প্রতিনিধি ১৮ ডিসেম্বর ২০২১ , ৬:৪৮:৩৭ প্রিন্ট সংস্করণ
(দিনাজপুর২৪.কম) আরবি শুধু একটি ভাষা নয়, এটি ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম বাহক। কালের বিবর্তনে বর্তমান পৃথিবীতে প্রচলিত অনেক ভাষা হারিয়ে যেতে পারে। কোরআনের বাহক হিসেবে আরবি ভাষা কিয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবে। কেননা মহান আল্লাহ কোরআন সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমিই কোরআন অবতীর্ণ করেছি, আমিই এটি সংরক্ষণ করব।’ (সুরা : হিজর, আয়াত : ৯)
বাংলাদেশের মতো অনারব দেশগুলোর জন্য আরবি ভাষা শিক্ষা ইসলামী শিক্ষারই নামান্তর। মানুষ যত বেশি এ ভাষার কাছাকাছি আসবে ততই ইসলামকে জানবে ও বুঝবে। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, ‘তোমরা আরবি ভাষা শেখো, কেননা এটি তোমাদের দ্বিনেরই অংশ।’
সিরাতে আরবি ভাষা শেখার অনুপ্রেরণা : রাসুল (সা.)-এর পবিত্র সিরাত অধ্যয়ন করলে আরবি ভাষা শিক্ষা ও এর প্রচার-প্রসারের কিছু পদ্ধতি ও দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। তা হলো—
ক. আরবি ভাষার প্রতি ভালোবাসা : স্বভাবগতভাবে মানুষ যা ভালোবাসে তা সহজে গ্রহণ করে এবং চর্চা করে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা আরবদের ভালোবাসো। কেননা আমার ভাষা আরবি, কোরআনের ভাষা আরবি এবং জান্নাতবাসীদের ভাষা আরবি।’ (মুসতাদরাকে হাকিম)
সুতরাং আরবি ভাষার গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও মর্যাদা তুলে ধরার মাধ্যমে এ ভাষার প্রতি ভালবাসা তৈরি করতে হবে। তদুপরি ভাষাশিক্ষার আধুনিক, আকর্ষণীয় ও সহজতম পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মন থেকে আরবিভীতি দুর করতে হবে।
খ. আরবি ভাষা শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করা : শিশুরা সাধারণত দুই বছর বয়স থেকে ছয় বছর বয়সের মধ্যে মাতৃভাষা রপ্ত করে ফেলে। যদি এ সময় তাকে বিশুদ্ধ ভাষার পরিবেশ দেওয়া হয় তবে সে সহজেই বিশুদ্ধ ভাষা শেখে। রাসুল (সা.)-এর শৈশবের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়টি কেটেছিল তায়েফের বনু সাদ গোত্রের হালিমার ঘরে। একাদশ শতাব্দীর বিশিষ্ট আরবি ভাষাতাত্ত্বিক সালবি বলেন, ‘আরবের মধ্যে বনু সাদ গোত্রের ভাষা ছিল সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল।’ পাশাপাশি সহজ-সরল, প্রকৃতিঘনিষ্ঠ ও মূল্যবোধসম্পন্ন উন্নত গ্রামীণ জীবনশৈলীর জন্যও এই গোত্রটি প্রসিদ্ধ ছিল। (আবুল হাসান আলী নদভী, আস সিরাতুন নববিয়্যাহ)
বিশুদ্ধ ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে বনু সাদ গোত্রের পরিবেশের প্রভাব স্বীকার করে রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি আরবদের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধভাষী। কেননা আমি জন্মেছি কুরাইশ বংশে আর আমার শৈশব কেটেছে বনু সাদ বিন বকর গোত্রে।’ (ইমাম বাগাভি, শরহুস সুন্নাহ)
অন্য এক বর্ণনায় রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি নবী; এতে মিথ্যার লেশমাত্র নেই। আমি আব্দুল মুত্তালিবের সন্তান, আমি আরবদের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধভাষী, কুরাইশ আমাকে জন্ম দিয়েছে, আমি শৈশব কাটিয়েছি বনু সাদ বিন বকর গোত্রে, আমার ভাষায় ভুল হবে কিভাবে!’ (তাবরানি, আল মুজামুল কবির)।
সুতরাং আরবি ভাষা শিক্ষার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির কোন বিকল্প নেই। মাতৃভাষার মতো যে কোন বিদেশী ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রেও এ পদ্ধতিই সবচেয়ে বেশী কার্যকর। মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান, যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষাপোকরণের সমস্বয়েই একটি উপযুক্ত পরিবেশ তৈরী হয়। আমাদেরকে আরবি ব্যাকরণভিত্তিক পদ্ধতি ছেড়ে পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে স্বতস্ফুর্তভাবে ভাষা শিক্ষার পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।
গ. আরবি কবিতাচর্চা : যেকোনো ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ভাষার বিখ্যাত লেখকদের সাহিত্য পড়া, চর্চা করা ও মুখস্থ করার গুরুত্ব অপরিসীম। রাসুল (সা.)-এর পবিত্র সিরাতে এ বিষয়ে চমৎকার নির্দেশনা পাওয়া যায়। যদিও পরবর্তী আরবি সাহিত্যের ইতিহাস প্রণেতারা জাহেলি ও ইসলামের প্রাথমিক যুগের কিছু বক্তৃতা, লোকমুখে প্রচলিত কিছু প্রবাদ-প্রবচন ও ওসিয়তনামাকে প্রাচীন আরবি গদ্যের নমুনা হিসেবে চিহ্ণিত করেছে। তবে কবিতাই যে তৎকালীন আরবি সাহিত্যের প্রধানতম বাহন ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই।
তাই কবিতাকে আরব সমাজের দর্পন বলা হয়। সে সময় আরবি সাহিত্য বলতে শুধু কবিতাকেই বোঝানো হতো। কোরআনের ভাষা বোঝার জন্য আরবি কবিতা শেখার প্রতি গুরুত্বারোপ করে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যদি তোমাদের কাছে কোরআনের কিছু (শব্দের অর্থ) অস্পষ্ট মনে হয়ে তবে তা কবিতায় অনুসন্ধান কোরো। কেননা কবিতা আরবদের (ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ভাষা সংস্কৃতির) দিওয়ান বা আকরগ্রন্থ।’ (মুসতাদরাক হাকিম)
রাসুল (সা.) নিজে কবিতা চর্চা না করলেও সাহাবিদের মধ্যে যারা কবিতা চর্চা করতেন তাদের উৎসাহিত করতেন এবং সেই সময়ের বিখ্যাত কবিদের কবিতার শ্লোক আবৃতি করতেন। শামায়েলে তিরমিজিতে বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘আরব কবিদের বলা সবচেয়ে সুন্দর কবিতা হচ্ছে কবি লবিদের এ পংক্তিটি ‘আল্লাহ ছাড়া সবকিছুই মিথ্যা ও বাতিল, সৃষ্টিজগতের সবকিছুই নি:সন্দেহে হবে বিলীন।’।
একবার রাসুল (সা.) এর এক আঙ্গুল মোবারকে আঘাত পেয়ে রক্ত ঝরছিলো, তখন তিনি একটি আরবি কবিতার এ শ্লোকটি আবৃত্তি করেন- ‘তুমি তো একটি আঙ্গুলমাত্র, রক্তাক্ত হয়েছো, তুমি যে আঘাত পেয়েছো তা তো আল্লাহ পথেই’ (শামায়েলে তিরমিজি)।
একবার এক বেদুইনের অলঙ্কারপূর্ণ কথায় মুগ্ধ হয়ে রাসুল (সা.) বলেন, ‘কিছু কথায় যাদু আছে, কিছু কবিতায় আছে প্রজ্ঞা।’
এ ছাড়াও রাসুল (সা.) এর মজলিশে অনেক সাহাবী কবিতা আবৃত্তি করতেন। তিনি তা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। অনেককে পুরষ্কৃত করতেন। অনেককে উৎসাহিত করতেন। হযরত হাসসান বিন সাবিত (রা.) কে ‘রাসুলের কবি’ বলা হতো। তিনি তার শাণিত কবিতার মাধ্যমে কাফেরদের তীর্যক কথামালা ও ব্যাঙ্গাত্নক কবিতার উপযুক্ত জবাব দিতেন। রাসুল (সা.) তাকে উৎসাহ দিয়ে বলতেন,‘তুমি আমার পক্ষ থেকে তাদের কথার জবাব দাও। হে আল্লাহ! তুমি তাকে জিবরাইলের মাধ্যমে সাহায্য কর’ (মুসনাদে ইমাম আহমদ)।
একবার এক বেদুইনের অলংকারপূর্ণ কথায় মুগ্ধ হয়ে রাসুল (সা.) বলেন, ‘কিছু কথায় জাদু আছে, কিছু কবিতায় আছে প্রজ্ঞা।’
ঘ. বিশুদ্ধ আরবি ভাষাচর্চায় মনোযোগী হওয়া : রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি আরবদের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধভাষী, কুরাইশ আমাকে জন্ম দিয়েছে, আমি শৈশব কাটিয়েছি বনু সাদ বিন বকর গোত্রে, আমার ভাষায় ভুল হবে কিভাবে!’ (তাবরানি, আল মুজামুল কাবির)
এ হাদিস থেকে প্রতীয়মান হয় রাসুল (সা.) ভাষার বিশুদ্ধতার প্রতি কতটা যত্নশীল ছিলেন। এ ছাড়া ‘মুসনাদুশ শিহাব’ গ্রন্থে বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.) তাঁর চাচা আব্বাস বিন আবদুল মুত্তালিবের বিশুদ্ধ ভাষার প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘পুরুষের সৌন্দর্য হচ্ছে তার ভাষার বিশুদ্ধতা।’
বিশুদ্ধ আরবি ভাষা শিক্ষার জন্যই আরবি ব্যাকরণশাস্ত্র তথা নাহু ও সরফের উৎপত্তি হয়েছিল। আরবি ভাষার সৌন্দর্যচর্চার জন্যই সৃষ্টি হয়েছিল আরবি অলংকারশাস্ত্র বা ইলমুল বালাগাহ। সুতরাং আরবি ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশুদ্ধতার চর্চাও রাসুল (সা.)-এর অন্যতম শিক্ষা।
লেখক : প্রভাষক, আরবি বিভাগ, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা