• Top News

    চালের মজুদ ঠেকাতে মাঠে প্রশাসন: অভিযানের গোড়ায় গলদ

      প্রতিনিধি ১ জুন ২০২২ , ১:৫২:৫৬ প্রিন্ট সংস্করণ

    (দিনাজপুর২৪.কম) একদিন আগেই চালের বাজার কেন বেসামাল তা খতিয়ে দেখতে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূলত খাদ্য, বাণিজ্য ও কৃষি- এই তিন মন্ত্রণালয়কে তিনি এ নির্দেশনা দেন। তার আলোকেই গতকাল থেকে এই তিন মন্ত্রণালয় গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। মঙ্গলবারই খাদ্য মন্ত্রণালয় আটটি টিম করে দিয়েছে এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের টিমও চালের বাজারে অভিযানে নেমেছে। কিন্তু তাদের অভিযান ছিল রাজধানী ঢাকার পাইকারি ও খুচরা চালের বাজারে। যেখান থেকে অভিযান শুরু করার কথা- সেই মিল পর্যায়ে অভিযান পরিচালনা করা হয়নি।
    বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের অভিযান পরিচালনা করা মানে গোড়াতেই গলদ। কারণ চালের বাজারের মূল সিন্ডিকেট বা কারসাজি হয় মিল পর্যায়ে এবং মাঠ পর্যায়ে ধানের বাজারে। গোড়ায় হাত না দিলে চালের বাজারের মূল সমস্যার কোনো সমাধান হবে না বা সঙ্কট কাটবে না বলেও মনে করছেন তারা।
    এ বিষয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহসভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, সবসময় আমরা দেখে আসি সরকারের কোনো সংস্থা ভোগ্যপণ্যের বাজারে অভিযান চালালে শুরুতেই যায় খুচরা বাজারে বা মুদিখানার দোকানে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যখন যে পণ্যের সঙ্কট সৃষ্টি হয়, তখন মূল সিন্ডিকেট হয় মিল পর্যায়ে এবং পাইকারি পর্যায়ে। চালের ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা আরও ভিন্ন। এখানে সবচেয়ে বড় সিন্ডিকেট করা হয় মিল পর্যায়ে। তা ছাড়া এবারের চিত্র আরও কিছুটা ভিন্ন। এবারের বোরোর ভরা মৌসুমেই চালের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। কারণ বাজার থেকে দেশের বৃহৎ করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো প্রচুর পরিমাণে ধান কিনে মজুদ করে ফেলছে। ফলে ভরা মৌসুমেই বাজারে ধানের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সুতরাং চালের বাজারে স্বস্তি ফেরাতে হলে আগে খুচরা পর্যায়ে নয়, মিল পর্যায়ে অভিযান চালাতে হবে এবং করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো কি পরিমাণ ধান কিনেছে এবং সেগুলো কোথায় রেখেছে তা আগে বের করতে হবে। অর্থাৎ অভিযানে শুরুতেই গোড়ায় হাত দিতে হবে, নতুবা চালের বাজারের এ সঙ্কট কাটবে না।
    গতকাল খাদ্য মন্ত্রণালয় চালের বাজারে অভিযান চালাতে আটটি টিম গঠন করে দিয়েছে। সে সঙ্গে অবৈধ চালের মজুদ জানতে একটি কন্ট্রোলরুমও খুলে দিয়েছে। পাশাপাশি খাদ্য অধিদফতরের পাঁচটি টিমও কাজ করবে। গতকাল বিকালেই খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটি টিম চালের বাজারে অভিযান চালায়, কিন্তু সেটি ছিল রাজধানীর বাবু বাজারের পাইকারি ও খুচরা দোকান পর্যায়ে।
    পাশাপাশি গতকাল চালের বাজারে দুটি অভিযান চালায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। অধিদফতরের সহকারী পরিচালক ফাহমিনা আক্তার ও মাগফুর রহমানের নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয় রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট এলাকায় এবং অন্য দুই সহকারী পরিচালক মো. হাসানুজ্জামান ও আব্দুল জব্বার মণ্ডলের নেতৃত্বে রাজধানীর বাবু বাজার এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হয়।
    মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের অভিযান সম্পর্কে জানতে চাইলে ভোক্তা অধিদফতরের সহকারী পরিচালক ফাহমিনা খাতুন বলেন, কৃষি মার্কেটের খুচরা ও পাইকারি দোকানে আমরা অভিযান পরিচালনা করি। এ সময় দোকানে ঠিকভাবে মূল্য তালিকা না টাঙ্গানোর অপরাধে দুই দোকানিকে ২ হাজার করে ৪ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। অভিযানের খবর পেয়ে এই বাজারের অন্য দোকানদাররা নিজ নিজ দোকান ছেড়ে পালিয়ে যান। তবে অভিযানের সময় আমরা দেখেছি, প্রতিটি দোকানেই পর্যাপ্ত পরিমাণে চাল রয়েছে।
    বাবু বাজারের অভিযান সম্পর্কে জানতে চাইলে সহকারী পরিচালক হাসানুজ্জামান দিনাজপুর২৪.কমকে বলেন, এখানে অভিযানের সময় একটি দোকানের ব্যবসায়ী যে মূল্য তালিকা টানিয়েছেন তার চেয়ে বেশি দামে চাল বিক্রি করছিল। এজন্য ওই দোকানদারকে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের কাজ না করে সে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। কিন্তু এভাবে খুচরা পর্যায়ে অভিযান চালিয়ে চালের বাজারের লাগামছাড়া দাম কি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, মিল পর্যায়ে কি অভিযান চালানো যাবে না।
    এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় ভোক্তা অধিদফতরের মহাপরিচালক এএইচএম শফিকুজ্জামানের কাছে। গতকাল তিনি বলেন, আমরা চাইলেই হুট করে চালের মিল পর্যায়ে অভিযান চালাতে পারছি না। কারণ একেকটি মিলে প্রচুর পরিমাণে ধান-চাল মজুদ থাকে। দেখা যাচ্ছে কোনো মিলে ৪০ হাজার টন, কোথাও ৫০ হাজার টন মজুদ রয়েছে। এখন মিল পর্যায়ে কতদিন কী পরিমাণ ধান-চাল মজুদ থাকলে জরিমানা করা যাবে কিংবা যাবে না সে বিষয়ে সিদ্ধান্তের বিষয় রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খাদ্য, কৃষি এবং বাণিজ্য- এই তিন মন্ত্রণালয়কে চালের বাজারের অস্থিরতার কারণ খুঁজে বের করতে বলেছেন। এই তিন মন্ত্রণালয় থেকে কী নির্দেশনা আসে, আমরা তার অপেক্ষায় আছি। সিদ্ধান্ত জানামাত্রই আমরা মিল পর্যায়েও অভিযান চালাব। তবে আজই (গতকাল মঙ্গলবার) আমি জুম মিটিং করে অধিদফতরের ৬৪ জেলা কার্যায়ের কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দিয়েছি প্রস্তুত থাকার জন্য। আমরা নির্দেশনা পেলেই একযোগে কাজ শুরু করব।
    খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কন্ট্রোলরুম ও আট টিম : অন্যদিকে ধান ও চালের অবৈধ মজুদের বিরুদ্ধে গতকাল মঙ্গলবার থেকে মাঠে নেমেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আটটি টিম। একই সঙ্গে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে একটি কন্ট্রোলরুম খোলা হয়েছে। অবৈধ মজুদের তথ্য জানাতে কন্ট্রোলরুমের +৮৮০২২২৩৩৮০২১১৩, ০১৭৯০-৪৯৯৯৪২ এবং ০১৭১৩-০০৩৫০৬ নম্বরে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। মঙ্গলবার খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের সভাপতিত্বে সচিবালয়ে তার নিজ দফতরে অনুষ্ঠিত এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ধান-চালের অবৈধ মজুদ ঠেকাতে মঙ্গলবার থেকেই মাঠে নেমেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আটটি টিম। কেউ অবৈধ মজুদ করে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করছে কি না, এসব টিমের সদস্যরা তা খতিয়ে দেখবে এবং অবৈধ মজুদদারদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে কাজ করবে। অবৈধ মজুদদারি প্রতিরোধে ডিসি ও ইউএনও বরাবর আধা সরকারি চিঠি পাঠানো এবং এনএসআই, র‌্যাব ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরকেও এ বিষয়ে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া শিগগিরই কৃষি, খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বিত সভা আয়োজন করতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন খাদ্যমন্ত্রী। প্রসঙ্গত সোমবার মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে ভরা মৌসুমে চালের দাম এত বেশি কেন, তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর খাদ্য মন্ত্রণালয় গতকাল এ ব্যবস্থা নিলো।
    অন্যদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মজিবুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, বিপণন পর্যায়ে কোন দোকানে কতটুকু মজুদ রাখা যাবে তা আইনে বলা আছে। যদি অবৈধ মজুদ পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি জানান, ১৯৫৬ সালের অ্যাসেন্সিয়াল কমোডিটি অ্যাক্টে বলা আছে কোন পর্যায়ে কতটুকু মজুদ রাখা যাবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ এবং ২০২১ সালে দুটি আদেশ জারি করা হয়। সেই আলোকেই অভিযান চলবে। ২০১১ সালে জারি করা বিধিতে বলা হয়, সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো ব্যবসায়ী ১ টনের বেশি খাদ্যসামগ্রী তার অধিকারে রাখতে পারবেন না। অনুমোদিত ব্যবসায়ীদের মধ্যে পাইকারি ব্যবসায়ী সর্বোচ্চ ৩০০ টন ধান অথবা চাল ৩০ দিন পর্যন্ত মজুদ রাখতে পারবেন। খুচরা পর্যায়ে সর্বোচ্চ ১৫ টন ধান অথবা চাল ১৫ দিন মজুদ রাখতে পারবেন।
    চালকল মালিকরা পাক্ষিক ছাঁটাই ক্ষমতার ৫ গুণ ধান সর্বোচ্চ ৩০ দিন মজুদ রাখতে পারবেন। পাক্ষিক ছাঁটাই ক্ষমতার দ্বিগুণ চাল সর্বোচ্চ ১৫ দিন মজুদ রাখা যাবে। হাস্কিং মিল মালিকরা সর্বোচ্চ ১০০ টন ১৫ দিন মজুদ রাখতে পারবেন। -নিউজ ডেস্ক
    মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়।

    আরও খবর

    Sponsered content