(দিনাজপুর২৪.কম) সংসার চালাতে আর কোথায় কোথায় ব্যয় কমানো যায়, সেটিই এখন প্রতিদিনকার ভাবনা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কবীর হোসেনের। গত তিন বছরে মাসিক বেতন ৪০ হাজার টাকা থেকে এক টাকাও বাড়েনি। অথচ খাদ্যপণ্য, যাতায়াত, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ সব খাতে এই তিন বছরে ব্যয় বেড়েছে তিন থেকে চারগুণ। বেঁচে থাকার তাগিদে বাধ্য হয়েই ব্যয় কমানোর জায়গা খোঁজেন তিনি।
এক্ষেত্রে তিনি তিন বেলার আহার জোগানোর ব্যয়েই বেশি ছুরি-কাঁচি চালিয়েছেন। খাদ্যপণ্য কেনার ক্ষেত্রে মাছ, মাংস, দুধ, ডিমের মতো দামি পণ্য কেনা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন। বাজারে গেলে এখন তিনি তার চাহিদার অর্ধেক পণ্য কেনেন। কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে এ সপ্তাহে নতুন করে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন অর্ধেক পণ্য কিনেও আর কুলাচ্ছে না অর্থে, ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে পকেট। আর কোথায় তিনি ব্যয় কমাবেন সে জায়গাও খুঁজে পাচ্ছেন না। ফলে ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের সঙ্কুলান না হওয়ায় দিশেহারা কবীর হোসেন। শুধু কবীর হোসেন নন, তার মতো মধ্যবিত্ত প্রতিটি পরিবারের কর্তাব্যক্তির এখন একই দশা।
সমাজবিজ্ঞানী ও বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজের উচ্চবিত্ত আর একেবারে নিম্ন আয়ের মানুষের চেয়ে সবচেয়ে কষ্টে আছে মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষরা।
এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, চালের কেজি ৫০০ টাকা হলেও সমাজের উচ্চবিত্ত বা ধনীদের কোনো সমস্যা হবে না। চালের কেজি কত, তেলের কেজি কত, মাছের কেজি কত, মাংসের কেজি কত- তারা বাজারে এসবের খোঁজও রাখেন না। কারণ তারা বাজারে যান না। আর গরিব মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে হাত পাততে কিংবা ভিক্ষা করতেও দ্বিধা করে না। কিন্তু মধ্যবিত্তের পক্ষে এর কোনোটিই করা সম্ভব নয়। ফলে মধ্যবিত্তরা এখন ডুকরে কাঁদছে, তারা নীরবে চোখের পানি ফেলছে। মধ্যবিত্তের এই দুর্দশার জন্য দেশের সমাজব্যবস্থা এবং সরকারের উদাসীনতাই দায়ী।
ভোগ্যপণ্যের চড়া মূল্যে দেশের সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়তে থাকে মহামারি করোনার শুরু থেকেই। মূলত সে সময় থেকেই দেশের বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করে। এরপর গত তিন বছরে দফায় দফায় দাম বাড়তে বাড়তে প্রতিটি ভোগ্যপণ্যের দাম একেবারে আকাশচুম্বী হয়েছে। অধিকাংশ পণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। সর্বশেষ গত সপ্তাহে জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কারণে ভোগ্যপণ্যের দামের আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়া হয়েছে। একদিকে পরিবহন ব্যয় বেড়ে গেছে, আরেক দিকে এই অজুহাতকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়ীরাও অতিরিক্ত মুনাফা লুটতে উঠেপড়ে লেগেছে। ফলে চাল, ডাল, সবজি, মাছ ও মুরগি থেকে শুরু করে সব ধরনের পণ্যের দাম আবারও বেড়ে গেছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওই কর্মকর্তা কবীর হোসেন শুক্রবার বাজার করতে এসেছিলেন, রাজধানীর কল্যাণপুর নতুনবাজারে। ব্যাগ হাতে নিয়ে প্রথমে তিনি মাছের বাজারে ঢোকেন। প্রথমে তিনি পুরো বাজারটি ঘুরে দেখেন এবং কোন মাছের কী দাম জিজ্ঞেস করেন। ইলিশ মাছের ঝুড়ির সামনে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার সামনে এগোলেন। শেষমেশ তিনি এক কেজি তেলাপিয়া মাছ কিনে হাঁটা দিলেন সবজির বাজারের দিকে। সবজির বাজারে ঘুরে অল্পবিস্তর সবজি কিনলেন। সবজি কেনা শেষেই কবীর হোসেনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
বাজারে এসে কী কিনলেন জানতে চাইলেই তিনি কিছুটা বিরক্ত। উল্টো প্রশ্ন করে বলেন, কেন ভাই- আমি কী কিনলাম সেটি আপনার জানার কী দরকার। পরিচয় দিয়ে তার কাছে জানতে চাইলাম- আসলে এই চড়া মূল্যের বাজারে কীভাবে সামলাচ্ছেন, কীভাবে সংসার চলছে। তখন তিনি কিছুটা শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা বললেন।
কবীর হোসেন বলেন, আমার ছেলেমেয়ে ইলিশ মাছ খুব পছন্দ করে। এ জন্য মাছের বাজারে গিয়ে ইলিশ মাছের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। মাঝারি আকারের ইলিশের কেজি চাচ্ছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। আমি বাজারে এসেছি দেড় হাজার টাকা নিয়ে। ভাবলাম যদি এক কেজি ইলিশ কিনি তা হলে তো অর্ধেক টাকা শেষ। তাই বাধ্য হয়ে ইলিশ না কিনতে পারার কষ্ট বুকে চেপে চলে গেলাম। পরে ১৬০ টাকা কেজিতে এক কেজি তেলাপিয়া মাছ কিনে চলে এলাম। আসলে ইলিশ কিনতে না পারায় আমি খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম, চোখে পানি চলে এসেছিল। মনে হচ্ছিল আমি কেমন বাবা সন্তানের পছন্দের মাছটি আমি কিনতে পারলাম না। অর্থাৎ আমি কম দামের মাছ কিনে অর্থ সাশ্রয় করছি। এভাবে সবজি, তেল, চাল-ডালসহ সব পণ্যের ক্ষেত্রেই কখনও কম দামের পণ্য কিনে আবার কখনও অর্ধেক পণ্য কিনে ঘরে ফিরছি। এভাবে কত দিন টিকে থাকতে পারব জানি না। তা ছাড়া আর কোথায় ব্যয় কমাব, আর কত কাটছাঁট করব। সংসারের ব্যয় মেটাতে রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠছি, আর পারছি না।’
জ্বালানি তেল পণ্যের চড়া মূল্যের আগুনে ঘি ঢেলে দিল
জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে সবার আগে প্রভাব পড়ে ভোগ্যপণ্যের বাজারে। কারণ সব পণ্যই উৎপাদক থেকে বিক্রেতার হাত ঘুরে ভোক্তার ব্যাগে উঠতে পরিবহনের দরকার। আর এই পরিবহন চলে জ্বালানি তেলে। তাই জ্বালানি তেল পণ্যের চড়া মূল্যের আগুনে ঘি ঢেলে দিল। অর্থাৎ জ্বালানি তেলের কারণে নতুন করে দাম বাড়ল বাজারের সব ধরনের পণ্যের।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে প্রায় সব ধরনের সবজির দামই কমবেশি বেড়েছে। টমেটোর দাম কেজিতে একলাফে বেড়েছে ৪০ টাকা। টমেটো এখন ১২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া কয়েক দিন ধরে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে ব্রয়লার মুরগির দাম। এক সপ্তাহে ৪০ টাকা বেড়ে ব্রয়লার মুরগির কেজি ২০০ টাকা ছুঁয়েছে। শুক্রবার রাজধানীর বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ৪০-৫০ টাকা বেড়েছে। বর্তমান দাম ২০০ টাকা কেজি। শুধু ব্রয়লার মুরগিই নয়, বেড়েছে পাকিস্তানি কক-মুরগির দামও। গত সপ্তাহেও পাকিস্তানি ককের দাম ছিল ২৪৫-২৫০ টাকার মধ্যেই। গতকাল কক বিক্রি হচ্ছে ২৮০-৩০০ টাকায়। বেশিরভাগ ব্যবসায়ী ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি করছেন ২০০ টাকা। তবে কেউ কেউ ১৯০ টাকা কেজিও বিক্রি করছেন। গত সপ্তাহে ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকা কেজি। -ডেস্ক রিপোর্ট