প্রতিনিধি ১৮ ডিসেম্বর ২০২১ , ৬:৩৭:২৩ প্রিন্ট সংস্করণ
(দিনাজপুর২৪.কম) যুক্তরাষ্ট্র যাতে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সে জন্য প্রকাশ্যে প্রচেষ্টা ছিল কয়েক বছর ধরে। এর মধ্যে গত প্রায় এক বছর যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কমিটি থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা র্যাবের বিষয়ে সরব ছিল। তারা চিঠি, পিটিশন দেওয়াসহ বিভিন্ন আলোচনায় র্যাবকে নিষিদ্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহবান জানিয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে বিভিন্ন সময় জবাবও দেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দাবি করছেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের ব্যাখ্যা হয়তো গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার মতো করে উপস্থাপন করা যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির ১০ জন সদস্য গত বছরের ২৭ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীকে চিঠি লিখে র্যাবের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহবান জানান। ডেমোক্রেটিক পার্টির সিনেটর বব মেনেনডেজ ও রিপাবলিকান পার্টির সিনেটর টড ইয়াং ছাড়া ওই চিঠিতে সই করেছিলেন রিপাবলিকান পার্টির সদস্য কোরি গার্ডনার, মার্কো রুবিও এবং ডেমোক্রেটিক পার্টির বেন কার্ডিন, জিন শাহিন, ক্রিস মার্ফি, ক্রিস কুনস, জেফ মার্কলে ও করি বুকার।
সিনেটররা চিঠিতে গুমবিষয়ক জাতিসংঘ ওয়ার্কিং গ্রুপের চিঠি, বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ নিয়ে আলজাজিরার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানের প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পররাষ্ট্র দপ্তরের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের প্রভাবশালী পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটি যখন এ ধরনের চিঠি লেখে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর জন্য তা উপেক্ষা করা কঠিন। কারণ ওই কমিটিগুলোর কাছে মন্ত্রীদের জবাবদিহি করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যদের মনোনয়ন দেওয়ার পর ওই কমিটিগুলোই শুনানির মাধ্যমে মনোনীতদের বিষয়ে ছাড়পত্র দেয়। নিষেধাজ্ঞা চেয়ে চিঠি লেখা সিনেটরদের কয়েকজন বর্তমানে পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটিতেও আছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও অর্থ দপ্তর গত ১০ ডিসেম্বর র্যাব এবং এর সাত সাবেক-বর্তমান শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ‘গ্লোবাল ম্যাগনিটস্কি মানবাধিকার জবাবদিহি আইনের’ আওতায়। যৌথ চিঠিতে সিনেটররা ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের আগের মাসগুলোর ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ বিচারবহির্ভূত হত্যা বৃদ্ধির অভিযোগ আনেন।
মার্কিন সিনেটররা ছাড়াও নিউ ইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ), যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছে। এইচআরডাব্লিউয়ের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁর সংস্থা বেশ কয়েক বছর ধরেই র্যাব নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছিল।
এইচআরডাব্লিউ গত ৯ ডিসেম্বরও গুমের জন্য র্যাবকে দায়ী করে বিবৃতি দিয়েছে। তাতে র্যাবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গত বছরের অক্টোবর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনকে ১০ মার্কিন সিনেটরের চিঠি এবং এ বছর আগস্ট মাসে ব্রিটিশ সরকারকে যুক্তরাজ্যের গুয়ের্নিকা ৩৭ চেম্বারের আবেদনের কথা উল্লেখ করা হয়। বিবৃতিতে এইচআরডাব্লিউ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, গুমের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের কথা কেউ বিশ্বাস করে না। জাতিসংঘ ও দাতারা কবে ব্যবস্থা নেবে, সেটিই এখন প্রশ্ন।
সাম্প্রতিক ঘটনা হিসেবে গত ৩১ আগস্ট বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের টম ল্যান্টোস মানবাধিকার কমিশনের ব্রিফিংকেও গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত ওই ব্রিফিংয়ে আলোচকরা অভিযোগগুলোর বিষয়ে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ প্রত্যাশা করেন। বিশেষ করে, বাংলাদেশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক পর্যালোচনা করতে তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোকে আহবান জানান। রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটসের ভাইস প্রেসিডেন্ট (ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড লিটিগেশন) অ্যাঞ্জেলিটা বায়েন্স সেদিন বলেছিলেন, অভিযোগ তদন্তে সরকারের অনীহা রয়েছে। তিনিও বাহিনীটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহবান জানান।
যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের কর্মকর্তারা সেদিনের ওই আলোচনা পর্যবেক্ষণ করেন এবং কংগ্রেস সদস্যদের এ বিষয়ে জানানোর আশ্বাস দেন।
র্যাবের বিষয়ে বিদেশে তুলে ধরা অভিযোগগুলোর বিষয়ে সরকার কী করেছে, জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, অভিযোগগুলোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন গত ১১ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আর্ল আর মিলারকে তলব করে বলেছেন, যে অভিযোগগুলোর ভিত্তিতে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, সেগুলোর বিষয়ে ব্যাখ্যা সরকার জাতিসংঘসহ বিভিন্ন ফোরামে আগেও দিয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের টম ল্যান্টোস মানবাধিকার কমিশনে বাংলাদেশ নিয়ে ব্রিফিংয়ের আগে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম শহীদুল ইসলাম ওই কমিশনের যৌথ সভাপতি জেমস পি ম্যাকগভার্ন ও ক্রিস্টোফার এইচ স্মিথকে চিঠি দিয়েছিলেন। সেখানে রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, গুমের অভিযোগগুলো ঠিক নয়। নানা কারণে অনেকে স্বেচ্ছায় নিরুদ্দেশ হয়। কিছুদিন পর আবার ফিরে আসে। ঢালাওভাবে অভিযোগ করার উদ্দেশ্য র্যাবের মতো একটি দক্ষ বাহিনীর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে হেয় করা।
জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি তো সরকারের ভেতরের মানুষ নই; তাই বলতে পারব না আমরা কতটা, কী জবাব দিয়েছিলাম। তবে বিশ্বাসযোগ্য ও যথোপযুক্ত জবাব দিলে নিষেধাজ্ঞার মতো ঘটনা তো ঘটার কথা নয়।’ তিনি আরো বলেন, গুরুত্ব পেতে হলে বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য, বস্তুনিষ্ঠ হতে হবে।-অনলাইন ডেস্ক