প্রতিনিধি ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ , ১২:৩৯:৫৬ প্রিন্ট সংস্করণ
(দিনাজপুর২৪.কম) নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ার পাশাপাশি ওষুধের দাম বাড়ায় চিকিৎসা ব্যয়ে কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে এ পর্যন্ত প্রয়োজনীয় সব ওষুধের দামই বেড়েছে। কোনো কোনো ওষুধের দাম বেড়েছে শতভাগ। জীবনযাত্রায় যন্ত্রের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় মানুষের আয়েশি চালচলনের কারণে নির্দিষ্ট বয়সের পর দৈনিক কিছু ওষুধ খেয়ে যেতে হয় এমন মানুষের সংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে। ‘নতুন করে ওষুধের দাম বাড়ায় মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও শ্রমজীবী মানুষ ওষুধ ব্যবহার কমিয়ে দিচ্ছে। যা না খেলে জীবনই বাঁচবে না, কেবল সেগুলো রেখে অন্য ওষুধের ব্যবহার বেশ কমছে।’ ঢাকা শহর ও ঢাকার বাইরের ওষুধের দোকানগুলোতে ঘণ্টাখানেক বসে থাকলেই মানুষের কম ওষুধ কেনার প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, ওষুধ কেনাসহ চিকিৎসা ব্যয় বাবদ ৬৮ শতাংশ অর্থ খরচ করতে হয় ব্যক্তির নিজের পকেট থেকে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বর্তমানে প্রতিটি ব্যক্তিকে চিকিৎসা ব্যয়ের ৭৪ শতাংশ নিজের পকেট থেকে করতে হচ্ছে। বাকি ২৪ শতাংশ খরচ নানাভাবে তারা পেয়ে যায়। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার গাইডলাইনে বলেছে, ‘চিকিৎসা ব্যয়ের ৩০ শতাংশের বেশি নিজের পকেট থেকে খরচ করলে সেই ব্যক্তি দারিদ্র্যের দুষ্টু চক্রে ঢুকে যাবে। ৩০ শতাংশের বাইরে সব চিকিৎসা ব্যয়ই সরকারকে করা উচিত।’ স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ‘চিকিৎসায় ব্যয় করতে গিয়ে প্রতি বছর ভুক্তভোগীদের ৬৪ লাখ দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যাচ্ছে।’ তারা বলছেন, ‘বর্তমানে মানুষের চিকিৎসা ব্যয়ের একটি বড় অংশই খরচ হয়ে থাকে ওষুধে দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন বৃদ্ধির এ সময়ে ওষুধের দাম বাড়ার কারণে মানুষকে এখন ওষুধে ব্যয় কমাতে হচ্ছে, ভবিষ্যৎ সার্বিক অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়তে বাধ্য।’
গত জুলাই মাসের মাঝামাঝিতে দেশে একসাথে ৫৩টি ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। এই ওষুধগুলোর বেশির ভাগই অত্যাবশ্যক বা এসেনসিয়াল তালিকার। এই তালিকার ওষুধের দাম কোম্পানি নিজে থেকে বাড়াতে পারে না। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পূর্বানুমতি নিয়েই কোম্পানিগুলো বাড়িয়েছে। এর বাইরে ইন্ডিকেটিভ তালিকার ওষুধের দাম বাড়ছেই, এটা কোম্পানিগুলো ইচ্ছা করে বাড়াতে পারে।
এ ব্যাপারে ওষুধ প্রশাসনের লোকজন কথা বলতে চান না। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মূত্রপাত্র মো: আইয়ুব হোসেনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি একবারও ফোন ধরেননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওষুধ প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘এসেনসিয়াল তালিকার যে ওষুধগুলো আছে সেগুলো উৎপাদন করে উৎপাদক কোম্পানির মুনাফা হয় না বলে তারা সে ওষুধগুলোর উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছিল। দাম কম বলে এই ওষুধগুলো সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যেই ছিল, তারা এগুলো কিনতে পারে। এখন সামান্য কিছু বাড়িয়ে দেয়ায় ওষুধ কোম্পানির আর লোকসান হবে না, ওষুধ কোম্পানিও এসব ওষুধ তৈরি করবে। অপর দিকে সাধারণ মানুষও ওষুধগুলো কিনতে পারবে।’ তিনি বলেন, ‘তা ছাড়া জ্বালানি তেল ও ডলারের দাম বাড়ার কারণেও উৎপাদন খরচ বেড়ে গিয়েছিল ওষুধ কোম্পানির। দাম বাড়ানোর কারণে এখন তারা কিছুটা লোকসান পুষিয়ে নিতে পারবে।’
এ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ গতকাল শনিবার বলেন, ‘সম্প্রতি ৫৩টি ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। দাম বাড়ানোর কিছুটা যৌক্তিকতা ছিল ডলার ও তেলের কারণে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের যেখানে নাভিশ্বাস উঠে যাওয়ার অবস্থা, এ সময়ে ওষুধের দাম না বাড়িয়ে কিছুদিন পরে বাড়ালেও হতো। এর মধ্যে সরকার ওষুধ কোম্পানিগুলোকে নানাভাবে সুবিধা দিয়ে রাখতে পারত। যেমন কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক রেয়াত দেয়া যেত। সরকারের হাতে আরো অনেক কিছু উপায় (টুলস) ছিল যা প্রয়োগ করে এ মুহূর্তে ওষুধের দাম আগের অবস্থায় রাখতে পারত।’
ড. হামিদ আরো বলেন, ‘এখন দু’ধরনের ওষুধের তালিকা রয়েছে। তা বাদ দিয়ে ফর্মুলাভিত্তিক মূল্য তালিকা করা হোক। তাহলে ওষুধ কোম্পানি ইচ্ছা করলেই দাম বাড়াতে পারবে না।’
দাম বাড়ার কারণে কোনো কোনো পরিবারে ওষুধ কেনার পেছনে আগের চেয়ে দ্বিগুণ ব্যয় করতে হচ্ছে। কেউ যদি আগে ওষুধের পেছনে এক হাজার টাকা ব্যয় করতেন এখন তাকে দুই হাজার টাকা করতে হয়। কিন্তু বাড়তি টাকা কিভাবে আসবে সে প্রশ্নের উত্তর কারো কাছে নেই।
রামপুরার বাসিন্দা শরিফাইন বেগম বলেন, ‘তিনি ডায়াবেটিসের রোগী। তাকে তিন বেলা ইনসুলিন নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। তার স্বামী রফিকুল ইসলামকে দিনে ৩টা ওষুধ খেতে হয়। স্বামীর হার্ট, স্ট্রোক, ডায়াবেটিসের তিন ওষুধের দাম ১৮০ টাকা। শরিফাইন বেগমকে ইনসুলিনের পেছনে মাসে এক হাজার টাকা ব্যয় করতে হতো। কিন্তু এখন তাদের ওষুধের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘চাকরিজীবী পরিবারের পক্ষে বাড়তি ব্যয় করা কঠিন। এখন সামনে রাস্তা একটাই তা হলো হয় ওষুধে কাটছাঁট করা, নয়তো খাবার কেনা কমিয়ে দেয়া। তিনি বলেন, বেঁচে থাকার জন্য কোনোটাই করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, মাঝে মাঝে চিন্তা করি- মরে গেলে ভালো হতো, নয়তো সম্পদ বিক্রি করে এসবের ব্যয় মেটাতে হবে।’
সবচেয়ে বেশি যে ওষুধগুলো দোকানে বিক্রি হয় সেগুলোর মধ্যে প্যারাসিটামল, রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ব্যথানাশক ও গ্যাস্ট্রিক সমস্যার ওষুধ। এ ওষুধগুলোর দাম ৫০ থেকে ১৩৪ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
অধ্যাপক হামিদ বলেন, জীবনরক্ষাকারী সব ওষুধকে অত্যাবশ্যক তালিকায় রেখে এগুলোর দাম যেন না বাড়ে সে জন্য সরকারের উচিত হস্তক্ষেপ করা। তা না হলে ‘জনস্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব পড়বে। অর্থনীতির চাকা শ্লথ হয়ে যাবে, সার্বিক প্রবৃদ্ধি কম হবে।’
প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বহুল ব্যবহৃত ২০টি জেনেরিকের (মূল ওষুধ) ৫৩টি ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন মাত্রার প্যারাসিটামলের দাম বাড়ানো হয়েছে ৫০ থেকে শতভাগ। ৪০ টাকার এমোক্সিসিলিনের দাম করা হয়েছে ৭০ টাকা, ২৪ টাকার ইনজেকশন ৫৫ টাকা। ৯ টাকার নাকের ড্রপের দাম করা হয়েছে ১৮ টাকা। কোনো কোনো ওষুধের দাম ৯৯ থেকে ১৩২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
প্যারাসিটামল ৫০০ এমজি ট্যাবলেটের দাম করা হয়েছে ১ টাকা ২০ পয়সা, আগে ছিল ৭০ পয়সা।
প্যারাসিটামল ৫০০ এমজি ট্যাবলেট র্যাপিডের দাম করা হয়েছে ১ টাকা ৩০ পয়সা, আগে ছিল ৭০ পয়সা। প্যারাসিটামল ৬৫০ এমজি ট্যাবলেট এক্সআর’র দাম করা হয়েছে ২ টাকা, আগে ছিল ১.৩১ টাকা। প্যারাসিটামল ১০০০ এমজি ট্যাবলেটের দাম করা হয়েছে ২.২৫ টাকা, আগে ছিল ১.০৪ টাকা।
প্যারাসিটামল ৮০ এমজি ড্রপস ৩০ এমএল বোতলের দাম হয়েছে ৩০ টাকা, আগের দাম ১৮ টাকা। প্যারাসিটামল ১২০ এমজি/৫ এমএল সিরাপ (১০০ এমএল) বোতলের দাম করা হয়েছে ৫০ টাকা, আগের মূল্য ২৭.৭২ টাকা। মেট্রোনিডাজল ২০০ এমজি ট্যাবলেট কোটেড আগের মূল্য ছিল ৬০ পয়সা, বর্তমান মূল্য ১ টাকা। মেট্রোনিডাজল ২৫০ এমজি ট্যাবলেট কোটেড আগের মূল্য ৯২ পয়সা, বর্তমান মূল্য ১.২৫ টাকা। মেট্রোনিডাজল ৪০০ এমজি ট্যাবলেট কোটেড আগের মূল্য ১.৩৭ টাকা, বর্তমান মূল্য ১.৭০ টাকা। মেট্রোনিডাজল ৫০০ এমজি ট্যাবলেট কোটেড আগের মূল্য ১.৬৬ টাকা, বর্তমান মূল্য ২ টাকা। মেট্রোনিডাজল ২০০ এমজি/৫ এমএল সাসপেনশন ৬০ এমএল বোতলের আগের মূল্য ২৬ টাকা, বর্তমানে ৩৫ টাকা। মেট্রোনিডাজল ২০০ এমজি/৫ এমএল সাসপেনশন ১০০ এমএল বোতলের আগের মূল্য ৩৪.৯২ টাকা, বর্তমানে ৪৫ টাকা। মেট্রোনিডাজল ৫০০এমজি/১০০ এমএল ইনফিউশন ১০০ এমএল বোতলের আগের মূল্য ৭৪.৩৫ টাকা, বর্তমানে ৮৫ টাকা।
জাইলোমেট্রোজালিন এইচসিআই ০.০৫% ন্যাসাল ড্রপ ১৫ এমএলের আগের দাম ৯.৬০ টাকা, বেড়ে হয়েছে ১৮ টাকা। একই ওষুধের এইচসিআই ০.১% ন্যাসাল ড্রপ ১৫ এমএলের আগের দাম ১০.০৪ টাকা, বেড়ে হয়েছে ২০ টাকা। প্রোকলেপেরাজিন ৫এমজি ট্যাবলেট, আগের দাম ৪০ পয়সা, বেড়ে হয়েছে ৬৫ পয়সা। প্রোকলেপেরাজিন ১২.৫ এমজি ইনজেকশন, আগের দাম ৪.৩৬ টাকা, বেড়ে হয়েছে ৯ টাকা। ডায়াজেপাম ১০ এমজি/২ এমএল ইনজেকশন আগে ছিল ৩.২২ টাকা, বেড়ে হয়েছে ৭ টাকা।
মিথাইলডোপা ২৫০ এমজি ট্যাবলেটের আগের দাম ১.৫০ টাকা, এটি ১৩৪ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৩.৪৮ টাকা। মিথাইলডোপা ৫০০ এমজি ট্যাবলেটের আগের দাম ৫.১৩ টাকা, বেড়ে হয়েছে ৬.০৯ টাকা। এর বাইরেও অনেকগুলো ওষুধের দাম বেড়েছে। সূত্র : নয়া দিগন্ত