• Top News

    ২২১ কিমি গতিতে উপকূলে আছড়ে পড়তে পারে ‘মোখা’

      প্রতিনিধি ১৩ মে ২০২৩ , ৯:১৯:০৬ প্রিন্ট সংস্করণ

    অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে। এরই প্রভাবে উত্তাল হয়ে উঠেছে বঙ্গোপসাগর। গতকাল চট্টগ্রামের পতেঙ্গা উপকূলে। ছবি: ফোকাস বাংলা

    (দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডট কম) শক্তি বাড়ছে ঘূর্ণিঝড় মোখার। গতকাল শুক্রবার প্রবল থেকে মোখা অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে। উপকূল থেকে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়টি এক হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছিল। গতকাল থেকে এটি ধীরগতিতে এগোচ্ছে, ঝড়ের কেন্দ্রে প্রতিনিয়ত শক্তি বাড়ছে। কাল রোববার দুপুরের দিকে এটি কক্সবাজারের টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন উপকূলে আছড়ে পড়তে পারে। এ সময় ঝড়ের সর্বোচ্চ গতিবেগ থাকতে পারে ঘণ্টায় ২২১ কিলোমিটার। কক্সবাজার উপকূলে ২০ ফুট পর্যন্ত জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত এবং মোংলা বন্দরকে ৪ নম্বর হুশিয়ারি সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর।

    আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখার কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার। এটি দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ১৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর খুবই বিক্ষুব্ধ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর জয়েন্ট টাইফুন সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে গতকাল সকালে সাগরে ২৮ ফুট পর্যন্ত ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়েছে।

    আবহাওয়া অধিদপ্তর গতকাল বেলা সাড়ে ৩টার দিকে ১১ নম্বর বিশেষ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ২ নম্বর সংকেতটি তুলে ৪ নম্বর হুঁশিয়ারি সংকেত দেয়। পরে রাতে তিন বন্দর ও ১২ জেলায় ৮ নম্বর বিপদ সংকেত দেয়। এর আগে গতকাল সকালে প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয় বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে।

    এদিকে ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগের ১০ নম্বর বুলেটিনে বলা হয়েছে, রোববার দুপুর ১২টার দিকে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়টি খুব সম্ভবত কক্সবাজার ও মিয়ানমারের সিত্তের কাছে কিয়াকপিউ শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে যেতে পারে। সে সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ থাকতে পারে ১৫০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার।

    বড় জলোচ্ছ্বাসের কবলে উপকূল
    ঘূর্ণিঝড়টি কক্সবাজার উপকূল ও মিয়ানমার দিয়ে অতিবাহিত হলেও দেশের সব উপকূলে বড় ধরনের জলোচ্ছ্বাস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন আবহাওয়াবিদরা। কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখা কক্সবাজার ও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ওপর দিয়ে আঘাত করলেও পুরো বাংলাদেশের সব উপকূলীয় জেলায় ব্যাপক জলোচ্ছ্বাসের সম্মুখীন হবে ঘূর্ণিঝড়টি যাত্রাপথ ও বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ভৌগোলিক অবস্থান ও আকৃতির কারণে। কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ১৫ থেকে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের প্রবল আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ১০ থেকে ১২ ফুট, বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোতে ৮ থেকে ১২ ফুট ও খুলনা বিভাগের জেলাগুলোতে ৭ থেকে ১০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে ব্যাপক এলাকা প্লাবিত হওয়ার হুমকির সম্মুখীন।

    যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর জয়েন্ট টাইফুন সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল শুক্রবার সকাল ৯টায় ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে সমুদ্রে ২৮ ফুট পর্যন্ত ঢেউ তৈরি হয়েছে।

    ঝড়ের গতি বাড়ছে
    ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রথম দিকে এগোনোর গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৪ থেকে ১৫ কিলোমিটার। তবে গতকাল থেকে ঘূর্ণিঝড়টির এগোনো বেশ ধীর হয়ে যায়, গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত এটি ঘণ্টায় আট কিলোমিটার গতিতে এগোচ্ছিল। মূলত এর মধ্য দিয়ে ঘূর্ণিঝড়টির শক্তি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। কারণ গত পরশুদিন বৃহস্পতিবার সকালে মোখা ছিল ঘূর্ণিঝড়, পরে এটি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়। আর গতকাল এটি অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়। কম গতিতে এগোলে ঘূর্ণিঝড় শক্তি সঞ্চয় বেশি করে।

    দেশি ও বিদেশি আবহাওয়া পূর্বাভাস সংস্থাগুলো বলছে, নিম্নচাপের সময় এটির কেন্দ্রের ব্যাস ছিল ৪০ কিলোমিটার। গভীর নিম্নচাপের সময় ব্যাস বেড়ে দাঁড়ায় ৪৮ কিলোমিটার। অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়ার পর এটির বর্তমান ব্যাস ৭৪ কিলোমিটার। ঘূর্ণিঝড়টির এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের পরিধি প্রায় ৬০০ কিলোমিটার।

    ঘূর্ণিঝড়ের সময় বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টাপ্রতি ৬২ থেকে ৮৮ কিলোমিটার হলে এটি ঘূর্ণিঝড়। গতিবেগ ৮৮ থেকে ১১৭ কিলোমিটারের হলে সেটিকে প্রবল ঘূর্ণিঝড় বলা হয়। বাতাসের গতিবেগ ১১৭ থেকে ২২০ কিলোমিটার হলে সেটি অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়। আর এই গতিবেগ যদি ২২০ কিলোমিটারের বেশি হয় তাহলে সেটিকে সুপার সাইক্লোন বলা হয়।

    যুক্তরাষ্ট্রের স্যাটেলাইট স্পেস এক্সের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল বিকেল ৫টা পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়টি কক্সবাজার থেকে প্রায় ৯৫৫ কিলোমিটার দূরে ছিল। এ সময় ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্রে বাতাসের গতিবেগ ছিল ১৬৫ কিলোমিটার। ঝড়টি ১৫৫ থেকে ১৯৫ কিলোমিটার বেগে কক্সবাজার উপকূলে আঘাত করতে পারে।

    অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর জয়েন্ট টাইফুন সেন্টারের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় মোখার বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ২২১ কিলোমিটারের বেশি হতে পারে।

    সেন্টমার্টিনে বড় আঘাত হানবে
    যুক্তরাষ্ট্রের ধনকুবের ইলন মাস্কের স্যাটেলাইট স্পেস এক্সের তথ্য বলছে, মোখা রোববার দুপুরের আগে সেন্টমার্টিনের ওপর দিয়ে টেকনাফের দিকে এগোবে। সে অর্থে সেন্টমার্টিন দ্বীপেই ঝড়টি প্রথম আঘাত হানতে পারে। এ সময় ১৫ ফুট পর্যন্ত জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা রয়েছে। ইতিমধ্যে সেন্টমার্টিন থেকে মানুষ টেকনাফের দিকে যাত্রা শুরু করেছে। ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও স্পিডবোটে করে গতকাল সন্ধ্যার আগেই বহু মানুষ সেন্টমার্টিন ছেড়েছে। তবে সরকারিভাবে সেন্টমার্টিন ত্যাগ করার কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি।

    কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। দ্বীপটি অতিক্রমের সময় ঝোড়ো হাওয়ার গতিবেগ প্রতি ঘণ্টায় ১৬০ থেকে ১৮০ কিলোমিটারের বেশি থাকতে পারে। ফলে সেন্টমার্টিনে ১৫ থেকে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। সেন্টমার্টিন দ্বীপ অতিক্রম করতে মোখার প্রায় ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা সময় লাগবে। এই সময় সেখানে উচ্চ জলোচ্ছ্বাস থাকবে। সে জন্য সেখানকার মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়াটাই সবচেয়ে ভালো উদ্যোগ হবে।

    কক্সবাজারের লোকসংখ্যা ১১ হাজার। সেন্টমার্টিন দ্বীপে তিনটি সাইক্লোন শেল্টার আছে। তবে স্থানীয় প্রশাসন সেন্টমার্টিন দ্বীপে সাইক্লোন শেল্টারের পাশাপাশি ৩৭টি হোটেল প্রস্তুত করেছে মানুষকে আশ্রয় দেয়ার জন্য। এসব স্থানে সব মিলিয়ে সাত হাজার মানুষের জায়গা হবে। বাড়তি মানুষকে সেন্টমার্টিনের বাইরে নিতে আজ শনিবার পর্যন্ত সময় পাওয়া যাবে।

    এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখা থেকে মানুষকে সুরক্ষিত রাখতে সেন্টমার্টিনে তিনটি সাইক্লোন শেল্টার ও ৩৭টি হোটেল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে এখানে সাত হাজার মানুষকে রাখা যাবে। মানুষকে সচেতন করতে নিয়মিত মাইকিং করা হচ্ছে। শেল্টারগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণে শুকনা খাবার মজুত রাখা হয়েছে।

    ঝড়ে ক্ষতি হবে আম ও ধানের
    আম ও ধান পাকার সময় এখন। উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার, চট্টগ্রামে ও সাতক্ষীরায় আম পাকতে শুরু করেছে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে যে অতিবৃষ্টি হবে তাতে আম ও ধানের ব্যাপক ক্ষতি হবে।

    সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বোরো মৌসুমে দেশে ২ কোটি ২০ লাখ টন বোরো ধান উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৭০ থেকে ৮০ লাখ টন কাটা হয়েছে। তবে কক্সবাজার এলাকায় ধান এখনো কাটার মতো হয়নি।

    সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও আবহাওয়া অধিদপ্তর যৌথভাবে এ অবস্থাতেই ধান কাটার নির্দেশনা দিয়েছে। সংস্থা দুটি বলছে, ৮০ শতাংশ পেকে যাওয়া ধান কেটে ফেলতে হবে। কেটে ফেলা ধান নিরাপদ স্থানে পরিবহন করার মতো সময় না থাকলে প্লাস্টিক দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। কিন্তু আমের ক্ষেত্রে কী হবে, সে বিষয়ে কোনো পরামর্শ দেয়া হয়নি।

    ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় প্রস্তুতি
    রোববার দুপুরে সর্বোচ্চ ২২১ কিলোমিটার বেড়ে অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে মূল অগ্রভাগে আঘাত হানতে পারে। তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার দুই উপকূলেই ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিয়েছে। গতকাল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবিলায় কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে ১ হাজার ৬০৬টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ১০ লাখ ৭ হাজার ১০০ জনকে আশ্রয় দেয়া যাবে। -নিউজ ডেস্ক

    মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়।

    আরও খবর

    Sponsered content