প্রতিনিধি ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ , ১১:৪৩:৫৫ প্রিন্ট সংস্করণ
(দিনাজপুর২৪.কম) পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠনে করা নতুন আইনের আওতায় সার্চ কমিটি গঠন করেছেন প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ। শনিবার এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের কমিটিতে অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ ছহুল হোসাইনকে সদস্য হিসেবে প্রেসিডেন্ট মনোনয়ন দিয়েছেন। আইন অনুযায়ী বিচারপতি কুদ্দুস জামান, পিএসসি চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন ও মহাহিসাব নিয়ন্ত্রক ও নিরীক্ষক মুসলিম চৌধুরী কমিটির সদস্য হয়েছেন। ওবায়দুল হাসান আপিল বিভাগে দুই বছর ধরে বিচারকের দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে যে সার্চ কমিটি করা হয়েছিল ওই কমিটির সদস্য ছিলেন ওবায়দুল হাসান। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকের দায়িত্ব পালন করা ওবায়দুল হাসান ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন।
সার্চ কমিটি গঠনের পর প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র তরফে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়া হয়নি।
এই সার্চ কমিটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে উপযুক্তদের বাছাই করবে। তা থেকে ১০ জনের নাম প্রেসিডেন্টের কাছে প্রস্তাব করবে। তাদের মধ্য থেকে অনধিক পাঁচজনকে সিইসি ও ইসি হিসেবে নিয়োগ দেবেন প্রেসিডেন্ট।
আইনে সার্চ কমিটিকে সময় দেওয়া হয়েছে ১৫ দিন। তবে আগামী ১৪ই ফেব্রুয়ারি কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন ইসি বিদায় নেবে বলে তার আগেই নাম সুপারিশের জন্য সার্চ কমিটির হাতে সময় আছে ১০ দিন।
কমিটিতে দায়িত্ব পাওয়া বিচারপতি কুদ্দুস জামান চার বছর ধরে হাইকোর্ট বিভাগে বিচারকের দায়িত্ব পালন করছেন। রাজবাড়ীতে জন্ম নেওয়া কুদ্দুস জামান ১৯৮৪ সালে জুডিশিয়াল সার্ভিসে যোগ দেন। ২০০৬ সালে জেলা জজ হন। সুপ্রিম কোর্টে রেজিস্ট্রারের দায়িত্বও পালন করেন তিনি।
২০১৫ সালে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ হন কুদ্দুস জামান। ২০১৮ সালে হাইকোর্টে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিভাগের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী।
মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন ২০০৭-২০১২ সালে নির্বাচন কমিশনারেরর দায়িত্ব পালন করেন। জরুরি অবস্থার সময় দায়িত্ব নেয়া সে কমিশনই সিইসি ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে আইন করার প্রথম খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিলেন। সিলেটের সন্তান ছহুল হোসাইন জেলা জজ হিসেবে দেশের বিভিন্ন জেলায় দায়িত্ব পালন করেন। পরে আইন সচিবও হয়েছিলেন তিনি। অবসর নেয়ার পর তিনি নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। একাদশ সংসদ সংসদের সময় তার নামে সিলেট-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র সংগ্রহও করেছিলেন তিনি।
আনোয়ারা সৈয়দ হক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুপরিচিত। লেখক হিসেবেও তিনি ব্যাপক পরিচিত। তার স্বামী প্রয়াত সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক। ১৯৪০ সালে যশোর জেলায় জন্ম নেওয়া আনোয়ারা সৈয়দ হক পড়াশুনা করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে এবং লন্ডনের এম আর সাইক-এ। তিনি কিছুকাল বিমানবাহিনীতে চিকিৎসক হিসেবে ছিলেন। আনোয়ারা সৈয়দ হক ২০১০ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। ২০১৯ সালে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে সরকার।
৬১ বছর বয়সী সোহরাব হোসাইন সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে। ১৯৮৪ ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের এ কর্মকর্তা সবশেষ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব ছিলেন। অবসরোত্তর ছুটিতে যান ২০১৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বরে।
নোয়াখালীর সন্তান সোহরাব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী।
মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী ২০১৮ সালের ১৫ই জুলাই থেকে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের দায়িত্বে রয়েছেন। তার আগে অর্থ সচিব পদে ছিলেন তিনি। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের অডিট অ্যান্ড একাউন্টস ক্যাডারে যোগ দিয়ে কন্ট্রোলার জেনারেল অব একাউন্টস, কন্ট্রোলার জেনারেল ডিফেন্স ফাইন্যান্স এবং অর্থ বিভাগের উপসচিব, যুগ্মসচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে দায়িত্ব পালন করেন মুসলিম চৌধুরী। চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া মুসলিম চৌধুরী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটি থেকে ফিন্যান্স অ্যান্ড একাউন্টিংয়ে ডিসটিংশনসহ এমএসসি ডিগ্রি নেন।
শিগগিরই কাজ শুরু হবে: ওবায়দুল হাসান: সার্চ কমিটির সভাপতি বিচারপতি ওবায়দুল হাসান জানিয়েছেন শিগগিরই কমিটি কাজ শুরু করবে। তিনি জানিয়েছেন, মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সঙ্গে কথা বলে তারা কাজ শুরু করবেন। রোববারই কমিটির প্রথম বৈঠক হতে পারে বলে কমিটি সূত্র জানিয়েছে। আগের কমিটি সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে সভা করেছিল। এবারও একই স্থানে বৈঠক হতে পারে।
কেমন হলো সার্চ কমিটি- এ প্রশ্নে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, সার্চ কমিটির চারজন পূর্ব-নির্ধারিত আর দু’জন সর্বজন পরিচিত। এই ছয়নের টিম ইচ্ছা করলে এবং তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করলে উপযুক্ত ব্যক্তি খুঁজে বের করতে পারবে। যেহেতু এটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটা দায়িত্ব। আর যাদের ওপর এই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আশা করছি তারা অনেক বেশি নিষ্ঠার সঙ্গে কাজটা করবেন। তবে তাদের অনেক সীমাবদ্ধতা ও চাপের মধ্যে কাজ করতে হবে। অনেকেই হয়তো এখন তদবিরে লেগে গেছেন কমিশনে মানুষ ঢুকানোর। এটা রাজনৈতিক বা অন্যভাবেও হতে পারে। লবিং তদবির করে যে নামগুলো আসবে সেগুলোকে যেন তারা প্রথমেই ডিসকুয়ালিফাই করেন। তদবির নিরুৎসাহিত করতে হবে। এখানে তদবিরের মানুষ আনা যাবে না।
তিনি বলেন, কমিটির সদস্যদের প্রথমে ঠিক করতে হবে তারা কোন পথে যাবেন। তাদের মেথডটা কী। মেথটটা তারা জাতির কাছে পরিষ্কার করবেন। তারপর তারা ঠিক করবেন কাকে নিচ্ছেন কেন নিচ্ছেন। অন্তত ১০ জনের একটা তালিকা করে গোপনে তাদের ইন্টারভিউ করতে পারেন। যাদেরকে সিলেকশন করা হবে তাদেরকে কেন সিলেকশন করা হলো তার একটা যৌক্তিকতা দাঁড় করাতে হবে।
নির্বাচন কমিশনার সিভিল সার্ভিস, মিলিটারি সার্ভিস, বিচার বিভাগ ও নারী থেকে হতে হবে এই ছক থেকে বের হওয়া উচিত। ছক মাথায় রাখলে সীমাবদ্ধতায় পড়তে হবে। এখান থেকে বের হয়ে এই সংকটময় মুহূর্তে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে হবে নির্ভীক, ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ব্যক্তি কারা। যারা জাতিকে একটি নির্দেশনা দিতে পারেন। রাজনৈতিক দলগুলোকে কমান্ড দিতে পারবেন। সকল দলসহ সরকারকে তাদের কথা শুনাতে পারবেন। প্রশাসনকে আইনগতভাবে কাজ করাতে বাধ্য করতে পারবেন। কাজ করতে না পারলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবেন। এ রকম ব্যক্তিত্ব খুঁজে বের করতে হবে। তোফায়েল আহমেদ বলেন, কমিটিতে মিলিটারি পার্সনদের প্রয়োজন নাই। কারণ এখানে সেনাবাহিনী তলবও হচ্ছে না তারা মাঠে কাজও করছেন না। প্রয়োজন হলে তারা সাংবাবিধানিক দায়িত্ব পালন করবেন। জুডিশিয়ারি সমস্যা হলে সেটা জুডিশিয়ারিতে রেফার্ড হবে। জুডিশিয়ারির লোকজন আগে থেকে নিয়ে রাখারও প্রয়োজন নাই।
তিনি বলেন, বেশির ভাগ সিভিল সার্ভিসের কমকর্তা উপরের আদেশ মেনে কাজ করেন। এটা তাদের প্রশিক্ষণের অংশ এবং অভ্যাসগত বিষয়। কিন্তু নির্বাচন কমিশনে কোনো উপর মহল নাই। এখানে সংবিধান এবং বিবেক দিয়ে কাজ করতে হবে। প্রয়োজনে কমিশনের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেবেন। এছাড়া তাদের আরেকটা দক্ষতা থাকতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নেগোশিয়েশন করা। জনগণ ও গণমাধ্যমকে বোঝানোর। উপরের নির্দেশ মেনে কাজ করার অভ্যাস এখানে কোনো কাজে লাগবে না। বরং উপরের নির্দেশ অমান্য করে সাংবিধানিকভাবে কাজ করার সাহস দেখাতে হবে।
তিনি আরও বলেন, কমিশনে একজন নারী রাখতে হবে এটা কোনো কন্ডিশন হতে পারে না। দেশের অর্ধেক ভোটার নারী। সে হিসাব করলে কমিশনের অর্ধেক সদস্য নারী হওয়া উচিত। একজনের স্থলে দু’জনও হতে পারে। কিন্তু এখানে মূল কথা হলো যোগ্যতা। নারী হোক আর পুরুষ হোক আগে যোগ্য ব্যক্তি খুঁজে বের করতে হবে। তারপর পেশার চিন্তা করতে হবে। তবে পদ্ধতিটা স্বচ্ছ হতে হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, তারা যদি স্বচ্ছতার সঙ্গে অনুসন্ধান করে সঠিক ব্যক্তিদের নিয়োগ দেন তবেই এটি ভালো সার্র্চ কমিটি হয়েছে বলা যাবে। আগেতো অনুসন্ধান কমিটি পোস্ট অফিসের মতো ভূমিকা পালন করে। সরকার যে নামগুলো তাদের কাছে দিয়েছে সেখান থেকে তারা সুপারিশ করেছে। এই কমিটি যদি সে রকম হয় তাহলে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অপকর্মের জন্য ও নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার ওপর জনগণের যে আস্থাহীনতার সংকট সেটি দূরীভূত হবে না। বরং আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। আমরা আরও সংকটের দিকে চলে যাবো।
সার্চ কমিটি গঠন নিয়ে তিনি বলেন- আইন ত্রুটিপূর্ণ। যে পদ থেকে তাদের নেয়া হয়েছে তারা সরকারের অনুগ্রহপ্রাপ্ত বা ভবিষ্যতে অনুগ্রহ পেতে পারেন। অনুসন্ধান কমিটির গঠনই সঠিক না। আমরা চেয়েছিলাম এমপি, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, বিরোধী দলের প্রতিনিধি, তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধি দিয়ে। যারা রাষ্ট্রপতি দ্বারা সুপারিশকৃত হবেন না। এছাড়া একজন সাংবিধানিক পদের ও একজন সাবেক বিচারপতি রাখার। কারণ বর্তমান বিচারপতিদের সিদ্ধান্তকে কিছু বিষয়ে প্রভাহিত করতে পারে। তবে আমরা আশা করবো এই কমিটি স্বচ্ছতার সঙ্গে সত্যিকারের অনুসন্ধান করে সঠিক ব্যক্তিদের খুঁজে বের করবে। যাতে নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে আমাদের আস্থাহীনতা দূর হয়। -সূত্র : মানব জমিন