• Top News

    গণসংক্রমণের পথে ওমিক্রন

      প্রতিনিধি ৪ জানুয়ারি ২০২২ , ৩:৫০:১৭ প্রিন্ট সংস্করণ

    (দিনাজপুর২৪.কম) দেশে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের ক্লাস্টার বা গুচ্ছ সংক্রমণ চলছে। করোনার সংক্রমণ এখনো ঊর্ধ্বমুখী। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে রোগী ৪৮ শতাংশ ও মৃত্যু ৪১ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে এ মাসের শেষ থেকে আগামী মধ্য ফেব্রুয়ারির মধ্যে করোনা সংক্রমণ ব্যাপক হারে বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি এখন যে ঊর্ধ্বগতি তাতে ওমিক্রনের গণসংক্রমণ বা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন পরিস্থিতি ছুঁই ছুঁই। আগামী সপ্তাহ নাগাদ দেশে ওমিক্রনের গণসংক্রমণ দেখা যেতে পারে।

    করোনা সংক্রমণ ও ওমিক্রন সম্পর্কে এমন তথ্য জানিয়ে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) দুই বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, আগামী মধ্য ফেব্রুয়ারির মধ্যেই সংক্রমণ যেমন বাড়তে পারে, তেমনি ওমিক্রন ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি আগামী মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত করোনার এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা অব্যাহত থাকবে। এরপর কিছুদিন স্থিতিশীল থাকার পর সংক্রমণ ধীরে ধীরে কমতে পারে।

    এর জন্য বিশেষজ্ঞরা সবাইকে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও করোনা টিকার দুই ডোজ ও তৃতীয় ডোজ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

    গত নভেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন শনাক্ত হওয়ার পর থেকে পুরো বিশ্বেই আবার সংক্রমণ বাড়ছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্তত ১০৬টি দেশে পৌঁছে গেছে ওমিক্রন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে এ ধরনটিরই প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে এখন। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১০ জনের মধ্যে ওমিক্রনের সংক্রমণের তথ্য পাওয়া গেছে। আক্রান্তরা ইউরোপ-আমেরিকা ও জিম্বাবুয়ে ফেরত এবং তাদের সংস্পর্শে যাওয়া।

    এমন অবস্থায় গতকাল সোমবার দেশে করোনা সংক্রমণ আরও বেড়েছে। টানা তিন মাস পর সর্বোচ্চ ৬৭৪ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে এবং নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে দৈনিক শনাক্তের হার আবার ৩ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এ সময় মারা গেছে আরও চারজন। এর আগে এক দিনে এর চেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছিল সর্বশেষ গত ৬ অক্টোবর ৭০৩ জন।

    করোনার সংক্রমণে ঊর্ধ্বগতি এবং দেশে ইতিমধ্যেই ১০ জন ওমিক্রন আক্রান্ত রোগী পাওয়ার প্রেক্ষাপটে গতকাল সন্ধ্যায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়। সেখানে আগের কিছু বিধিনিষেধের পাশাপাশি নতুন করে বেশ কিছু নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এসব সিদ্ধান্ত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে বিজ্ঞপ্তি জারি হবে।

    এমনকি সরকার করোনা টিকার বুস্টার ডোজের শর্ত শিথিল করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গতকাল এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইইডিসিআর জানায়, এখন দেশের সব টিকাদান কেন্দ্রে করোনার টিকা দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি বুস্টার ডোজ নেওয়ার বয়স কমিয়ে ৬০ বছর থেকে প্রথমে ৫৫ ও পরে ৫০ বছরে নামিয়ে আনা হবে।

    এর আগে গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আগামী মার্চ-এপ্রিলে করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট দেশে বড় ধরনের সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এ কারণে আমরা সারা দেশের হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা জোরদারের জন্য কাজ করছি।’

    গত বছর জুন-জুলাইয়ে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছলে চাহিদার তুলনায় অক্সিজেনের সরবরাহ কম ছিল উল্লেখ করে মহাপরিচালক আরও বলেন, ‘বর্তমানে ৪০টি হাসপাতালে অক্সিজেন জেনারেটর স্থাপনের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আমরা এই ৪০টি ছাড়াও বিভিন্ন উৎস থেকে আরও কিছু অক্সিজেন জেনারেটর স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছি।’

    ওমিক্রনের গণসংক্রমণ পরিস্থিতি ছুঁই ছুঁই : আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এখনো বাংলাদেশে ওমিক্রন ক্লাস্টার বা গুচ্ছ সংক্রমণ পর্যায়ে রয়েছে। শনাক্তের হার ৫ শতাংশ পার হয়ে গেলে বলা যাবে গণসংক্রমণ বা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন। এখন ঢাকা শহরে ওমিক্রনের ক্লাস্টার সংক্রমণ হচ্ছে। কারণ এখন ওমিক্রনে আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীই ঢাকা শহরের। ঢাকায় ওমিক্রন সংক্রমণ হচ্ছে।’

    এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘করোনা শনাক্ত রোগী যদি দুই-তিন দিনে দ্বিগুণ হয়, তাহলে বুঝতে হবে গণসংক্রমণ হচ্ছে। এখনো যদিও সেরকম হয়নি, কিন্তু গণসংক্রমণ পরিস্থিতি ছুঁই ছুঁই। আগামী সপ্তাহ নাগাদ সেটা হয়ে যেতে পারে।’

    এ ব্যাপারে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, ‘দেশে এখনো ওমিক্রন তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু আগামী তিন-ছয় সপ্তাহের মধ্যে ব্যাপকহারে ওমিক্রনের সংক্রমণ আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ এ ধরন দ্রুত সংক্রমণশীল, একজন থেকে আরেকজনে দ্রুত ছড়ায়। সেহেতু রোগীর সংখ্যা বাড়বে। কিন্তু সিভিয়ারিটি কম বলে হাসপাতালে তেমন রোগী আসবে না। তবে সতর্ক থাকতে হবে বয়স্ক মানুষ, যাদের কো-মর্বিডিটি আছে, তাদের জন্য যেকোনো ভাইরাস মারাত্মক। তারা বিপদে পড়ে যেতে পারে। এজন্য কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। আতঙ্কিত না হয়ে সাবধানে থাকতে হবে।’

    তিনি বলেন, ‘এখনো বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণের অধিকাংশই ডেল্টার কারণে হচ্ছে। রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সেটা অল্প কিছু ওমিক্রন, বেশিরভাগই ডেল্টা ধরন। ডেল্টার ধরনের কারণেই কোথাও কোথাও হাসপাতালে রোগী ভর্তির সংখ্যা বেড়েছে। ওমিক্রন হলে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা বাড়ত না।’

    অবশ্য এখনো দেশে ওমিক্রনের গুচ্ছ সংক্রমণ হয়নি বলে মত দিয়েছেন ডা. আলমগীর। তিনি বলেন, ‘যে ১০টা কেস পাওয়া গেছে, তা দিয়ে ক্লাস্টার ট্রান্সমিশন বলা ঠিক না। এখনো আমরা শনাক্ত করতে পারছি। এখনো পরিবারভিত্তিক সংক্রমণ হচ্ছে। এখনো ক্লাস্টার হয়নি আসলে।’

    মধ্য ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সংক্রমণ আরও বাড়ার আশঙ্কা : এ ব্যাপারে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এখন সংক্রমণ বাড়তেই থাকবে। বাড়তে বাড়তে যখন ক্লাস্টারগুলো এক হয়ে যাবে, তখন জ্যামিতিক হারে বাড়ার আশঙ্কা থাকবে। জানুয়ারির শেষ দিক থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের দিকে বাড়ার আশঙ্কা আছে এবং এই বৃদ্ধি মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। কিন্তু ওমিক্রনের কারণে যদি রোগী বেড়ে যায়, তাহলে জানুয়ারির শেষের দিকে রোগী অনেক বেড়ে যাবে।’

    এ প্রসঙ্গে ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, ‘আগামী দুই থেকে ছয় সপ্তাহের ভেতরে সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। সাধারণত সংক্রমণ হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে একটা সহনশীল অবস্থায় আছে বলা যায়। সেটা কিছুদিন ছিল এবং ২ শতাংশের নিচেই ছিল। কিন্তু যেভাবে বাড়ছে, তাতে আরও এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে আবার সংক্রমণ ৫ শতাংশের ওপরে চলে যাবে।’

    জিনোম সিকোয়েন্স নিয়ে সন্তুষ্ট আইইডিসিআর : ওমিক্রন পরিস্থিতি বুঝতে এবং নিয়ন্ত্রণে করোনার পজিটিভ নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স বাড়াতে তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ডা. মুশতাক বলেন, ‘করোনা শনাক্তদের নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স বাড়াতে হবে। এখন বোঝা যাচ্ছে রোগী যেভাবে বাড়ছে সেটা ওমিক্রনের কারণেই হচ্ছে। কারণ জিনোম সিকোয়েন্স যতুটুকু হচ্ছে তা থেকেই বোঝা যাচ্ছে ঢাকা শহরে প্রবাসীদের মধ্যেই ওমিক্রন সীমাবদ্ধ নেই, তাদের পরিবার-পরিজনের মধ্যেও সংক্রমণ হচ্ছে। এরপর এসব পরিবার-পরিজন থেকে এলাকার অন্যরা সংক্রমিত হবে। একসময় দেখা যাবে সামাজিক সংক্রমণ ঘটে গেছে। তবে বর্তমানে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিই নির্দেশ করে এটা ওমিক্রন জড়িত। যেহেতু দেশে ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে। সেটা না হলে বুঝতাম ডেল্টা বা আগের পুরনো ধরনের কারণেই হচ্ছে।’

    তবে বর্তমানে জিনোম সিকোয়েন্স ভালো হচ্ছে বলে জানিয়ে ডা. আলমগীর বলেন, ‘জিনোম সিকোয়েন্স ভালোই হচ্ছে। মাসে আমরা ২০০ সিকোয়েন্স করতে পারি। সক্ষমতা আরও বাড়ছে। কিছু নিয়মকানুন আছে। আমরা যে পিসিআর পরীক্ষা করি, সেখান থেকেও কিছু নির্দেশিকা পাই। আমরা এখন পিসিআর ও সিকোয়েন্স দুভাবেই জিনোম দেখছি। সারা দেশ থেকে প্রতিনিধিত্বমূলক নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। দেশের ১০টা সাইট থেকে নমুনা নিয়ে আমাদের কাছে পজিটিভ নমুনা পাঠানো হয়। বিভিন্ন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জিনোম সিকোয়েন্স করছে। তারা পেলে গ্লোবাল জিআইএসএআইডি সাইটে আপলোড করবে। প্রতিষ্ঠানগুলো সংবাদ সম্মেলন করেও জানায়। তারাও পাচ্ছে না। এ পর্যন্ত যে কেসগুলো পাওয়া গেছে, সেটা আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআর,বি যৌথভাবে জিনোম সিকোয়েন্স করছে। আই-দেশি, চাইল্ড হেলথ রিসার্চ সেন্টারসহ বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত কনসোর্টিয়াম করে আমরা জিনোম সিকোয়েন্স করছি।’

    ওমিক্রন ঠেকাতে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ : ওমিক্রন ধরন ও করোনা নিয়ন্ত্রণে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এর জন্য তারা স্বাস্থ্যবিধি মানা, করোনার টিকা নেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন। এ ব্যাপারে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘জিনোম সিকোয়েন্স শনাক্ত পদ্ধতি। কিন্তু সংক্রমণ কমাতে হবে আমাদের আগের সব পদ্ধতিই কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।’

    দেশে হঠাৎ করোনার সংক্রমণ বাড়ার কারণ হিসেবে ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, ‘গত ১৪-১৫ দিন ধরে পর্যটন কেন্দ্রে ব্যাপক ভিড় হয়েছে, প্রচুর বিয়ে হচ্ছে, ইনডোরের অনুষ্ঠানগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। অথচ এটা স্বীকৃত যে ইনডোর থেকে ব্যাপক সংক্রমণ ছড়ায়। এগুলো বন্ধ করতে হবে। এগুলো যত কম করা যায়, তত সংক্রমণ কমবে।’

    ওমিক্রন ও করোনা নিয়ন্ত্রণে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘টিকার সুযোগ থাকলে টিকা নিতে হবে। বুস্টার ডোজের এসএমএস এলে টিকা নিতে হবে। সারা দেশে টিকা কার্যক্রম হচ্ছে। প্রতিটি ইউনিয়নে কোনো না কোনো জায়গায় এখন টিকা দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং বাড়ির পাশে টিকা কেন্দ্র আছে। সেখান থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র, অথবা জন্মনিবন্ধন সনদ, অথবা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা মেম্বারের ১৮ বছরের একটা প্রমাণপত্র নিয়ে এলে টিকা দিয়ে দেওয়া হবে। বুস্টার ডোজের বয়স পর্যায়ক্রমে কমানো হবে। প্রথমে ৫৫ বছর হবে, তারপর ৫০ করা হবে। ফ্রন্টলাইনরা বয়স ছাড়াই টিকা পাচ্ছেন এখন।’ -অনলাইন ডেস্ক

    মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়।

    আরও খবর

    Sponsered content