু হয়েছে জ্ঞানের আলো বিতরণের বিদ্যাপীঠ হিসেবে। স্মৃতি অবিনশ্বর, অক্ষয়, অম্লান। কালের কপোলতলে হারিয়ে যাওয়া শুভ্র সমুজ্জল দিনগুলি আজও স্মৃতির ফ্রেমে বন্দী। এখানে এসে আজ মনে পড়ছে স্মৃতিময়তায় ঘেরা সেই ভবন, সেই প্রাচীর, মাঠসহ অনেক কিছু যা ছিল আজ নেই। আবার আজ যা আছে তখন তা ছিল না। কিন্তু সবুজ চত্তরের এই ঘাসগুলো আমাদের চরণের ছোঁয়ায় প্রতিটি বর্ষার নতুনভাবে জন্মেছে, ঝড়ে পড়া পাতাগুলো থেকেই নতুন কুঁড়ি ফুটেছে, অতীতের সাথে বর্তমানকে একই সুতোয় বেঁধে দিয়েছে আবার ভবিষ্যত প্রজন্মকেও দিবে। রবী ঠাকুরের অমর গানটির প্রথম লাইনগুলো গুণগুণিয়ে গাইতে ইচ্ছে করছে, “পুরোনো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায়, ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সেকি ভোলা যায়।” ১৯৮৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হয়ে দেখলাম এই প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষক-শিক্ষিকা পাঠদানে সমান পারদর্শী। প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ তসির উদ্দীন আহমেদ স্যার কে চোখে দেখিনি, তাঁর নাম শুনেছি। অধ্যক্ষ মোঃ আব্দুল জলিল স্যার ছিলেন সৎ, ভদ্র, বিনয়ী এবং মার্জিত। কোনো কারণে স্যার বা ম্যাডাম ছুটিতে থাকলে তিনি ঐ ক্লাস গুলো নিতেন। গণিতের আমিনুল হক স্যার, অর্থনীতির আফতাবুলআলম স্যার, পৌরণীতির দুর্লভ রায় স্যার, বাণিজ্য বিভাগের মকবুল আলম আজাদ সহ অনেকের অসাধারণ অবদান আজও স্মরণীয়। তবে বিজ্ঞান বিভাগের (রসায়ন) আমিনুল স্যার এবং বাণিজ্য বিভাগের (হি:বি:) নুরন্নবী স্যার শুধু দিনাজপুর নয়, উত্তরবঙ্গের দিকপাল। তাঁরা দুজনেই মিশনরোড নিবাসী আর বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শান্তি নারায়ণ চক্রবর্তী (ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ছাত্র) মায়া নিকেতন, চুড়িপট্টি ছিলেন আমার সবচাইতে প্রিয়তম স্যার। শান্তি স্যারের লেকচার বা ক্লাশ এ সবাই যেমন সাহিত্যরস খুঁজে পেত, প্রশান্তি পেত আর তেমনি সাহিত্য বা কবিতার নিগুঢ় অর্থ বুঝাতে পেত। বাংলা বিষয় ছিল সকল বিভাগের আবশ্যিক বিষয়। এই সাহিত্যকে কাব্যিক রসে নানা আঙ্গিকে ফুটিয়ে তোলার জন্য স্যার ছিলেন সবার কাছে এক অসাধারণ মানুষ। আদর্শ কলেজ প্রসঙ্গে স্যার বলতেন, “প্রতিটি মানুষের কাছে তার মায়ের মত সুন্দর তার ধর্ম, মতামত, পবিত্র গ্রন্থ, মহাপুরুষ, শিক্ষক-শিক্ষিকা আর নিজ নিজ অধ্যয়ণরত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান”। বিদ্যাপীঠের পাঠ চুকিয়ে আজ এই মিলনমেলায় উপস্থিত হয়ে স্যারের মূল্যবান উক্তির যেন পূর্ণতা পেল। আমাদের স্যারেরা ছিলেন মোমবাতির মত যাঁরা আলো বিলিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যেতেন, ধূপের মত গন্ধ ছড়িয়ে নিজে হারিয়ে যেতেন আর সিঁড়ির মত বুক পেতে দিয়ে আমাদের উপরে উঠিয়ে দিতেন। কী অসীম ত্যাগ? তাঁরা শিক্ষকতাকে ব্রত বা সাধনা মনে করতেন, চাকুরী নয়। আমরা শিক্ষকদের দেখলে সাইকেল বা রিক্সা থেকে নেমে পরিচয় দিতাম, কুশল বিনিময় করে দোয়া আশীর্বাদ চাইতাম। আজ ছাত্র/ছাত্রীরা শিক্ষকদের কোথাও দেখতে পেলে মুখ লুকিয়ে নেয়, পরিচয় দিতে চায় না। ব্যথিত হৃদয়ে উল্টো স্যার/ম্যাডামদেরকেই বলতে হয়, তুমি অমুক ব্যাচের ছাত্র ছিলে না? আজ শিক্ষার্থীরা স্যার বা ম্যাডামের চেয়ে ভাইয়াদের কাছে পড়তে বেশি ভালবাসে। সকল ছাত্র সংগঠনের মধ্যে ছিল সুসম্পর্ক, সহযোগিতা, আন্তরিকতা, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ। ছিল না ইভটিজিং, জানতাম না ব্লাকমেইলিং বুঝতাম না চিটিংসহ নানা রকম সামাজিক ব্যাধিগুলো। শিক্ষকদের এবং অভিভাবকদের শাসন ছিল কড়া। এরকম প্রাইভেট পড়া ছিল না, জানতাম না কোচিং সেন্টার (বাণিজ্য), খুঁজে পেতাম না নোট ও গাইড বই। এখনো সোনালী অতীতের দিকে ফিরে যাবার সময় আছে, সুন্দর ভবিষ্যত গড়ে তোলার সুযোগ আছে। আমদের স্যার ও ম্যাডামেরা দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রকে উজাড় করে দিয়েছেন বিনিময়ে এরকম আর্থিক সুবিধা পাননি আজকের মত। তাই তো তাঁদেরকে আজও বিন¤্র শ্রদ্ধা করি। এ কলেজের সুশিক্ষার পাশাপাশি ভৌত অবকাঠামো, আধুনিক শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব, বঙ্গবন্ধু কর্ণার, সুসজ্জিত লাইব্রেরি এবং শিক্ষার্থীদের মেধার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য সহ শিক্ষা কার্যক্রম ইর্ষণীয় সাফল্য লাভ করেছে। সকল শাখায় উচ্চ মাধ্যমিক, ¯œাতক পাশ এবং ১৩টি বিষয়ে সম্মান কোর্সের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ৪৬৬৫ জন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সরকারি ও বেসরকারি কলেজ র্যাংকিংয়ের ফলাফলের এই কলেজ রংপুর বিভাগ এর মধ্যে ২০১৬ সালে ৭ম এবং ২০১৮ সালে ৮ম অবস্থানে (বেসরকারি কলেজের মধ্যে দ্বিতীয়) রয়েছে। বর্তমানে ব্যবস্থাপনা কমিটি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং অতীতের তুলনায় অধিকতর যোগ্য। তারা সবসময় মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে থাকে অধ্যক্ষ স্যার ড. সৈয়দ রেদওয়ানুর রহমান এবং উপাধ্যক্ষ হাসিনা আখতার বানু (ডাবল মাস্টার্স) উচ্চ শিক্ষিত ও করিতকর্মা। বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকার যুগের চাহিদার প্রয়োজনে বা আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট সু-বিবেচনা করে প্রতিটি উপজেলায় (যেখানে ছিল না, সেখানে) একটি করে বেসরকারি মাধ্যম স্কুল এবং একটি করে বেসরকারি কলেজকে জাতীয়করণ করেছে। দেশের বৃহত্তম এবং প্রাচীন জেলা শহরগুলোতে তিন-চারটির বেশি সরকারি কলেজ রয়েছে। শিক্ষানুরাগী মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ড. দিপু মণি সহ সুবর্ণ জয়ন্তীতে আজ ২৭ এপ্রিল, ২০২৩ দেশ বরেণ্য শিক্ষাবিদেরা এই কলেজের অনুষ্ঠানে যোগদান করায় তাঁদের সকলকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন। অনিন্দ্যসুন্দর রূপবতী সাজে সেজেছে আমাদের আদর্শ কলেজ, দিনাজপুর। একজন সাবেক ছাত্র এবং দিনাজপুর পৌরসভার একজন স্থায়ী নাগরিক হিসেবে মাননীয় প্রধান অতিথি মহোদয়ের কাছে অনুরোধ করব, যে কোনো বিবেচনায় আদর্শ কলেজ, দিনাজপুরকে যেভাবে বা যে নামেই হোক (ইতিপূর্বে শুনেছিলাম) জাতীয়করণ করলে কলেজের সফলতার বড় অংশীদার হয়ে দেশরতœ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহান নামটি ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এ আমাদের বিশ্বাস।
/////////////////////////////////////////////////////////////////////////////////////////////////////////
লেখক: ১৯৮৭ সালের আই.কম বিভাগের শিক্ষার্থী