প্রতিনিধি ১১ মে ২০২২ , ১১:৩১:০৪ প্রিন্ট সংস্করণ
(দিনাজপুর২৪.কম) দেশে জ্বালানির চাহিদা ও জোগানের ব্যবধান ক্রমে বাড়ছে। ক্রমবর্ধমান এ ব্যবধান ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাকে। পর্যাপ্ত জ্বালানি না পেয়ে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন করতে পারছে না অনেক শিল্পকারখানা। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে জ্বালানির সংস্থান না হওয়ায় বাড়ছে আমদানিনির্ভরতাও। অন্যদিকে দেশেই কয়লার পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও উত্তোলন করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সরকার। কী প্রক্রিয়ায় উৎপাদন হবে, উৎপাদনের ফলে খনি এলাকার মানুষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কিনা- এমন নানা বিষয় নিয়ে তৈরি হয়েছে দোটানা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে জ্বালানির উৎস না থাকলে অবশ্যই আমদানি করে জোগান স্বাভাবিক রাখতে হবে। কিন্তু দেশীয় উৎস থাকলে সেখান থেকে উত্তোলনের ব্যবস্থা করা উচিত। নিজস্ব উৎসের অনুসন্ধান না করে কেবল আমদানির মানসিকতা পরিহার করতে হবে। জ্বালানি বিভাগের তথ্যমতে দেশের পাঁচটি কয়লাখনিতে সাত হাজার ৮০৩ মিলিয়ন টন কয়লার মুজদ রয়েছে। দেশে যে কয়টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রয়েছে কিংবা নির্মাণাধীন রয়েছে, সেগুলো দীর্ঘ সময় মজুদকৃত কয়লা দিয়েই চালানো যাবে। অথচ এসব কয়লা উত্তোলনে সরকারের তেমন আগ্রহ নেই। এখন পর্যন্ত বড়পুকুরিয়া ছাড়া অন্য কোনো খনি থেকে কয়লা তোলেনি সরকার। ২০০৫ সালে বাণিজ্যিকভাবে বড়পুকুরিয়ায় কয়লা উত্তোলন শুরু হয়। যদিও তা দিয়ে খনির পাশেই স্থাপিত কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক বাজারের তথ্য বলছে, ছয় মাস আগেও যে কয়লার টন দেড়শ ডলার ছিল, সেটা এখন ৩০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। তবে বাংলাদেশের বড়পুকুরিয়ায় যে কয়লা রয়েছে, সেগুলোর প্রতি টন ১৩০ ডলারে বিক্রি করছে বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কম্পানি।
বড়পুুকুরিয়ার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ভারত বিপুল কয়লা সংগ্রহ করছে। তাদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে সরবরাহকারীরা হিমশিম খাচ্ছে। যুদ্ধের প্রভাব সবচেয়ে বেশি টের পাচ্ছে জ্বালানিতে পুরোপুরি আমদানিনির্ভর দেশগুলো।’
এদিকে সরকারের কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত একটি উৎপাদনে যেতে পেরেছে। সেটি হলো পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। সেখানকার সব কয়লা ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা হয়। দেশের খনির কোনো কয়লা কাজে লাগছে না। এ ছাড়া কয়লাভিত্তিক যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে, সেগুলোর জন্য ইন্দোনেশিয়া, মঙ্গোলিয়া, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারত থেকে কয়লা আমদানির পরিকল্পনা করছে সরকার।
জ্বালানি বিভাগের একটি সূত্র জানায়, দেশে আবিষ্কৃত খনিগুলোর একটি হলো দিনাজপুরের পার্বতীপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি। খনিটি ১৯৮৫ সালে আবিষ্কৃত। সেখানে প্রায় ৩৯ কোটি টন কয়লা মজুদ রয়েছে। তবে উত্তোলন করা যাবে ১৭ কোটি টন। সরকার সর্বশেষ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এক্সএমসি-সিএমসি কনর্সোটিয়ামের সঙ্গে চতুর্থ চুক্তি করেছে। চুক্তি অনুযায়ী আগামী ৬ বছরে এ খনি থেকে ৪৫ লাখ টন কয়লা উত্তোলন হবে। তবে আগামী ৩০ বছরে অন্তত ১৭ কোটি টন কয়লা উত্তোল সম্ভব বলে মনে করছে কর্তৃপক্ষ।
দিনাজপুরের নবাবগঞ্জে ১৯৯৫ সালের দীঘিপাড়া কয়লাখনি আবিষ্কৃত হয়। সেই খনিতে প্রায় ৭০৬ মিলিয়ন টন কয়লা মজুদ রয়েছে। ১৯৯৭ সালের দিনাজপুরের ফুলবাড়ী কয়লা খনি আবিষ্কার করা হয়। এ খনিতে ৫৭২ মিলিয়ন টন কয়লা মজুদ রয়েছে। পেট্রোবাংলা যাচাই করে দেখেছে, আগামী ৩০ বছরে এ খনি থেকে ৩০ বছরে ৯০ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোল করা যাবে।
এ ছাড়া রংপুরের পীরগঞ্জের খালাসপীর এলাকায় ১৯৮৯ সালে আরেকটি কয়লাখনি আবিষ্কার হয়। সেখানে প্রায় ৬৮ কোটি টন কয়লার সম্ভাব্য মজুদ রয়েছে। এ ছাড়া জামালগঞ্জের একটি কয়লাখনিতে ১২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ১০৫ কোটি টন কয়লার মজুদ রয়েছে। এ খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের বিষয়ে এখনো সরকার ফিজিবিলিটি স্টাডি করার বিষয়ে ভাবছে।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির সেন্ট্রাল বেসিন থেকে কয়লা উত্তোলনের জন্য একটি জরিপ করা হয়েছে। সে জরিপ অনুযায়ী শুধু বড়পুকুরিয়া থেকেই বছরে প্রায় ১০ টন করে ৩০ বছর ১৭০ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা যেতে পারে। দীঘিপাড়া কয়লা ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ একটি স্টাডি করে যে তথ্য পেয়েছে তাদের মজুদ ৭০৬ মিলিয়ন টন কয়লা থেকে বাৎসরিক তিন মিলিয়ন টন হারে প্রায় ৩০ বছরে ৯০ টন কয়লা উত্তোলন করা যাবে। এ ছাড়া জামালগঞ্জ কয়লাখনি থেকে প্রায় ৫ হাজার ৪৫০ মিলিয়ন টন এবং খালাসপীর কয়লা ক্ষেত্র থেকে প্রায় ৬৮৫ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা সম্ভব।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, দেশের খনিগুলোতে কয়লার মজুদ আছে। তবে এসব কয়লা উত্তোলন করতে গেলে স্থানীয় মানুষের নানা অভিযোগ সামনে আসে। ফলে নানা বিষয় বিবেচনায় করে সরকার দেশীয় খনিগুলো থেকে কয়লা উত্তোলনের বিষয়টি বিবেচনা করছে।
দেশের খনিতে মজুদ থাকার পরও কেন কয়লা আমদানি করে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে- এমন প্রশ্নে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম বলেন, ‘শুধু কয়লা আমদানি নয়, অন্যান্য জ্বালানি আমদানি করতে আগ্রহী সবাই। লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি), জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের জ্বালানি আমদানিতে নীতিনির্ধারকদের আগ্রহ লক্ষ্যণীয়। আমদানিতে আগ্রহী হওয়ায় দেশের খনিজসম্পদ উত্তোলন ও সঠিক ব্যবস্থাপনায় চরম অবহেলা দৃশ্যমান। আমদানিতে নিশ্চয়ই কোনো লাভ আছে। তবে এ অবস্থা বেশি দিন চলতে থাকলে ভবিষৎ অন্ধকার। জ্বালানি সংকটে মুখ থুবড়ে পড়বে দেশ।’
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান মো. নাজমুল আহসান বলেন, ‘আমাদের খনিগুলো থেকে কয়লা উত্তোলনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয় ভাবতে হচ্ছে। মানুষের কথা সবচেয়ে বেশি ভাবতে হচ্ছে। কারণ আমাদের মতো জনসংখ্যার দেশে বিশাল এলাকা থেকে কয়লা উত্তোলন করতে গেলে ওই এলাকার মানুষকে কী প্রক্রিয়ায় কোথায় স্থানান্তর করা যাবে, সেগুলো বেশি ভাবতে হচ্ছে।’ তিনি বলেন ‘কয়লা উত্তোলন সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একটি বিষয়। আমরা আপাতত বড়পুকুরিয়া থেকে আগামী ছয় বছর কয়লা উত্তোলন বাড়ানোর কথা ভাবছি। আর অন্য খনিগুলো থেকে কী প্রক্রিয়ায় কীভাবে কয়লা উত্তোলন বা ব্যবহার করব, সেগুলো নিয়েও কাজ চলছে।’
নাম প্রকাশ না করে জ্বালানি বিভাগের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘দেশের খনিজসম্পদ উত্তোলন, খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলোয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত খুব জরুরি। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না এলে কয়লা উত্তোলন করা কঠিন।’ -নিউজ ডেস্ক