প্রতিনিধি ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২ , ১২:১০:৫৬ প্রিন্ট সংস্করণ
(দিনাজপুর২৪.কম) আমার বাড়ি সদর উপজেলা, দিনাজপুরে। একাধিকবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ‘আমি বিসিএস পাশ বেকার’ লেখা ফেস্টুন বুকে নিয়ে দাঁড়িয়েছি। দাঁড়ানোর কারণ হচ্ছে সাধারণ মানুষের ধারণা কেউ বিসিএস পাস করলেই চাকরি পেয়ে যায়। এ ধারণা পুরোপুরি সত্য নয়। এটা প্রচার করাই আমার মূল উদ্দেশ্য।
এখানে দাঁড়ানোর আগে আমার ভেতরও দ্বিধা সংকোচ কাজ করেছে। আমি কি দাঁড়াব? আমি কী বলব? মানুষ আমাকে দেখে কী ভাববে? আমরা আমাদের আত্মার সঙ্গে লড়াই করে পেরে উঠি না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি পেরেছি এবং আমার কথা জানানোর জন্য প্রেস ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়েছি।
আমি ছিলাম ৩৪তম বিসিএসের প্রার্থী। আমার একটা আশা ছিল প্রিলিমিনারি, লিখিত ও ভাইভা দিয়ে যারা বিসিএস পাস করেছে তাদের নিয়োগটা হয়তো পর্যায়ক্রমে দিয়ে দেবে সরকার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হলো না। আমি যে ফেস্টুন গলায় ঝুলিয়েছি সেখানে লেখা আছে ‘বিসিএস পাশ বেকার। বিসিএস পাশ করেও কেন চাকরি মেলে না, তোমার কাছে বিচার দিলাম বঙ্গবন্ধুর মা।’
বিসিএস পাস করার পরও আমার চাকরি না হওয়ার জন্য আমি পিএসসিকে দায়ী করি। পিএসসির যদি সুপারিশ করার জায়গা না থাকে তাহলে প্রিলিমিনারি, লিখিত বা ভাইভা যেকোনো পর্যায়ে আমাকে বাদ দিতে পারত। ধাপে ধাপে পাস করানোর পর আমাকে ভাইভাতেও পাস করানো হলো। অথচ আমাকে চাকরির জন্য সুপারিশ করল না। এ প্রহসনের তো কোনো অর্থ হয় না।
এখন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়োগ এনটিআরসিএ (বেসরকারি শিক্ষণ নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ) দেয়। পূর্বে এ নিয়োগ স্কুল-কলেজের কমিটির হাতে ছিল এবং প্রত্যেকটা নিয়োগ আনফেয়ার (পক্ষাপাতদুষ্ট) হতো। যখন জাতীয়করণ হয় তখন এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের চাকরি রাতারাতি সরকারি হয়ে যায়।
চাকরি না হওয়ার কারণে আমার পরিবারের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। আমার বাবা ব্যবসা করেন। একজন নিরক্ষর লোক হয়েও তিনি সন্তানদের লেখাপড়া করিয়েছেন। তিনি ভালোভাবে লেখাপড়া করার জন্য প্রেরণা জোগাতেন। তিনি খুব আশায় ছিলেন ছেলের একটা ভালো চাকরি হবে। আমার যখন বিসিএস ভাইভার তারিখ হয়েছে তখন তিনি পরিচিতদের ডেকে বলতেন ‘এবার হয়তো ছেলের চাকরিটা হয়ে যাবে।’ যখন হয়নি তখন তিনি খুব আশাহত হয়েছিলেন। একদিন উনি আক্ষেপ করে আমাকে বলেছেন, ‘আমার জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল ছিল তোমাকে পড়াশোনা করানো।’ আমার বাবার এ কষ্ট আমি কখনো ভুলব না। সংসারে আমরা এক ভাই, দুই বোন। সবার বড় আমি।
বিসিএসের পেছনে আমার তিন বছরের বিনিয়োগ। আমি চাকরি করতাম অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ পরিচালিত বিশ^সাহিত্য কেন্দ্রে। আমি যখন বিসিএসে নামলাম তখন সারা দিন পড়াশোনা করতাম। বিসিএস রোল ৩৮৬৫৯ নম্বরটা আমি আমৃত্যু ভুলতে পারব না। সব সাধ-আহ্লাদ জলাঞ্জলি দিয়ে বিসিএসের প্রস্তুতি নিয়েছি। আমি তখন ঢাকার কল্যাণপুরে থাকতাম। সেখান থেকে হেঁটে আগারগাঁও যেতাম। জাতীয় লাইব্রেরিতে আমি অফিস করার মতো পড়াশোনা করতাম। ৯টায় লাইব্রেরিতে প্রবেশ করে বের হতাম ৫টায়। কত যে দুপুর কাটিয়েছি শুধু একটি শিঙ্গারা খেয়ে তা বলে শেষ করতে পারব না। এত কষ্টের পর ধাপে ধাপে সাফল্য এসেছে। কিন্তু চূড়ান্ত সাফল্য অধরাই রইল। প্রিলিমিনারি পাস করলাম সবাই ভালোবাসে। লিখিত দিলাম এবং পাস করলাম, সেই ভালোবাসাটা আরও বাড়ল। ভাইভার সময় তো আমি সবার পছন্দের চূড়ায়। ভাইভাও হলো এবং পাস করলাম। কিন্তু চাকরির সুপারিশ হলো না। আমাকে চূড়া থেকে যেন মাটিতে ফেলে দিল। ভিক্ষুকেরও দাম আছে, কিন্তু আমার নেই।
পিএসসির উচিত যতটা পদ খালি আছে ততজনকেই যেন পাস করায় এবং ততজনকেই যেন নিয়োগ দেয়। পিএসসির নন-ক্যাডার নীতিমালা নিয়ে আমার আপত্তি আছে। ন্যায়বর্জিত নীতি কীভাবে নীতিমালা হয়? নন-ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয় আপনি কী হতে চেয়েছিলেন? বলবেন, আমি ক্যাডার হওয়ার জন্য সব বিসর্জন দিয়েছি! বিসিএস সার্কুলারে নন-ক্যাডার পদ থাকে না। আবেদন ফরমে কোনো চয়েজ অপশনও থাকে না। মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দিলেও পিএসসি বিসিএস নন-ক্যাডারের মেধাক্রম প্রকাশ করে না। যার কোনো যুক্তি নেই।
আমার মতে বিসিএস হতে হবে একেবারেই মৌলিক। ক্যাডার ব্যতীত নন-ক্যাডার থাকবে না। একজন বিসিএস পাস করে হবেন আমলা, কেউ হবেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, কেউ হবেন বেকার! বিসিএস বৈষম্য সৃষ্টি করছে। এ ধরনের বৈষম্য সৃষ্টিকারী নীতিমালা কতটা যৌক্তিক? বিসিএস দিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রার্থী হয়তো আপাতত নন-ক্যাডারে চাকরি পেয়েছেন। কিন্তু ওই ব্যক্তি কখনো স্বস্তিতে থাকেন না। তার মনে হয়, একই প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে তিনি নন-ক্যাডার আর তার নীতিনির্ধারক ক্যাডার কর্মকর্তা। নন-ক্যাডার তুলে দিয়ে বিসিএস নীতিমালা পুনর্গঠন তাই সময়ের দাবি।
আমার চাকরি হবে এ আশা নিয়ে আমি প্রেস ক্লাবের সামনে দাঁড়াইনি। আমার কোনো কর্মসূচি নেই। আমি দিনাজপুর থেকে এখানে আসি। এককভাবেই প্রতিবাদ করে যাই। আমি বিবাহিত। কারও চাকরি হয় না বলে তো বিয়ে হবে না এমন তো নয়। আমার একটা মেয়ে আছে। আমি তাকে অনেক আদর করি। তাকে আমি মা বলে সম্বোধন করি। বঙ্গবন্ধুও হয়তো তার মেয়ে শেখ হাসিনাকে মা বলেই সম্বোধন করতেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিচক্ষণ মানুষ, ভিশনারি নেতা। ব্যানারে লেখা বঙ্গবন্ধুর মা নিয়ে এখানে অনেকেই আপত্তি করতে পারেন। অনেকেই বুঝবেন না, বঙ্গবন্ধুর মা কী। এটা আমার নিজস্ব সম্বোধন। আমি জানি না, আমার এ কথাগুলো প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছাবে কী না। পৌঁছালে তিনি স্মৃতিতাড়িত হবেন। -অনলাইন ডেস্ক
লেখক : আইনজীবী, দিনাজপুর বার অ্যাসোসিয়েশন।