প্রতিনিধি ৭ এপ্রিল ২০২২ , ৮:৩৮:২০ প্রিন্ট সংস্করণ
পুলিশ কনস্টেবল আবদুল হাকিম এএসপি হয়ে ওঠার গল্পটি ভুয়া বলে প্রমাণিত হওয়ার ঘটনাটি এখন দেশজুড়ে ভাইরাল। দেশের প্রথম সারির বিভিন্ন মিডিয়া গল্পের প্রথম অধ্যায়টি অর্থাৎ তার ভুয়া সফলতা ফলাও করে প্রচার করে। তার জীবন, সংগ্রাম, স্বপ্ন ইত্যাদি উঠে আসে গল্পের মতো।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবাই তাকে শুভেচ্ছা জানান। কিন্তু অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। উঠে আসে সেই কনস্টেবলের ৪০তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে ৬৭তম স্থান অর্জন করা বা এএসপি পদে তার সুপারিশপ্রাপ্তির ঘটনাটি ছিল পুরোটাই ভুয়া, সাজানো। এরপর ঘটনার মোড় ঘুরে যায় বেশ দ্রুতই। শুরু হয় নয়া আলোচনা।
ওই কনস্টেবলের বিষয়ে আজ বৃহষ্পতিবার ‘এএসপি হওয়ার মিথ্যা গল্প কনস্টেবলের’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এরপর দেশজুড়ে শুরু হয় তোলপাড়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ভাইরাল হয়ে যায় ঘটনাটি। আর সেই গল্পের নায়কোচিত চরিত্র কনস্টেবল আব্দুল হাকিম প্রথমে সবার শুভেচ্ছা-সহানুভূতির কেন্দ্রে থাকলেও এখন তাকে নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন।
প্রতিবেদন প্রকাশের মুহূর্তেই হিরো থেকে তিনি বনে যান ভিলেনে। ভুয়া খবর ছড়িয়ে এখন নিজেই পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে হাকিম।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (ডিসি-মিডিয়া) মো. ফারুক হোসেন বলেন, আব্দুল হাকিম নামের ওই কনস্টেবল দাবি করেছেন, তিনি বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদের জন্য বাছাই হয়েছেন। তার এই দাবিটি সঠিক নয়। ভুয়া খবরটি ছড়ানো আবদুল হাকিমের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, তিনি মানসিক বিকারগ্রস্ত। আমরা খবর নিচ্ছি, তিনি কেন এমন দাবি করলেন তা খতিয়ে দেখতে হবে। তিনি কেন এমন তথ্য মিডিয়াকে দিলেন। এই বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তদন্ত চলছে। তার মিথ্যাচার প্রমাণ হলে ওই কনস্টেবলের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, কনস্টেবল আবদুল হাকিম মিডিয়ায় দাবি করেছিলেন, ৪০তম বিসিএসে তিনি পুলিশ ক্যাডারে ৬৭তম স্থান অর্জন করেছেন। বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) তালিকায় দেখা গেছে, সিলেট অঞ্চল থেকে আবেদন করা পরীক্ষার্থী সঞ্জীব দেব সেই স্থান অর্জন করেছেন। তার রোল নম্বর-১৬০০৪৩৯১। আবদুল হাকিম নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার শ্রীনগর ইউনিয়নের সায়দাবাদ গ্রামের বাসিন্দা। পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত সঞ্জীব শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ২০১২-১৩ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। প্রথম বিসিএসেই পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি। তার প্রবেশপত্রেও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ও রোল ইত্যাদির সত্যতা মেলে।
তবে অনুসন্ধানে হাকিমের এমন অভূতপূর্ব সাফল্যের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে মেলে চাঞ্চল্যকর তথ্য। হাকিমের দেওয়া তথ্যে পাওয়া যায় বিস্তর গরমিল। আদতে বিসিএসে উত্তীর্ণ তো দূরের কথা, পরীক্ষাই দেননি আবদুল হাকিম।
পুলিশ কনস্টেবল আবদুল হাকিমের দাবি করেন, ৪০তম বিসিএসে তিনি পুলিশ ক্যাডারে ৬৭তম স্থান অর্জন করেছেন। অথচ বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) তালিকায় সেই স্থান লাভ করা ব্যক্তির রোল নম্বর ১৬০০৪৩৯১, যা কি না সিলেট অঞ্চল থেকে আবেদন করা এক পরীক্ষার্থীর। তার নাম সঞ্জীব দেব। আর আবদুল হাকিম নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার শ্রীনগর ইউনিয়নের সায়দাবাদ গ্রামের বাসিন্দা। এরপরই পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত সঞ্জীবের সন্ধানে নামে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সঞ্জীব দেব শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ২০১২-১৩ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। প্রথম বিসিএসেই পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন এ মেধাবী।
সঞ্জীব দেব বলেন, ‘আমি পুলিশ ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়েছি। আমার পজিশন ৬৭তম।’ তার দেখানো প্রবেশপত্রেও এর সত্যতা মেলে। যদিও কনস্টেবল আবদুল হাকিম দাবি করেন, তিনিই ৪০তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলে পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। মেধাতালিকায় ৬৭তম হয়েছেন তিনি।
আবদুল হাকিম বলেন, ‘২০১০ সালে সায়দাবাদ উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক সম্পন্ন করেছি। এরপর রায়পুরা কলেজ থেকে ২০১২ সালে সম্পন্ন করি উচ্চমাধ্যমিক। ২০১২-১৩ সেশনে ভর্তি হই নরসিংদী সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। এর কিছুদিন পর পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরি হয়।’
২০১৩ সালে পুলিশে যোগদান করার পর প্রথমে গাজীপুরে শিল্প পুলিশে পোস্টিং হয় হাকিমের। কিন্তু ২০১৫ সালে বদলি হয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশে (ডিএমপি) আসেন, পোস্টিং হয় পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (পিওএম) বিভাগে। সেখানে থাকা অবস্থায়ই নরসিংদী সরকারি কলেজ থেকে ২০১৬ সালে অনার্স শেষ করেন।
আবদুল হাকিম বলেন, ‘দুই বছরের ব্যবধানে ২০১৮ সালে পাবলিক সার্ভিস কমিশনে আবেদন করি। প্রিলিমিনারিতে কৃতকার্য হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিই। চলতি বছরের ৩০ মার্চ ৪০তম বিসিএসের ফলে পুলিশ ক্যাডারের মেধাতালিকায় ৬৭তম হিসেবে জায়গা করে নিই।’ তিনি দাবি করেন, ‘গুলশানে পোস্টিং থাকা অবস্থাতেই ভাইভা দেই। গত বছরের ২৩ মার্চ আমার ভাইভা অনুষ্ঠিত হয়। তবে এর কয়েকদিন পরই ৩০ মার্চ থেকে করোনার কারণে ভাইভা পরীক্ষা স্থগিত করে পিএসসি।’
যদিও সূত্র বলছে, ৬৭তম পজিশনে থাকা রোল নম্বরের পরীক্ষার্থীর ভাইভা হয়েছে গেল ফেব্রুয়ারি মাসে। আর পিএসসির তালিকায় নাম থাকা সঞ্জীব দেবও জানালেন তিনি ওই সময়েই ভাইভা দিয়েছেন।
২০২০ সালের ৪ থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় ৪০তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা। আবদুল হাকিমের দাবি অনুযায়ী, তিনি ওই পরীক্ষায় অংশ নেন। কিন্তু তার ফেসবুক প্রোফাইল ঘেঁটে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। ১ থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত খাগড়াছড়ি, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ানোর ছবি আপলোড দেন তিনি। যদিও বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ হওয়ার পরই এসব ছবি ফেসবুক থেকে ডিলেট করে দিয়েছেন। তা আমাদের সময়ের কাছে অবশ্য সেগুলো সংরক্ষিত রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবদুল হাকিম বারবার ফোন কেটে দেন। একপর্যায়ে এই প্রতিবেদকের নম্বরটি মোবাইলের ব্লক লিস্টে রেখে দেন ভুয়া ওই এএসপি। -সূত্র : আমাদের সময়