(দিনাজপুর২৪.কম) দেশের বাজারে ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম। ফলে বিরূপ প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে। খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে সবকিছুরই দাম বাড়বে, যা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে। ঠিক এ সময়ে জ্বালানি তেলের এত দাম বাড়ানোকে অযৌক্তিক বলছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, ঋণ পাওয়ার জন্য জনগণকে এমন সীমাহীন ভোগান্তির মধ্যে সরকার না ফেললেও পারত।
এই দাম বাড়াকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের শর্তের পরিপালন হিসেবে দেখছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। আইএমএফের শর্তের কারণেই জ্বালাানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয়েছে বলে মনে করছেন তারা। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইএমএফের শর্ত পালন করতে এত পরিমাণে দাম না বাড়ালেও হতো। সম্প্রতি আইএমএফের কাছে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ।
সংস্থাটিও বাংলাদেশকে ঋণ দিতে প্রস্তুত বলে জানা গেছে। তবে ঋণ পেতে কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছে সংস্থাটি। অর্থনৈতিক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণ দিতে বরাবরই বেশকিছু শর্ত দিয়ে থাকে আইএমএফ। সব শর্ত পালন করতে হয় বিষয়টি তেমন নয়। তবে শর্ত পালনের ওপর নির্ভর করে ঋণ প্রদান।
ঋণ চাওয়ার পর জানা গিয়েছিল আইএমএফের শর্ত। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৬ টাকা দাম বাড়িয়ে সারের ওপর ভর্তুকি কমায় সরকার। জ্বালানি তেলের দামে ভর্তুকি কমানোর বিষয়টিও অন্যতম শর্ত ছিল সংস্থাটির। সে হিসেবে এ খাতেও যে দাম বাড়বে তা আগে থেকেই ধারণা করতে পারছিলেন সবাই। তবে যে পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে তা অকল্পনীয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েট অধ্যাপক ড. ম. তামিম বলেন, ‘এখন তো আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমছে। আর্থিক খাতে জরুরি বলেই ঋণ নিচ্ছে সরকার। ঋণ পেতে যে শর্ত তাতে দাম বাড়বে আগেই বোঝা যাচ্ছিল। আমাদের সবার স্বাভাবিকভাবে প্রত্যাশা ছিল সহনীয় পর্যায়ে দাম বাড়াবে সরকার। কিন্তু এক ধাক্কায় এত বাড়বে তা হয়তো কেউই ভাবেনি। একবারে এত বাড়ানোও ঠিক হয়নি। এতে সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে।’
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে রাজস্ব আহরণে ভাটা পড়বে। কারণ জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেলে ভোগ ব্যয় হ্রাস পায়। এতে অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়। আর অর্থনীতি সঙ্কুচিত হলে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ও আয়কর আহরণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বাজেট সহায়তার জন্য যে ঋণ চাওয়া হয়েছে তা দিয়ে আসলেই কোনো লাভ হবে কি না তাতে শঙ্কা রয়েছে। কারণ রাজস্ব আহরণ কমলে আবারও বাজেট ঘাটতিতে পড়বে দেশ।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক ঊর্ধ্বতন পরিচালক বর্তমানে সরকারি মালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘এমনিতেই অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির চাপ রয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে এ চাপ আরও বাড়বে।’ তিনি আরও বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে যাচ্ছিল। তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে এটি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’ অর্থনীতির ঝুঁকি এড়াতে এ সময় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো ঠিক হয়নি বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ। তিনি আরও বলেন, নিত্যপণ্যসহ সব কিছুর দাম যখন আকাশছোঁয়া, তখন কোন যুক্তিতে এ সময় তেলের দাম বাড়ানো হলো তা বোধগাম্য নয়।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আইএমএফ বরাবরই বেশকিছু শর্ত দিয়ে থাকে। এবার বাংলাদেশকে ঋণ দিতেও তাই অনেকগুলো শর্ত দিয়েছিল। আমাদের অর্থনীতির যে অবস্থা তাতে এখন ২ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেলে খুব ভালো হবে। এ কারণেই ওদের (আইএমএফ) শর্ত মেনে কিছু সিদ্ধান্ত সরকার নিচ্ছে। এটা খুবই ভালো। তবে যেভাবে হুট করে জ্বালানির দাম বাড়ল তা অভাবনীয়। এভাবে এতটা বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা আমি খুঁজে পাচ্ছি না। একলাফে ৫০ শতাংশ কেন বাড়ল তা কর্তাব্যক্তিরাই বলতে পারবেন।’
ঋণ পেতে শর্ত পালন করা জরুরি। তবে শর্ত পালন করতে গিয়ে এত দাম বাড়িয়ে জনগণকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেওয়া কোনো ভালো বিষয় নয় বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর।
ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘ঋণ নিচ্ছেন তা তো জনগণের সুবিধার জন্যই। জনগণ যেন ঠিকভাবে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে, দেশের জনগণ যেন ভালো থাকে সেজন্যই। কিন্তু ঋণ নিতে গিয়ে যদি দেশের মানুষকে বিপদে ফেলে দেন তবে তা কোনো কাজে আসবে না। যে হারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলো তা কোনো সভ্য দেশে হয় না। এ সিদ্ধান্তে একদম প্রান্তিক পর্যায়ের মানুপর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশের প্রতিটি সেক্টরে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে।’ তিনি আরও বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাবে চতুর্মুখী সমস্যায় পড়বে দেশ। অনেক আগে থেকেই মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট দেশের মানুষ। এর আগে ছিল করোনার অভিঘাত। এখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্যপণ্যের দাম সর্বোচ্চ। ঠিক এমন সময় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলো সেটা মড়ার উপর খাড়ার ঘাঁ হিসেবে দেখা দেবে। এর ওপর যে হারে দাম বাড়ানো হলো তা তো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’
ড. ম তামিম বলেন, ‘ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বড় ধরনের আঘাত হানবে। আমি মনে করি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির এ সিদ্ধান্তে মানুষের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। ফলে হয়তো বিপিসি কিছুটা লাভবান হবে; কিন্তু দেশের জনগণের কষ্ট আরও বাড়বে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের এক কর্মকর্তাবলেন, ‘বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন গত ৮ বছরে তেল বিক্রি করে ৪৮ হাজার কোটি টাকার ওপরে লাভ করেছে। তেলের দাম বাড়ছে গেল ৬ মাসে। এর মধ্যে বিপিসি লোকসান গুনেছে ৮ হাজার কোটি টাকা। অথচ যে পরিমাণে লাভ করেছে তা দিয়ে আরও তিন বছর ভর্তুকি দিয়ে আগের দামেই তেল বিক্রি করতে পারত। কিন্তু যেহেতু আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে ভর্তুকি কমানোর কথা ছিল। তাই ভর্তুকি কমিয়েছে। কিন্তু দাম এতটা না বাড়ালেও হতো।’ -অনলাইন ডেস্ক