প্রতিনিধি ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ , ১২:১০:১৮ প্রিন্ট সংস্করণ
(দিনাজপুর২৪.কম) বিদায় নিয়েছে কেএম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গতকাল সোমবার ছিল তাদের শেষ কর্মদিবস। পাঁচ বছরের মেয়াদের শেষ দিনে গতকাল চার নির্বাচন কমিশনার ইসিতে গেলেও কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ায় একজন কমিশনার অনুপস্থিত ছিলেন। দায়িত্ব গ্রহণের শুরু থেকেই ইসিতে মতবিরোধ ছিল, মেয়াদজুড়েই এটি বারবার প্রকাশ্যে এসেছে।
বিদায়ের দিনেও সেই মতবিরোধ ছিল প্রকাশ্যে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ (সিইসি) তিন নির্বাচন কমিশনার এদিন সকালে সংবাদ সম্মেলন করেন। তাতে অংশ নেননি নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার।সিইসির সংবাদ সম্মেলন শেষে নিজ অফিসকক্ষে আলাদা করে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। পৃথক সংবাদ সম্মেলনের কারণ জানতে চাইলে মাহবুব তালুকদার বলেন, বিশেষ কোনো কারণ নেই। এখানে মুক্তভাবে কথা বলতে পারছি। সেখানে হয়ত সেটা সম্ভব হতো না।
২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারি দায়িত্ব নিয়েছিল হুদা কমিশন। গতকাল শেষ কর্মদিবসের সকালে আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের লেকভিউ চত্বরে বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনে সিইসি নূরুল হুদা বলেন, সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছি। আমাদের ওপর যে দায়িত্ব ছিল, কঠোর পরিশ্রম করে সেই দায়িত্ব পালন করেছি। গত ৫ বছরে ইসির নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন দুর্বলতা তুলে ধরে সিইসির কাছে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, আত্মীয়স্বজন বা সিভিল সোসাইটিতে গেলে কোনো কারণে বিব্রতবোধ করবেন কিনা? জবাবে সিইসি বলেন, মোটেও না। নির্বাচনে আইনকানুন ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির কোনো অভাব রাখিনি। আমরা নিরপেক্ষ থেকে কাজ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কাজেই কোনো বিব্রতবোধ নেই, কোনো দুর্বলতা নেই। কোনোরকম ঘাটতি নেই।
তিনি আরও বলেন, সর্বোচ্চ নিরপেক্ষ থেকে আইনানুগভাবে সব নির্বাচন শেষ করেছি। রাজনৈতিক দলগুলো সংলাপে এসেছে, সবাইকে সময় দিয়েছি। কিন্তু পরবর্তীতে তারা নির্বাচনে যাবে না, নির্বাচন করবে না, তাই সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারিনি, আস্থা অর্জন করতে পারিনি। ইসির দুর্নীতির বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে ও রাষ্ট্রপতির কাছে বিশিষ্ট নাগরিকদের চিঠির জবাবে সিইসি বলেন, অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। অডিট আপত্তির বিষয় এসেছে। দেশের প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে ভুলে বা নিয়মকানুনের ভুল ব্যাখ্যায় কিংবা ইচ্ছাকৃত-অনিচ্ছাকৃত কারণে শত শত কোটি টাকার অডিট আপত্তি আছে। সেগুলো আবার বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়। এক্ষেত্রে কেউ দায়ী হলে ব্যবস্থা হয়। অতিরিক্ত খরচ হলে ফেরত দিতে হয়। আমাদের যেসব অডিট আপত্তি হয়েছিল তার কিছুটা নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকিটা এখনো হয়নি।
সব নির্বাচন সম্পন্ন করেছেন জানিয়ে সিইসি বলেন, আমরা ৬ হাজার ৬৯০টি নির্বাচন করেছি। রুটিন কাজের বাইরেও অনেক কাজ করেছি। আইন সংস্কারের বেশ কিছু কাজ করেছি। আরপিও বাংলায় রূপান্তরসহ অনেক বিধিমালা করেছি। ২৪ হাজার ৮৮১ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। বিশেষ করে ইভিএমে। করোনার কারণে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করতে পারিনি।
সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম বক্তব্য রাখেন। ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ ও যুগ্ম সচিব এসএম আসাদুজ্জমান উপস্থিত ছিলেন। আরেক নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরী কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ায় ইসিতে যাননি। ইসিতে গিয়েও সংবাদ সম্মেলনে ছিলেন না মাহবুব তালুকদার।
আমি গণতান্ত্রিক সংখ্যালঘু
দুপুরে নিজ কক্ষে মাহবুব তালুকদার সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন কমিশনের পাঁচ আঙুলের একটি হলেও আমি যে কোন আঙুল ছিলাম তা জানি না। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ইস্যুতে সিইসির সঙ্গে মতভেদ প্রকাশ করা এই কমিশনার অভিযোগ করে বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আমি কমিশনে বক্তব্য রাখতে গেলেও সুযোগ দেওয়া হয়নি। আমাকে বলা হলো এগুলো সংবিধানবিরোধী। একজনের পক্ষে কিছুই করা যায় না। গণতন্ত্রের কথা বলতে গিয়ে, গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে গিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে আমি সংখ্যালঘু হিসেবে হেরে গেছি।
বিগত সময়ে কেবল লিখিত বক্তব্য দিয়ে আসা মাহবুব তালুকদার গতকাল কিছু প্রশ্নেরও জবাব দিয়েছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কমিশনের সঙ্গে আমার কোনো ব্যক্তিগত দূরত্ব ছিল না। ভবিষ্যতেও কারও সঙ্গে কোনো ব্যক্তিগত দূরত্ব থাকবে না। পাঁচ বছর একত্রে ছিলাম। পরেও সামাজিক অনুষ্ঠান বা যে কোনো বিষয়ে একসঙ্গে থাকব। নির্বাচন কমিশনে মাহবুব তালুকদার ‘বিএনপির মুখপাত্র’- এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, খুব দুঃখজনক, মন্ত্রিপরিষদ সচিবের প্রেস ব্রিফিং থেকে জানতে পারলাম আমি বিএনপির মুখপাত্র। আমি কোনো বিষয়ে জোরেশোরে কথা বললেই বলা হয়, আমি বিএনপির সুরে কথা বলছি। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের থেকেও এই কথা শুনতে পাই। মুশকিলটা হচ্ছে, বিএনপির যে কী সুর তা আমি জানি না। যারা এ ধরনের কথা বলেন, তারা হয়তো জানতে পারেন।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের দেশে গণতন্ত্রকে যেভাবে আমরা দেখতে চাই, সাধারণ মানুষের যে আকাক্সক্ষা; তা পূরণ করা হয়নি, গণতন্ত্র সমুন্নত নয়। যারা যেভাবে ব্যাখ্যা করুন না কেন গণতন্ত্রের সঙ্গে মানবাধিকার, ভোটের অধিকার সম্পৃক্ত। সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্রকে জনজীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমি নীরব জনগোষ্ঠীর ভাষা বোঝার চেষ্টা করেছি। মানুষের অশ্রæত ভাষা বোঝার চেষ্টা করেছি। যা কিছু বলেছি, তাদের মুখপাত্র হিসেবে বলেছি।
এর আগে লিখিত বক্তব্যে এই কমিশনার বলেন, বাংলাদেশের মানবাধিকার সম্পর্কে কথা বলা অমূলক। মানবাধিকার নেই, মানবিক মর্যাদা নেই, গণতন্ত্র না থাকলে এসব থাকে না। বিশ্বে সম্মানজনক রাষ্ট্র হিসেবে আসীন হতে হলে গণতন্ত্রের শর্তগুলো অবশ্যই পূরণ করতে হবে। তিনি বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে এই নির্বাচনে গণতন্ত্র নেই, গণতন্ত্রের লাশ পড়ে আছে। এই লাশ সৎকারের দায়িত্ব কে নেবে? কথাটা রূপকার্থে বলা হলেও এটাই সত্য। তৃণমূল পর্যায়ে এই নির্বাচন দ্ব›দ্ব-সংঘাতের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। অন্যদিকে বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় পদে আসীন হওয়াকে নির্বাচন বলা যায় কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের বড় দুর্বলতা নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অনিয়ম, পক্ষপাতিত্ব, জালিয়াতি ইত্যাদি সম্পর্কে ভুক্তভোগীরা যেসব অভিযোগ করেন, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার দৃষ্টান্ত বিরল। অধিকাংশ অভিযোগই আমলে না নিয়ে নথিভুক্ত করা হয়, অনেক ক্ষেত্রে নথিতেও তার ঠাঁই হয় না। আমাদের কার্যকালের শেষ পর্যায়ে এসে বিগত কয়েক মাসে অবশ্য এর কিছু ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা গেছে। নির্বাচন নিয়ে গত পাঁচ বছরে যা কিছু বলেছি, তাতে কিছুটা ফলদায়ক হয়েছে বলে মনে হয়। মাহবুব তালুকদার বলেন, আগেও বলেছি নির্বাচন কমিশন গঠন আইন বাধ্যতামূলক। তবে আইনটি সব রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে সংকটের সমাধান হবে না। এখন পর্যন্ত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণের কোনো পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে না। এতে সংকট আরও ঘনীভ‚ত হবে। রাজনীতি ধীরে ধীরে ব্যবসায়ীদের করতলগত হয়ে যাচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, আমার প্রশ্ন, আইনপ্রণেতারা ভবিষ্যতে আইন-ব্যবসায়ী হয়ে যাবেন না তো? অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বাধা-বিঘœ দূর করতে নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার প্রয়োজন। এ জন্য সংবিধান ও বিধিবিধানের পরিবর্তন প্রয়োজন হতে পারে। সূত্র : আমাদের সময়