(দিনাজপুর২৪.কম) ক্রেতা বা ভোক্তা যদি আর্থিক সঙ্কটে থাকে তার নেতিবাচক প্রভাব দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং আর্থ-সামাজিক সব ক্ষেত্রেই পড়ে। সব কিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় জীবন-যাত্রার ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুণ। সে তুলনায় বাড়েনি আয়। তাই ক্রেতারা কৃচ্ছ্রসাধন করছেন। জীবন বাঁচাতে খাদ্য, বস্ত্র বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য কেনার ক্ষেত্রে দেশের মানুষ এখন অনেক হিসাব-নিকাশ করছেন। নেহায়েত প্রয়োজন ছাড়া বাড়তি কোনো পণ্য কিনছেন না। বাসা ভাড়া, শিক্ষা ব্যয় এবং খাদ্যের যোগান দিতেই অর্থের টানাটানি শুরু হয়ে যাচ্ছে অধিকাংশ পরিবারে। নতুন পোশাক, জুতা-স্যান্ডেল, প্রসাধনী বা অন্যান্য পণ্য কেনা থেকে ভোক্তারা এখন একরকম হাত গুটিয়ে রেখেছেন। এ কারণেই ভোগ্যপণ্যের বাজার থেকে শুরু করে বড় বড় মার্কেট বা শপিংমলগুলো এখন ক্রেতার হাহাকার। পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, সারা দিনেও এটি ক্রেতা আসছে না অনেক দোকানে। ফলে বাধ্য হয়ে অনেক ব্যবসায়ী বন্ধ করে দিচ্ছেন কষ্টে গড়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি। আবার অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্রেতার অভাবে বন্ধ থাকছে দিনের অধিকাংশ সময়। অনেক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, এমনও দিন যাচ্ছে সারা দিনে বউনি করতে পারছেন না অর্থাৎ একটি পণ্যও বিক্রি করতে পারছেন না। এ রকম কঠিন পরিস্থিতিতে অতীতে কখনো পড়তে হয়নি বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
রাজধানীর ব্যস্ততম একটি জায়গা ফার্মগেট। ঢাকার অন্যতম প্রাণকেন্দ্রও বলা হয় এটিকে। ফার্মগেটের সবচেয়ে বড় শপিংমলটি হচ্ছে সেজান পয়েন্ট। ভবনটির নীচ থেকে ষষ্ঠতলা পর্যন্ত রয়েছে বিভিন্ন ধরনের পণ্যের দোকান। নীচ তলায় রয়েছে কসমেটিক্স ও প্রসাধনী, খেলনা, ব্যাগসহ আরও অনেক পণ্যের দোকান। দ্বিতীয় তলায় রয়েছে পোশাক ও জুতার দোকান, তৃতীয় তলায় রয়েছে মোবাইল, কম্পিউটারসহ বিভিন্ন রকম ইলেকট্রনিক্সের দোকান, চতুর্থ তলায় রয়েছে শাড়ি ও জুয়েলারির দোকান। এই চতুর্থ তলার সবচেয়ে বড় শাড়ির দোকান ছিল স্বর্ণালী শাড়ি হাউস। একটা সময় ছিল দোকানটিতে শাড়ি-কাপড় কিনতে এসে ক্রেতাদের বসার জায়গা দেওয়া যেত না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে এক ক্রেতা ওঠার পর আরেক ক্রেতা বসতেন। অর্থাৎ দোকানটিতে ক্রেতার কোনো অভাব ছিল না। দোকানটিতে এমন কোনো দিন নেই যেদিন বিক্রি হয়েছে সর্বনিম্ন ১ লাখ থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত। দেশীয়, ভারতীয় এবং পাকিস্তানি শাড়িতে ভরপুর থাকত সবসময় দোকানটি। অথচ ক্রেতার অভাবে সেই দোকান গত তিন মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক কালিপদ হালদার এখন প্রায় দেউলিয়া।
তিনি বলেন, ‘মহামারি করোনার শুরু থেকে গত তিন বছর ধরে লোকসান দিয়ে আসছি। সর্বশেষ দুটি ঈদে কিছুটা ব্যবসা হয়েছে, কিন্তু গত কোরবানির ঈদের পর থেকে বিক্রি একেবারে কমে গেছে। যে দোকানে একটা সময় দিনে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকারও শাড়ি-কাপড় বিক্রি করেছি, সে দোকানে দিনে ৫ হাজার টাকারও পণ্য বিক্রি করতে পারছিলাম না। অথচ আমার দোকানটিতে প্রতিদিন খরচই রয়েছে ১২-১৫ হাজার টাকা। স্টাফ রয়েছে ৫ জন। সুতরাং বিক্রি কমে যাওয়ায় আর টিকতে পারছি না। প্রতি মাসে লোকসান দিতে হচ্ছে। ঘর থেকে টাকা এনে কর্মচারীদের বেতন ও দোকান ভাড়া দিতে হয়েছে। ফলে গত জুন থেকে আমার দোকানটি বন্ধ করে দিয়েছি। দোকানে এখনো কয়েক লাখ টাকার শাড়ি রয়েছে। এগুলো হয়তো কম দামে অন্য কোনো ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেব। এই ব্যবসা গুটিয়ে এখন আমি আমার গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জে চলে গেছি। গ্রামে কিছু জায়গা-জমি আছে সেখানে কিছু করা যায় কি না চেষ্টা করছি।
স্বর্ণালী শাড়ি হাউসের পাশেই রয়েছে আরও দুটি শাড়ির দোকান। এ দুটি এখনো বন্ধ না হলেও হয়তো বেশিদিন চালু রাখা সম্ভব হবে না বলে জানালেন দোকান দুটির ব্যবসায়ীরা। এর একটি হচ্ছে এন. আর শাড়ি বিতান। দোকানটির স্বত্বাধিকারী ইমরান আহমেদ বলেন, ‘আমরা এখন একজন ক্রেতার জন্য তীর্থের কাকের মতো চেয়ে থাকি। একজন ক্রেতা এলে দুই দোকানের মধ্যে কাড়াকাড়ি হয়, কে কার দোকানে নিতে পারেন ক্রেতাটিকে। সারা দিনে ক্রেতা আসছে দুই-তিনজন। এর মধ্যে হয়তো কিনছেন একজন। জানি না এভাবে কতদিন টিকে থাকতে পারব। হয়তো আমাদেরও এক দিন ব্যবসা গুটিয়ে চলে যেতে হবে।’
ফার্মগেটের আরেকটি বড় মার্কেট ফার্মভিউ সুপার মার্কেট। এখানে মূলত কিছুটা কম দামের পোশাক, জুতা, কসমেটিক্স, ঘড়ির মতো পণ্য সামগ্রী বিক্রি হয়। মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রেতাই বেশি আসেন এখানে। এ বাজারের ব্যবসায়ীরা জানালেন, তাদের বিক্রি আগের চেয়ে এখন ৩০-৪০ শতাংশ কমে গেছে।
এ বাজারের থ্রি-পিস, বাচ্চাদের পোশাক বিক্রেতা মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘এমনিতেই মানুষের হাতে টাকা কম, বাজারে আসছেনও কম। এটি একটি বড় সসম্যা। এ জন্য ক্রেতা আসছেন কম। কিন্তু তার চেয়ে আমাদের ব্যবসার এখন বেশি ক্ষতি করছে রাত ৮টার মধ্যে মার্কেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। সাধারণত কর্মজীবী মানুষরা নিজ নিজ কাজ সেরে বাসায় ফেরার পথে মার্কেটে এসে কিছু কেনাকাটা করেন। এ জন্য সবসময় সন্ধ্যার পর বেশি ক্রেতা আসেন মার্কেটগুলোতে। কিন্তু এখন আর আসছেন না। তা ছাড়া রাত ৮টায় বন্ধ করা মানে মাগরিবের নামাজের পর পরই আমাদের দোকান বন্ধের প্রস্তুতি নিতে হয়। এই কারণে আমাদের ব্যবসার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে এখন। অন্তত রাত ১০টা পর্যন্ত মার্কেট খোলার অনুমতি দেওয়া দরকার। নতুবা ব্যবসায়ীরা নিঃস্ব হয়ে যাবে। ইতোমধ্যেই অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে চলে গেছেন, হয়তো আমাদেরও যেতে হবে।’
ঢাকায় জুতার সবচেয়ে বড় মার্কেট ফুলবাড়িয়া। আর ইসলামপুর বিখ্যাত কাপড় বিক্রির জন্য। দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে ক্রেতারা আসেন এ দুই মার্কেটে। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলত কেনাকাটা। তবে এ দুটি মার্কেট ঘুরেও তেমন ক্রেতা চোখে পড়েনি। অথচ আগে এসব মার্কেট দিনরাত বিক্রেতা, হকার, কুলি, ভ্যানচালকদের হাঁকডাকে মুখরিত থাকত। মানুষের ভিড়ের কারণে চলাচল করাই কঠিন ছিল।
ইসলামপুরের করিম ম্যানশনের থ্রি স্টার ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপক বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘কোনো কোনো দিন দুপুর পর্যন্ত এক টাকারও বেচাকেনা হচ্ছে না। অন্যান্য বছর এ সময়ে শীতের পোশাকের আগাম অর্ডার আসত। এ বছর কোনো সাড়াই নেই। বসে বসে কর্মচারীদের বেতন দিচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘এখন আগের দামে কাপড় বিক্রি করলে লোকসান হবে। দাম অনেক বেড়েছে। তবে চাহিদা কমায় বাড়তি দাম চাইতেও সাহস হচ্ছে না। এখন দোকান চালানোর খরচ, কর্মচারীদের বেতন কোনোটিই উঠছে না। পুরোটাই এখন লস।’
মোবাইল ফোনের বেচাকেনা তলানিতে। কসমেটিকস, পারফিউম, সাবানের দাম বেড়েছে, বিক্রিও কমেছে। স্বর্ণের বাজারও অস্থিতিশীল। ইলেকট্রনিক পণ্যসহ বিলাসী সব পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। রিকন্ডিশনড প্রাইভেটকার, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র (এসি) বিক্রি নেই বললেই চলে। শুধু আমদানিনির্ভর বিলাসীপণ্য নয়, দেশে উৎপাদিত বিলাসীপণ্য বিক্রিতে বড় ধাক্কা।
বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের বিলাসী পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কোম্পানি ব্র্যান্ড চালাতে পারছে না। আমদানি খরচ বাড়ায় দাম বাড়ানো হয়। এরপর বিক্রি একদম কমে গেছে। এরই মধ্যে প্রতিটি শোরুমের কর্মী কমানো হয়েছে। খরচ কমাতে বেতন কমানোসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এভাবে বিক্রয়কর্মীরা এখন অনেকেই চাকরি হারাচ্ছেন।
শুধু এসব দোকানেই নয়, দাম বেড়ে যওয়ায় ভোগ্যপণ্যের বাজারেও বিক্রি কমে গেছে আগের চেয়ে অনেকখানি। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের মুদি দোকানদার উইসুফ জেনারেল স্টোরের মালিক মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, ‘আমার দোকানে আগের চেয়ে ৩০ শতাংশ পণ্য বিক্রি কমে গেছে।’
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘ব্যবসার পরিস্থিতি এখন খুবই খারাপ। আপনারা হয়তো দেখেছেন এক দোকানদার বর্তমান সময়ের ব্যবসার হালচাল তুলে ধরে একটি প্যারোডি গান গেয়েছেন, যেটি ভাইরাল রয়েছে। সে গানে যেভাবে ব্যবসাসার দূরবস্থার কথা তুলে ধরা হয়েছে বাস্তব চিত্র তার চেয়েও খারাপ। মার্কেট-শপিংমলের ব্যবসায়ীরা এখন পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।’
এদিকে অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘সারা দেশের মার্কেট ও শপিংমলের ব্যবসায়ীরা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তারা সঙ্কটে পড়া মানে দেশের অর্থনীতির সঙ্কট আরও বাড়বে। সেই সঙ্গে এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লাখ লাখ তরুণ-যুবক-যুবতী চাকরি করেন। তারা বেকার হয়ে যাচ্ছে। এতে সামাজিক সঙ্কটও বাড়বে। সূত্র : সময়ের আলো