উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি এনামুল ও হাবিব বলেন, প্রায় মাসখানেক আগে মিয়ানমার থেকে উখিয়া ক্যাম্পে আসেন একই পরিবারের ছয়জন। এই ক্যাম্পে তাদের কোনো আত্মীয় না থাকায় তারা সীমান্তে ট্রানজিট ক্যাম্পে (আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ ক্যাম্প) যান এবং সেখানে তাদের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। তারা বলেন, রোহিঙ্গাদের অনেকেই মিয়ানমারে আছে জিম্মিদশায়। জীবন বাঁচাতে এপারে চলে আসতে চান তারা। কিন্তু সীমান্তে কড়াকড়ি থাকায় প্রবেশ করতে পারছেন না। রোহিঙ্গাদের একটি সূত্র জানায়, মিয়ানমারে বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় রাখাইন রাজ্যে কিছুদিন ধরে অব্যাহতভাবে সংঘর্ষ চলছে। ওপারে যারা রয়েছে তাদের অনেকের কাছে মোবাইল রয়েছে। সেখানকার পরিস্থিতি বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যারা রয়েছেন তাদের মোবাইলে জানাচ্ছেন। এ জন্য আতঙ্কে অনেকেই বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রবেশ করতে চাইছে।
ওই সূত্র আরও জানায়, অন্তত আটশ রোহিঙ্গা সাগরের চরে রয়েছে। তারা বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে। কিন্তু বাংলাদেশ সীমান্তে কড়াকড়ি থাকায় এই দেশে আসতে পারছে না। সাগরের চরে ওই আটশ রোহিঙ্গা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে।
সম্প্রতি ৫০ জন রোহিঙ্গার প্রবেশের বিষয়ে ইউএনএইচসিআর অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিউনিকেশন অফিসার মোস্তফা মো. সাজ্জাদ হোসেন বৃহস্পতিবার বলেন, ‘আমাদের জানা মতে নতুন রোহিঙ্গারা এসেছেন, তাদের বেশ কয়েকজনের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন ক্যাম্পসংশ্লিষ্টরা। তবে ঠিক কতজনের নাম রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে তা সঠিক বলতে পারছি না। তবে এটা ঠিক, তাদের রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে।’
শুক্রবার মিয়ানমার থেকে এসেছে দুই কিশোর-কিশোরী। তারা ৬ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি ব্লকে আছে। তাদের নাম মঞ্জুর রহমান (১৪) ও রুকেয়া (১৮)। এরা দুজন ভাই-বোন।
অন্যদিকে মিয়ানমারে বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় রাখাইন রাজ্যে কয়েকদিন ধরে অব্যাহতভাবে সংঘর্ষ চলছে। এতে বিশেকরে বান্দরবানের ঘুমধুম ও তুমব্রু সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন।
প্রতিদিন গুলির শব্দ শোনা যায় তুমব্রু সীমান্তে। অন্যদিকে মিয়ানমারে থাকা রোহিঙ্গাদের কয়েকজনের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। এক পক্ষ বলছে, সেখানে তারা চাপে আছেন। অন্য পক্ষ বলছে ঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে সেখানকার সেনাবাহিনী। আতঙ্কের কারণে মিয়ানমার থেকে আবারও বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের শঙ্কা শুরু হয়েছে। রোহিঙ্গাদের সম্ভাব্য অনুপ্রবেশ নিয়ে সতর্ক অবস্থানে আছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
অন্যদিকে যেমন রাখাইনে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর লড়াই চলছে তেমনি গত মে মাস থেকে কায়াহ, কাইন ও চিন রাজ্যেও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে বড় ধরনের সামরিক অভিযান শুরু করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এই যুদ্ধে হেলিকপ্টার ও যুদ্ধবিমানও ব্যবহার করছে ওই দেশের সামরিক বাহিনী।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, ‘সেখানে গত এক মাস ধরেই প্রতিদিন সীমান্তের ওপার থেকে গোলাগুলির আওয়াজ আসছে। গত কয়েক দিন ধরে যুদ্ধবিমান আর হেলিকপ্টার থেকে গোলা ছুড়তে দেখা গেছে। কিন্তু মিয়ানমার অংশে গুলির শব্দ আর থেমে থেমে মর্টারশেলের বিকট শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠছে তুমব্রু সীমান্ত। কখনো তাদের মর্টারশেল উড়ে আসছে এপারে। শুক্রবারও উড়ে আসে মিয়ানমারের একটি গোলাবারুদ। সীমান্তের গা ঘেঁষে টহল দেয় সে দেশের সেনাবাহিনী। মিয়ানমারের এই উদ্ভট আচরণে এপারের মানুআতঙ্কিত। কখন কী যেন উড়ে এসে পড়ে, সেই ভয় তাদের তাড়া করে সবসময়।’
৪০ নম্বর সীমান্ত পিলারের একটি রাবার বাগান শ্রমিক গোলাম মাওলা (৪৫) জানান, গত এক মাসে তাদের বাগানে দুটি মর্টারশেল এসে পড়ে এবং প্রায় সময়ই আকাশে হেলিকপ্টার চক্কর দিতে দিতে নিচে গুলিবর্ষণ করে। মাটি থেকেও ওপরের দিকে গুলি ছোড়া হয়। দূরের আকাশে চার-পাঁচটি যুদ্ধবিমান চক্কর দিয়ে হেলিকপ্টারকে পাহারা দিচ্ছিল। হেলিকপ্টার থেকে শত শত গুলি ও মর্টারশেল নিক্ষেপ করা হয়। বিকট শব্দে ওই এলাকায় অবস্থান না করে তুমব্রু বাজারের দিকে পালিয়ে আসেন শ্রমিকরা।
তিনি বলেন, ‘শুনতে পাচ্ছি মিয়ানমারে বাংলাদেশের সীমান্তের পাশে থাকা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে।’
গত বুধবার বিকালে বাংলাদেশ অংশে এক রোহিঙ্গা মিয়ানমার অংশে থাকা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন এই প্রতিবেদকের সামনে।
মিয়ানমার থেকে সে রোহিঙ্গা জানায়, তাদের ঘর থেকে বের হতে দিচ্ছে না মিয়ানমার সেনাবাহিনী, তবে চাপ বেশি রাখাইনদের ওপর, যারা আরাকান আর্মির সমর্থক। তারা পালাতে চায়।
রোহিঙ্গা প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসন কমিটির সভাপতি উখিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘ভারত ও সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ থেকে রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে আশ্রয় নিচ্ছে। মিয়ানমার থেকে নতুন করে রোহিঙ্গা এলে উখিয়াবাসীর আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘রোহিঙ্গারা ইয়াবা ব্যবসা, অস্ত্রবাজি ও সন্ত্রাস, ডাকাতিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে স্থানীয়দের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। আমরা স্থানীয়রা বিপদে আছি। আমরা কোথায় যাব? বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত সিলগালা করে দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা ইউএনও সালমা ফেরদৌস বলেন, ‘রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে কঠোর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। আমি স্থানীয় চেয়ারম্যান ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে শুনেছি এখনো মিয়ানমারের কোনো নাগরিক অনুপ্রবেশ করতে পারেনি।’
প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্থানীয় এলাকাবাসীদের আতঙ্কিত না হওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
৩৪ বিজিবির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘তুমব্রু সীমান্তে বিজিবি সদস্যরা সবসময়ই সতর্ক অবস্থানে আছে। নতুন করে কাউকে অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। তুমব্রু এলাকায় নতুন করে চেকপোস্ট স্থাপন করা হয়েছে। সীমান্ত এলাকায় বিজিবি কড়া নজরদারি রেখেছে।’
তবে এ বিষয়ে ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মেহেদি হোসাইন কবিরের মোবাইল ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। -নিউজ ডেস্ক