
(দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডট কম নিজেদের পছন্দমতো স্থানে সমাবেশ করতে পুলিশের অনুমতি না পাওয়ায় কর্মসূচি এক দিন পিছিয়ে দিয়েছে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। তবে সমাবেশ পেছালেও দুই দলের কর্মসূচি একই দিনে ঘোষণা করায় আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা কমেনি জনমনে। বরং তা আরও দীর্ঘায়িত হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে গত কয়েক দিন ধরে রাজনৈতিক অঙ্গন বেশ উত্তপ্ত। বৃহস্পতিবার ঢাকায় ১১টি স্থানে বিএনপিসহ তাদের সমমনা দলগুলো আলাদা আলাদাভাবে সমাবেশের কর্মসূচি ডেকেছিল। একই দিনে পাল্টা শান্তি সমাবেশ করতে চেয়েছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তিন সহযোগী সংগঠন-যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ। এ ছাড়া ইসলামী আন্দোলনও সমাবেশের ডাক দেয়। সব মিলিয়ে আজ রাজধানীর ১৩টি স্থানে রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে নিজেদের পছন্দমতো স্থানে সমাবেশ করার অনুমতি দেয়নি পুলিশ। অনুমতি না পাওয়ায় বৃহস্পতিবারের পরিবর্তে শুক্রবার সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে দল দুটি। তবে জনমনে আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা দূর হয়নি। উপরন্তু ছুটির দিনেও রাজধানীর বিশাল জায়গায় একই দিনে এত সমাবেশের কারণে রাজপথ উত্তপ্ত থাকার পাশাপাশি স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে।
জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কয়েক দিন আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রাক-নির্বাচনি অনুসন্ধানী দল এবং যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফরের মধ্যেই ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদের পাল্টাপাল্টি এক দফা ঘোষণা সাধারণ নাগরিকদের শঙ্কিত করে তুলেছে। তার পরে গত সপ্তাহে টানা দুদিন পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করেছে তারা। কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। এ নিয়ে দেশবাসীর মধ্যে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে।
বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, গত সপ্তাহে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির কারণে মঙ্গল ও বুধবারও রাজধানীতে তীব্র যানজট সৃষ্টি হওয়ায় নগরবাসীকে তীব্র ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছিল। প্রধান দুই দল জাতীয় নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এভাবে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন অব্যাহত রাখলে পরিস্থিতি রাজনৈতিক সংঘাতের দিকে ধাবিত হবে। তাই কিছুটা ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে দুই দলকেই পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পরিহারের পরামর্শ দেন তারা। কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের একজন ছাত্রীর অভিভাবক জানান, ছুটির দিন হলেও একই দিনে একাধিক রাজনৈতিক দলের সমাবেশের কারণে অভিভাবকদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। কারণ আতঙ্ক-উৎকণ্ঠার মধ্যে সন্তানদের নিয়ে বাসার বাইরে যাওয়ার সুযোগ থাকে না।
একাধিক পরিবহন মালিক জানান, সাধারণ বাস মালিকরা খুব আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। এভাবে পাল্টাপাল্টি সমাবেশের কারণে সংঘর্ষ হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়তে হয় তাদের। কারণ গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এর আগেও আন্দোলনের নামে অনেক গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। তাই পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব এনায়েত উল্লাহ খান জানিয়েছেন, একাধিক দলের কর্মসূচি থাকায় মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তবে সহিংসতা না ঘটালে বাস চলাচল স্বাভাবিক থাকবে।
নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজপথ দখলে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। আর বিএনপি যাতে ঢাকা অচল করতে না পারে সে জন্য আওয়ামী লীগও পাল্টা কৌশল হিসেবে একই দিনে কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে মাঠে থাকছে। তারাও তাদের শক্তি দেখাচ্ছে। দুই দলের পাল্টাপাল্টি এমন কৌশলে সংঘাতের আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। একই সঙ্গে দুই দলের শীর্ষ নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে রাজনীতির মাঠে উত্তেজনাও ছড়াচ্ছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের এ রকম পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি সাধারণ মানুষের মধ্যে দুর্ভোগ এবং উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে দিয়েছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে দুই পক্ষই পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালনের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এটা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়বে। দুই পক্ষই যদি তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে তা হলে আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের পথ আরও কঠিন হবে। তাই সাধারণ মানুষের উদ্বেগ এবং দেশের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে দেশের শীর্ষ দুই রাজনৈতিক দলকে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পরিহার করে ইতিবাচক রাজনীতি করতে হবে। এটা যদি তারা করতে না পারে তা হলে আবারও রাজপথে মারামারি, হানাহানি শুরু হবে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে দীর্ঘ দিন ধরেই দেশে রাজনৈতিক একটা সংকট চলছে। এর থেকে উত্তরণে সব দলকে নিয়ে সংলাপ হওয়া উচিত। এ জন্য সরকারের যেমন দায়িত্ব রয়েছে তেমনি বিরোধী দলগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে। আলোচনার মাধ্যমে যদি সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন করা যায় তা হলে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও তৈরি হবে। দুই শীর্ষ রাজনৈতিক দলের ধারাবাহিক ভাবে এ রকম পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি সংকট সমাধানের কোনো ইঙ্গিত মনে হচ্ছে না। এ ধরনের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি বন্ধ হওয়া উচিত।
পুলিশের প্রাক্তন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ গণমাধ্যমকে বলেন, একটি গণতান্ত্রিক দেশে সভা-সমাবেশ করার অধিকার রাজনৈতিক দলগুলোর আছে। আমরা সবসময় দেখে আসছি, জাতীয় নির্বাচন এলেই রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি বেড়ে যায়। এবার একাধিক বিরোধী দল ও ক্ষমতাসীন দল পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিচ্ছে। কাজেই নিরাপত্তার বিষয়টি এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই যদি সচেতন থেকে শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করে ও নির্দেশনা দেয় নেতাকর্মীদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থাকার তা হলে বিশৃঙ্খলা হবে না।
নাশকতা এড়াতে ঢাকার প্রবেশমুখে চেকপোস্ট : র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, রাজনৈতিক দলের সমাবেশ ঘিরে যেকোনো ধরনের নাশকতা এড়াতে রাজধানী ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে যেকোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা হবে। ঢাকার প্রবেশদ্বারগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করা হবে। যাতে কেউ অবৈধ অস্ত্র বা নাশকতা সৃষ্টির মতো কোনো ধরনের কোনো সামগ্রী নিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করতে না পারে। তাই চেকপোস্ট স্থাপন করে প্রবেশদ্বারে নিরাপত্তা জোরদার করা হবে। কর্মসূচি ঘিরে সাইবার পেট্রোলিং করা হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো ধরনের অপপ্রচারের মাধ্যমে কেউ যাতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে সে বিষয়ে আমাদের নজরদারি থাকবে।
রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ মোতায়েন : ডিএমপির উপকমিশনার (মিডিয়া) মো. ফারুক হোসেন বলেন, শুক্রবারের সমাবেশ ঘিরে সব ধরনের নাশকতা প্রতিরোধে সমাবেশস্থলসহ রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে বিপুল পরিমাণ পুলিশ মোতায়েন থাকবে। এ ছাড়া ঘটনাস্থলে সিসি ক্যামেরা স্থাপনসহ সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করবে ডিবি ও সিটিটিসির কর্মীরা। তিনি বলেন, ডিএমপিতে প্রায় ৩২ হাজার পুলিশ সদস্য রয়েছে। এ ক্ষেত্রে যেখানে যেমন প্রয়োজন সেভাবে পুলিশ মোতায়েন করা হবে। ঢাকার বাইরে থেকে কোনো পুলিশ সদস্য আনা দরকার হবে না।
এদিকে বিএনপির মহাসমাবেশের দিন যুবলীগ কর্মসূচি দিয়ে সংঘাত সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে বলে মন্তব্য করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। কোনো সংঘাত-সংঘর্ষ হলে এর দায় ক্ষমতাসীন দল ও সরকারকে নিতে হবে হুঁশিয়ারি করেছেন তিনি।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আন্দোলনের নামে কোনো ধরনের সন্ত্রাস ও সহিংসতা সৃষ্টি করলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ তা মোকাবিলা করবে। কোনোভাবে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিনষ্ট হলে এবং জননিরাপত্তার বিঘ্ন ঘটলে তার দায়ভার বিএনপিকে নিতে হবে। গত বুধবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রসঙ্গত, নয়াপল্টনে বিএনপি, শিল্পকলা একাডেমির সামনে গণতন্ত্র মঞ্চ, প্রেসক্লাবের সামনে গণ-অধিকার পরিষদ ও বাম গণতান্ত্রিক জোট, বিজয়নগর মোড়ে ১২ দলীয় জোট, বিজয়নগর পানির ট্যাঙ্কির সামনে ১১ দলীয় জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ও লেবার পার্টি, আরামবাগে গণফোরাম (মন্টু নেতৃত্বাধীন) সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। অন্যদিকে বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে শান্তি সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগ। আর বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করে ইসলামী আন্দোলন। তবে পুলিশ কোনো দলকেই কর্মসূচি পালনের অনুমতি দেয়নি
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বুধবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে জনগণের ভোগান্তি হলে এসব কর্মসূচির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে। -নিউজ ডেস্ক