প্রতিনিধি ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ , ৫:৪৯:৪৫ প্রিন্ট সংস্করণ
স্টাফ রিপোর্টার (দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) একসময় পল্টনসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বের হলেই চোখে পড়ত স্যুট-টাই পরা শত শত মানুষ। রাস্তা দিয়ে কেউ হেঁটে যাচ্ছেন দেখলেই তার সঙ্গে কথা বলে দেয়া হতো মাসে লাখ টাকা আয়ের প্রস্তাব। পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে, সেই সময়ে সাধারণ মানুষ টাই পরা লোক দেখলেই দূরে থাকার চেষ্টা করতেন। এরপর সময়ের সঙ্গে জল গড়িয়েছে বহুদূর। পল্টন এলাকার আশপাশে প্রধান কার্যালয় থাকা ডেসটিনি-২০০০ নামক কোম্পানিটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সেই ডিস্ট্রিবিউটরদের দৌরাত্ম্যও কমেছে।
উত্তরবঙ্গের সহজ-সরল মানুষকে টার্গেট করে অবশ্য মাল্টি লেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম ব্যবসা নতুন কিছু নয়। যুবক নামে এক কোম্পানি দিয়ে আলোচনায় আসে ধারণাটি। যাদের মূলমন্ত্র ছিল নিজে প্রতিষ্ঠানটিতে যোগ দিয়ে অন্যদের যুক্ত করানো। তাতে মিলত মোটা অঙ্কের কমিশন। দুঃখের বিষয়, সেই সব কোম্পানির কোনোটিই বেশি দিন টিকতে পারেনি।
এরপর শুরু হলো অনলাইনে প্রতারণা। ক্লিক করলেই ডলার আয়-এমন ধারণা নিয়েও বেশ কিছু কোম্পানি প্রতারণা করে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। ইউনিপে টু ইউ নামক কোম্পানির ফাঁদে ক্ষতি হয়েছে আরও বড়। তারা মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তা বছরের মধ্যে দ্বিগুণেরও বেশি করে দেয়ার প্রস্তাব দিত মানুষকে। সাধারণ মানুষকে বোঝানো হতো স্বর্ণের ব্যবসা করে মোটা অঙ্কের লাভ তাদের। ফাঁদের ধরন যেমনই হোক, দিন শেষে প্রমাণ হয়েছে এসব ছিল শুধুই প্রতারণা। যদিও এসব কোম্পানির অফিস কিংবা মালিকপক্ষ বাংলাদেশে থাকায় বেশ কয়েকটি মামলাও হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইন অ্যাপ ‘এমটিএফই’ অভিনব কায়দায় মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে কমবেশি ১১ হাজার কোটি টাকা। যাদের প্রলোভন ছিল ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্যবসা করে মোটা অঙ্কের লাভ দেয়া। তবে তাও যে শুধুই প্রলোভন, তা অবশ্য হারানোর পরে বুঝেছেন সাধারণ মানুষ। অফিস কিংবা মালিককে না দেখেও শুধু শুনে যেখানে বিনিয়োগ করেছিলেন প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। যাদের আবার সিংহভাগই বাংলাদেশি। তাদের অনেকের কাছেই শোনা যায় কোম্পানিটির মূল হোতা যারা তারা বাংলাদেশি। যদিও দুবাই থেকেই নিয়ন্ত্রণ করত তাদের প্রলোভন কার্যক্রম।
অনলাইনে কোটিপতি বানানোর শত শত ফাঁদ
এত আলোচনা-সমালোচনার পরও থেমে নেই অনলাইন প্রতারণা। বর্তমানেও ওয়েবসাইট কিংবা অ্যাপের মাধ্যমে অভিনব কায়দায় জাল বিস্তার করেই যাচ্ছে প্রতারকরা। প্রত্যেকটির নাম হয়তো জানাও সম্ভব নয়। যারা এসব জায়গায় বিনিয়োগ করছেন, তারাও গোপনীয়তা বজায় রেখেই আরেকজনকে বলছেন। দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকমের কয়েক দিনের অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে আরও ভয়াবহ চিত্র। নিজে কিছু বিনিয়োগ আর অন্যদের বিনিয়োগ করিয়ে কোটিপতি বানানোর নানা প্রলোভন দিয়ে যাচ্ছে এসব নামধারী অ্যাপ। দিনাজপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় সেমিনারও করতে দেখা যায় এসব প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্তাদের। বর্তমানে কয়েক শ’ অ্যাপ কিংবা ওয়েবসাইট এভাবে কোটিপতি হওয়ার প্রলোভন ছড়িয়ে দিচ্ছে। যাদের ওয়েবসাইটে দেয়া রয়েছে দুবাই, ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা কিংবা অন্য কোনো দেশের ঠিকানা।
অবিশ্বাস্য সব অফারের ছড়াছড়ি
শিরোনাম দেখে যারা অবাক হয়ে ভাবছিলেন কী বলে এসব? এবার আসছি তাদের দ্বিধা দূর করতে। জি, মাত্র ১০ দিনেই বিনিয়োগের টাকা দ্বিগুণ করে দেয়ার অফার রয়েছে ‘মারফিন-ইনভেস্টমেন্ট ডট ওআরজি’ নামক এক প্রতিষ্ঠানে। যে প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে দেখা যায় মোট পাঁচটি বিনিয়োগ পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। যার মধ্যে প্রথম প্লাানে বিনিয়োগ করা যাবে সর্বোচ্চ ৩০০ ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩৩ হাজার টাকা। মাত্র ২৪ ঘণ্টা বা এক দিনেই যেখানে ১৫ শতাংশ লাভ দেয়ার প্রলোভন দেয়া হয়েছে।
এভাবে দ্বিতীয় পরিকল্পনায় দুই দিনে ৩০ শতাংশ লাভ দেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছে, যেখানে বিনিয়োগ করা যাবে ৫০০ থেকে ১ হাজার ৪৯৯ ডলার। এভাবে সর্বশেষ বিশেষ পরিকল্পনায় বলা হয়েছে বিনিয়োগ করা যাবে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ডলার। আর এখানে ১০ দিনেই মিলবে বিনিয়োগকৃত অর্থের সমপরিমাণ অর্থাৎ ১০০ শতাংশ লাভ। এখানেই শেষ নয়, যে এজেন্ট এমন বিনিয়োগ এনে দেবে তার জন্য রয়েছে ১০ শতাংশ কমিশন। ওয়েবসাইটিতে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে যুক্তরাজ্যের। তবে দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকমের অনুসন্ধ্যানে দেখা যায়, এত বড় অফার দেয়া কোম্পানির ওয়েবসাইটটি তৈরি হয়েছে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আর মেয়াদ শেষ হচ্ছে চলতি বছরের ডিসেম্বরের ২ তারিখে।
মারফিন ছাড়াও বাজারে জাল বিস্তার করছে ‘মোবিক্রিপ’ নামক আরেক কোম্পানি। যাদের প্রস্তাব রয়েছে ২৫ মাসে বিনিয়োগকৃত অর্থ ২৫০ শতাংশ করে দেয়ার। অর্থাৎ ১ লাখ টাকা বিনিয়োগ আড়াই লাখ হয়ে যাবে এই সময়ে। এই কোম্পানিতেও কাউকে বিনিয়োগ করাতে পারলে মিলবে ১০ শতাংশ কমিশন। আরও বেশি গ্রাহক আনতে পারলে মোটা অঙ্কের কমিশনের সঙ্গে পাওয়া যাবে বেশ কিছু বোনাস। যারা মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন, তাদের জন্য রয়েছে বেশ কিছু পদবিও। যার মধ্যে সবচেয়ে বড় পদবি ‘ইমপেরর’ হতে পারলে তাকে ৩ লাখ ডলার দিয়ে দুবাইয়ে বাড়ি কিনে দেয়ার প্রলোভন দেয়া রয়েছে ওয়েবসাইটটিতে।
‘ফিনটচ’ নামক আরেক অ্যাপের প্রস্তাব প্রতিদিনের। তাদের কাছে কেউ ১ হাজার ডলার বিনিয়োগ করলে প্রতিদিন মিলবে কমপক্ষে ১৪ ডলার বা ১ হাজার ৬০০ টাকা। এখানেও কাউকে বিনিয়োগ করাতে পারলে রয়েছে মোটা অঙ্কের কমিশন। এই কোম্পানির আবার রয়েছে নিজস্ব ক্রিপ্টোকারেন্সি। শুরুতে প্রতিটি কয়েনের দাম উঠেছিল কয়েক হাজার ডলার। তবে বর্তমানে কমতে কমতে চলে এসেছে ৫০ ডলারের ঘরে। তাতে যারা বিনিয়োগ করেছিলেন, তাদের বড় অঙ্কের আর্থিক ক্ষতিও হয়েছে ইতোমধ্যে।
এ ছাড়া প্লাটিন কয়েন, প্লাটিন আই-এক্স, ক্রাউড ওয়ান, হিলটন, পিএলসি এক্স, পিএএলসি, ফোর্সেস, সিবিএস, ওয়ালমার্ট, কিউটেক্স, মেটিক থোর্স, এক্স ম্যাক্স, আলট্রন-ইউএলএক্স, মেটা টিআরসহ নামে-বেনামে বাজারে অফার ছড়াচ্ছে শত শত অ্যাপ। যাদের ফাঁদে পড়ে আরও অনেকেই নিঃস্ব হওয়ার শঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
দিনাজপুরে ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবসা তুঙ্গে : দিনাজপুর জেলা শহর থেকে ১৩টি থানায় এই এমএলএম প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছেন বহু মানুষ। ধারণা করা হচ্ছে এই জেলা থেকে আনুমানিক ৮ কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বহু যুবক তাঁর লিখিত অভিযোগে জানিয়েছেন, দিনাজপুর জেলায় একটি চক্র এই ব্যবসাটি পরিচালনা করছেন। প্রতারক চক্রের বেশির ভাগ ইনসুরেন্স কোম্পানির লোক। লিখিত অভিযোগে জানা যায়, ক্রিপ্টোকারেন্সির এমএলএম ব্যবসার প্রতারক মাষ্ট্রারমাইন হলেন ফেনি জেলার মারুফ হাসান জনি, মুরগরইল, বসন্তকেদার, মোহনপুর রাজশাহী মোঃ নজরুল ইসলামের পুত্র মোঃ এরশাদ আলী, বাঘমারা রাজশাহীর জাহিদুল ইসলাম, দিনাজপুর জেলার নিউটাউন ৩নং উপশহরের ফারুক হোসেন, বশিরবানিয়া পার্বতীপুরের জাহিদ হাসান সুমন, কারেন্টহাট চিরিরবন্দরের সাইফুল ইসলাম, চিরিরবন্দরের হাফিজুর রহমান সুমন, লালমনিরহাটের মনির হোসেন, হাজীর মোড় চিরিরবন্দরের মোশাররফ হোসেন, চিরিরবন্দর রাবার ড্রামের পাশেই হাফিজুর রহমান, আখতারুল ইসলাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ রাজশাহীর শরিফুল ইসলাম, মিনহাজ উদ্দিন, জিয়াউর রহমান জুয়েল, রেজাউল করিম, দিনাজপুর পৌরসভা সংলগ্ন এলাকার জাকির হোসেন, ফেরোজ জামান, দিনাজপুর নবাবগঞ্জ উপজেলার ইমন খান, যশোরের সোহেল রানা, পাবনলা জেলার জাহিদ হাসান, রাজশাহী মোহনপুরের ইমন আলী, আবুল কালাম আজাদ, আহামেদ রকি, বাগমারা রাজশাহীর জাইবুর রহমান, আশরাফুল আলম রংপুর জেলার হাসেম, মন্ডল আব্দুল মান্নান প্রমুখ। ভুক্তভোগী হাফেজ মোজাম্মেল হোসেন, হাফেজ আবু তালহা, মিঠুন চন্দ্র রায়ের নিকট হতে দিনাজপুর সেতাবগঞ্জ, দিনাজপুর সদর, চিরিরবন্দর, পার্বতীপুর, বিরল উপজেলায় এই চক্রটি ইতোমধ্যে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। করছেন না মোবাইলে যোগাযোগ। টাকা ফেরত চাইলে ভুক্তভোগীদের দেয়া হচ্ছে প্রাণনাশের হুমকি। পার্বতীপুর উপজেলার রাজা রামমোহন স্কুল এন্ড কলেজের কয়েকজন শিক্ষকও লোভে পড়ে হারিয়েছেন প্রায় ২০ লাখ টাকা। দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম একটি অনুসন্ধ্যানী টিম এই চক্রটির সবার সাথে কথা বলে জানা গেছে, এরা সবাই প্রতারণ চক্র। তারাও ডলার কিনেছেন। ইনসিইরেন্স ব্যবসার আড়ালে এই চক্রটি ইতোমধ্যে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। উক্ত প্রতারক চক্রটি ইতোমধ্যে পাসপোর্ট রেডি করে মালয়েশিয়া-ডুবাই পালানোর পরিকল্পনা করছে বলে জানা গেছে। ভুক্তভোগীরা দিনাজপুর জেলা প্রশাসন, এনএসআই সহ সকল আইনপ্রয়োগকারীর সহায়তা চেয়েছেন এদের বিচারের জন্য।
যা বলছে পুলিশ
একের পর এক এমন প্রতারণার ঘটনা ঘটলেও পুলিশের কাছে খুব বেশি অভিযোগ আসেনি বলে জানালেন ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম দক্ষিণ বিভাগের এডিসি কাজী মাকসুদা লিমা। তিনি বলেন, কেউ প্রতারণার শিকার হলে আইন অনুযায়ী আগে থানায় যেতে হবে। সেখানে মামলা কিংবা জিডি করলে তারপর তারা ব্যবস্থা নিতে পারেন। অ্যাপের প্রতারণার বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সতর্ক করে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘ডিজিটাল প্রতারণা থেকে দূরে থাকতে হবে, কোনোভাবেই লোভে পড়া যাবে না।’ নিজের কষ্টার্জিত অর্থ বিনিয়োগে আরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন কাজী মাকসুদা লিমা।