(দিনাজপুর২৪.কম) প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদারের ১০ হাজার কোটি টাকা লোপাটের সহযোগী দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তদারকি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা। তদন্তে দুই শীর্ষ কর্মকর্তার জড়িত থাকার প্রমাণও মিলেছে। অর্থ পাচার কাণ্ডে পিকে হালদার ভারতে গ্রেফতার হলেও তার সহযোগী বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সীতাংশু কুমার সুর চৌধুরী (এসকে সুর) ও সাবেক নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শাহ আলমকে শুধু আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নির্বাহী পরিচালক থেকে সরিয়ে দিয়েছে।
১০ হাজার কোটি টাকার বেশি লোপাট কাণ্ডে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তা পিকে হালদারকে সহযোগিতা করেন বলে জানায় দুদক ও তদন্তকারী দল। এদের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমের নাম উঠে আসে। ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক এমডি রাশেদুল হক দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে তাদের নাম প্রকাশ করেন। পরে এ দুজনকে গ্রেফতারের দাবি ওঠে বিভিন্ন পর্যায় থেকে। কিন্তু অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন এ দুজন। দুদকে দেওয়া জবানবন্দিতে রাশেদুল হক বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরীকে ‘ম্যানেজ’ করে পিকেহালদার অর্থ লোপাট করেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন অ্যান্ড মার্কেটস (ডিআইএফএম) বিভাগের নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি মাসে ২ লাখ টাকা করে দেওয়া হতো। এ টাকা প্রতিষ্ঠান থেকে নগদ উত্তোলন করে ‘বিবিধ’ খরচ দেখানো হতো, যাতে ঘুষের টাকার কোনো প্রমাণ না থাকে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘চট্টগ্রামের একটি শীর্ষ শিল্প গ্রুপ বর্তমানে দেশের আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রণ করছে। সে গ্রুপের আশীর্বাদে ডেপুটি গভর্নর হন বলে এসকে সুর নিজেও কয়েকজনকে বলেছেন। সেই শিল্প গ্রুপের পারপাস সার্ভ করার জন্য প্রতি মাসে ৩০ লাখ টাকা করে পেতেন বলেও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এত অভিযোগ থাকার পরেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি ওই গ্রুপের প্রভাবে। তিনি তার সময় শেষ করেই চাকরি থেকে অবসরে যান। দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় উদাহরণ নেই। এ ছাড়া এসকে সুরের শক্তিতে শাহ আলমকে ডিপার্টমেন্ট পরিবর্তন ছাড়া আর কোনো শাস্তি দিতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।’
এ কর্মকর্তা আরও বলেন, এসকে সুর ও শাহ আলমের বিরুদ্ধে এসব ছাড়াও আরও অভিযোগ ছিল। কিন্তু কোনো কিছুই তাদের শাস্তির মুখোমুখি করতে পারেনি একটি অদৃশ্য শক্তির চাপে।
সম্প্রতি পিকে হালদারের গ্রেফতারের সংবাদে তোলপাড় চললেও তার অপকর্মের পৃষ্ঠপোষক এসকে সুর চৌধুরীর কোনো খবর নেই। গত মার্চে তাকে ও শাহ আলমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। এ ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক মোহাম্মদ ফেরদৌস কবির ও এবিএম মোবারক হোসেন, উপপরিচালক হামিদুল আলম ও সহকারী পরিচালক কাদের আলীকেও চার ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে কিছু তথ্য পাওয়া যায় বলে জানান দুদকের এক কর্মকর্তা।
সাবেক এনআরবি ব্যাংক (বর্তমানে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক) ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পিকে হালদারের বিরুদ্ধে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি লোপাট করার অভিযোগ ওঠে। ক্যাসিনো কাণ্ডের পর ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে প্রথম নাম আসে পিকে হালদারের। এরপর এক এক করে আরও বেরিয়ে আসে অর্থ পাচার ও লোপাটের তথ্য।
এদিকে বাংলাদেশের আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারির জন্ম দেওয়া পিকে হালদারকে গ্রেফতারের পরে আতঙ্কে আছেন অনেক রাঘববোয়াল। দেশে ফিরে তার পৃষ্ঠপোষকদের নাম প্রকাশ করতে চান তিনি নিজেও। তার সহযোগীদের নামও আসছে বিভিন্ন মাধ্যমে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নাম আসাদের কঠোর নজরদারিতে রেখেছে বলে জানা যায়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এসকে সুর ও শাহ আলম এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের এমপ্লয়ি নন। তাই তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে না। এখন মামলা হলে বা তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হলে কোর্ট যে ব্যবস্থা নেবে সেটা কোর্টের বিষয়।’
চাকরিতে থাকা অবস্থায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলেই তো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। পাঁচ সদস্যের একটা ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি হয়েছিল, তাদের সুপারিশে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। কমিটি বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে দেখবে। তবে তাদের কোনো নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হয়নি। কারণ, তথ্য পেতে অনেক সময় লাগে।’
এ বিষয়ে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘তদন্তে যাদের নাম এসেছে তাদের বিরুদ্ধে আরও অধিকতর তদন্ত চলছে। চূড়ান্ত তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে এসকে সুর ও শাহ আলমের বিদেশ যেতে এমবার্গো (নিষেধাজ্ঞা) দেওয়া আছে। তাদের গ্রেফতারের বিষয়ে আইন অনুযায়ী অগ্রসর হচ্ছে দুদক।’
এতসব অভিযোগের পরও কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় অন্যান্য দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা সাহস পাবেন বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন গ্রুপ কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তিকে যারা অন্যায়ভাবে সহযোগিতা করে তারা এ থেকে একটি মেসেজ পায়। তাদের বাঁচানোর মতো শক্তি আছে বলে তারা নির্দ্বিধায় অন্যায় করে যাওয়ার সাহস পায়।’ সূত্র : সময়ের আলো