• Top News

    ‘কী হলো ভোট দিয়ে, দালান ঘরে থাকা হলো না মা সুরাইয়ার’

      প্রতিনিধি ৩১ জুলাই ২০২২ , ১:০৬:৩৯ প্রিন্ট সংস্করণ

    ছবি-সংগ্রহীত

    (দিনাজপুর২৪.কম) ‘আর কোনোদিনই কোলে উঠবে না বোনটি আমার, বায়নাও ধরবে না কোনো কিছুর। কোলে ওঠার জন্য আর কাঁদবেও না সে কখনোই। গ্রামের সব শিশুরা এখনো জেগে আছে, শুধু ঘুমিয়েছে মাটির কোলে বোন সুরাইয়া’, এই বলে ডুকরে কাঁদছে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া সুমাইয়া আক্তার।

    মেয়ের এমন বুক ফাটা কান্নায় বাদশাহ মিয়াও নিজেকে সামলাতে পারছিলেন না। তখনি চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলেন, ‘আমার প্রাণ আর কোনদিনও জাগবে না। আমায় ডাকবে না আর বাবা বলে! ঘুমিয়ে গেছে মাটির কোলে। মিনারা (বাদশার স্ত্রী) যদি ভোটকেন্দ্রে না যেতো, তাহলে কী আমার ছোট্ট মাকে আজ হারাতে হতো? কী হলো ভোট দিয়ে?’

    বাদশার এমন আকুতিতে ভেঙে পড়েন তার স্ত্রী মিনারা বেগম। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন পর দালান ঘরে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু মা হামার মাটির ঘরে রেখেনু-দালান ঘরে থাকা হলো না আমার মা সুরাইয়ার।’ এই বলে আবার কান্নায় ভেঙে পড়েন মিনারা। তাদের আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে সেখানকার আকাশ বাতাস।

    আজ রোববার সকালে ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈলে নির্বাচনী সহিংসতায় পুলিশের গুলিতে নিহত সুরাইয়ার বাড়িতে গেলে এই দৃশ্য চোখে পড়ে। গতকাল শনিবার কুলখানির পর শিশুটির কথা মনে করেই পরিবারের সদস্যসহ স্বজনেরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।

    গত বুধবার ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার বাচোর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচনের ফল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে পুলিশের গুলিতে মীরডাঙ্গী মহেষপুর গুচ্ছ গ্রামের বাদশা মিয়ার ৯ মাসের শিশু সুরাইয়া আক্তার মারা যায়। ওইদিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে উপজেলার বাচোর ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডের ফল ঘোষণা শেষে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ইভিএম মেশিন নিয়ে ফেরার পথে এই ঘটনা ঘটে।

    নির্বাচনের ফল ঘোষণার সময় প্রতিদ্বন্দ্বী দুই গ্রুপের সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে শিশু সুরাইয়া নিহত হয়। তবে অল্পের জন্য রক্ষা পান শিশুটির মা মিনারা বেগম।

    স্থানীয়রা জানান, ভোট দিয়ে মিনারা বেগম তার ফুফুর বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। ভোট শেষে ফলাফল জানার জন্য শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে ওই ইউনিয়নের ভাংবাড়ির ভিএফ নিম্ন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রের আশপাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সে সময় মেম্বারপ্রার্থী আজাদ আলী ও খালেদুর রহমানের সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে গুলি ছোড়ে পুলিশ। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই শিশুটির মৃত্যু হয়। আহত হন আরও কয়েকজন।

    এ ঘটনা সম্পর্কে রানীশংকৈল উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহেল সুলতান জুলকার নাইন কবির স্টিভ বলেন, ‘পুলিশের গুলিতে একটি শিশু মারা গেছে। স্থানীয়রা ভোটের ফল উপজেলায় নেওয়ার পথে বাধা দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ফলে গুলি ছুড়তে বাধ্য হয় পুলিশ। এ সময় দুর্ঘটনা ঘটে।’

    রানীশংকৈল উপজেলা সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘ভোট গণনা শেষে ইভিএমসহ প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের পৌঁছে দেওয়ার পরে পরাজিত মেম্বার প্রার্থীর সমর্থকেরা পুলিশের ওপর চড়াও হয়। বাধ্য হয়ে আত্মরক্ষার্থে পুলিশ ব্যবস্থা নেয় এবং গুলি ছোড়ে।

    অপরদিকে, উপজেলার হোসেনগাঁও ইউনিয়নে ভবানিডাঙ্গী এলাকায় দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশসহ ৯ জন আহত হন। আহতদের ঠাকুরগাঁও এবং রানীশংকৈল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

    ছবি-সংগ্রহীত

    শিশু সুরাইয়া পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনার সত্যতা উন্মোচনে ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসন থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রামকৃষ্ণ বর্মণকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন-ঠাকুরগাঁওয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মির্জা তারেক আহমেদ বেগ ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা সফিকুল ইসলাম।

    উল্লেখ্য, গত আট মাসে তৃতীয় ও শেষ ধাপে ঠাকুরগাঁওয়ের পাঁচটি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) অনুষ্ঠিত নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় শিশু ও কলেজ শিক্ষার্থীসহ পাঁচজন পুলিশের গুলিতে নিহত হন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে পুলিশসহ ৩০ জন। মামলা হয়েছে প্রায় এক হাজার ২০০ গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে। আসামিরা পুলিশের হয়রানি ও গ্রেপ্তারের ভয়ে বাড়ি ছেড়েছেন।

    ঠাকুরগাঁও পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, নির্বাচনী ফলাফল মেনে না নেওয়ার প্রবণতা থেকেই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতার ঘটনা বেশি ঘটছে। পরাজিত চেয়ারম্যান ও মেম্বারপ্রার্থীর সমর্থকেরা উচ্ছৃঙ্খল আচরণে লিপ্ত হয়। তবে এজন্য তিনি পরমত সহিষ্ণুতা কামনা করেন।

    ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক (ডিসি) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সহিষ্ণুতা ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলের অভাব। আমাদের সুষ্ঠু ধারার সংস্কৃতি লালন এবং পরস্পরের প্রতি আস্থা তৈরি করা প্রয়োজন।’ -অনলাইন ডেস্ক

    মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়।

    আরও খবর

    Sponsered content