(দিনাজপুর২৪.কম) ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে কিছুদিন পরপর হিন্দু সম্প্রদায় এবং সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও উপাসনালয়ে হামলার ঘটনা ঘটে। এসব হামলা বা অগ্নিসংযোগের ঘটনায় হাজার হাজার মামলা হলেও এখন পর্যন্ত একটি মামলারও সুষ্ঠু তদন্ত এবং জড়িতদের শাস্তি হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও মন্দিরের হামলার ঘটনায় মামলার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে ২০০১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত গত ২১ বছরে পাঁচ হাজারের মতো মামলা হয়েছে। এর মধ্যে কোনোটিতে তদন্ত শেষে চার্জশিট দেওয়া হলেও উল্লেখ করার মতো কোনো রায় বা শাস্তি হয়নি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য মতে, ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ৯ বছরে হিন্দুদের ওপর সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে মন্দিরে হামলা ও আগুনের ঘটনা দেড় হাজারের বেশি। এসব হামলা ও মামলার পরিসংখ্যান এবং তদন্তের অগ্রগতি জানতে গত দুই সপ্তাহ ধরে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও পিবিআই ছাড়া কারও সাড়া মেলেনি।
সারা দেশে এবার ৩২ হাজার ১৬৮টি মণ্ডপে পূজা উদযাপন হবে। এবারের দুর্গাপূজা নিয়েও হিন্দু সম্প্রদায়সহ সংখ্যালঘুদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে। বিদ্যমান আইনে সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তদের বিচার করা সম্ভব নয় জানিয়ে বিশেষ আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন আইন সংশ্লিষ্টরা।
গণমাধ্যমের তথ্যে দেখা গেছে, এবার পূজার প্রস্তুতির মধ্যেই গত ১৮ সেপ্টেম্বর বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার দুর্গা মন্দিরের নির্মাণাধীন প্রতিমা ভাঙচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। এ ছাড়া গত ১২ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়া জেলা শহরে সার্বজনীন পূজা মন্দিরে ও গত ২৭ আগস্ট মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
অতীতে সহিংসতার ঘটনায় উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মামলার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পবিত্র কোরআন অবমাননার ছবি ট্যাগকে কেন্দ্র করে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের রামুতে ১২টি বৌদ্ধ বিহার এবং ৩০টি বসতঘরে হামলা চালায় দুর্বত্তরা। পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে একইভাবে উখিয়া ও টেকনাফে আরও সাতটি বৌদ্ধ বিহারসহ ১১টি বসতঘরে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা।
ভুক্তভোগীরা বলেন, রামুর সহিংসতার ঘটনায় এজাহারভুক্ত ৩৭৮ জনসহ অজ্ঞাতনামা আরও প্রায় দেড় হাজার লোককে অভিযুক্ত করে ১৯টি মামলা করা হয়েছিল। এর মধ্যে একটি মামলা আপসে নিষ্পত্তি হয়। এ ছাড়া পুলিশ বাদী হয়ে করা ১৮টি মামলায় এক হাজার ২০ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। কিন্তু ঘটনার ১১ বছরেও সহিংসতার ঘটনায় জড়িত কারও বিচার হয়নি। হামলায় জড়িতদের আসামি না করায় কেউ সাক্ষ্য দিতে যায় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে রামু কেন্দ্রীয় মহাসীমা বিহারের পরিচালক শীলপ্রিয় থের বলেন, ‘যারা হামলা করেছিল তাদের কারও শাস্তি হয়নি। এমনকি তাদের মামলার আসামিও করা হয়নি। এ কারণে কেউ সাক্ষ্য দিতে যায় না।’
এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেছেন, ‘বিচারাধীন ১৮ মামলায় ১৬৭ সাক্ষীর অধিকাংশই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের। একাধিকবার তাগাদা দেওয়ার পরও কেউ সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসেন না। সাক্ষী না আসায় বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হয়েছে।’
২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর রংপুরের গঙ্গাচড়ায় ফেসবুক পোস্টে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে হিন্দুদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ এবং সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ওই সময় শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। এ বিষয়ে পূজা উদযাপন পরিষদের গঙ্গাচড়া থানা সভাপতি ক্ষ্যান্ত রানী রায় বলেন, ‘মামলার অগ্রগতি সঠিকভাবে বলতে পারব না।’ তবে রংপুর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট একেএম হারুন অর রশিদ বলেন, ‘অনেক আগেই এ মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন। সাক্ষী হাজির চলছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন সাক্ষ্য দিয়েছেন। গ্রেফতার আসামিদের সবাই জামিনে।
২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বনগ্রাম বাজারে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে অর্ধশত হিন্দু বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। সাঁথিয়া পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি সুশীল কুমার দাশ বলেন, ‘মামলার পর অনেক সময় পার হওয়ায় এখন অগ্রগতি বলা সম্ভব না।’
তবে স্থানীয় সাংবাদিক ও তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সহিংসতার ঘটনায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে একটি এবং ভাঙচুরের ঘটনায় একটিসহ দুটি মামলা হয়। যা সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের সবাই জামিনে। ২০১৬ সালের ২৯ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু পল্লিতে ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় স্থানীয় থানায় সাতটি এবং আইসিটি আইনে একটিসহ মোট আটটি মামলা করা হয়েছিল। এ ঘটনায় পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি হরিপদ পোদ্দার বলেন, ‘কিছু মামলার তদন্তে অগ্রগতিসহ চার্জশিট দাখিল হয়েছে। একটিতে সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তবে কোনো মামলায় চূড়ান্ত রায় হয়নি।’
২০২০ সালের ১৮ মার্চ হেফাজত নেতা মামুনুল হকের ফেসবুক পোস্টে সমালোচনার অভিযোগে সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও হিন্দু পল্লিতে হামলার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় দুটি মামলা হয়। এ মামলার অগ্রগতি নিয়ে শাল্লা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তরুণ কান্তি দাশ বলেন, ‘মামলাগুলো এখনও তদন্ত পর্যায়ে। একটিতেও রায় হয়নি। গ্রেফতার আসামিদের সবাই জামিনে রয়েছেন।’
এ বিষয়ে শাল্লা থানার ওসি মো. আমিনুল ইসলাম মামলাগুলো বিচারাধীন জানিয়েই লাইন কেটে দেন।
এ ছাড়া গত বছর ১৩ অক্টোবর ভোরে কুমিল্লার নানুয়ার দিঘির পাড়ে অস্থায়ী পূজামণ্ডপে কুরআন পাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে কুমিল্লাসহ চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, ফেনী, গাজীপুর, কুড়িগ্রাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কক্সবাজার, মুন্সীগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও বরিশালে বহু বাড়িঘরে হামলা এবং প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়। এসব ঘটনায় ওই সময়ে শতাধিক মামলা হয়। শুধু কুমিল্লা ও চাঁদপুরে ৫৬টি মামলা হয়েছে। সারা দেশে মোট কতটি মামলা হয়েছে এবং সেগুলো কী অবস্থায় আছে জানতে পুলিশ সদর দফতরসহ বিভিন্ন ইউনিটে যোগাযোগ করা হলেও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ছাড়া অন্য কারও সাড়া পাওয়া যায়নি।
পিবিআই সূত্র জানায়, গত বছরের সহিংসতার মামলাগুলোর মধ্যে তারা ২৬টি মামলার তদন্ত করছে। এর মধ্যে ১৪টি মামলার চার্জশিট দাখিল ও একটি মামলার ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ১১টি মামলা তদন্তাধীন। ২৬টি মামলার মধ্যে কুমিল্লার রয়েছে চারটি, নোয়াখালীর ১১টি, চাঁদপুরের তিনটি, মৌলভীবাজারের দুটি, চট্টগ্রাম ও বাগেরহাটের একটি করে এবং কক্সবাজার ও বান্দরবানের চারটি। এসব মামলার আসামিদের মধ্যে পিবিআই ১৭২ জনকে গ্রেফতার করেছিল, যাদের ১২৮ জন জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
পূজা উদযাপন পরিষদের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘হিন্দু সম্প্রদায় ও মন্দিরের হামলার ঘটনায় মামলার সংখ্যা সঠিকভাবে নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তবে ২০০১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২১ বছরে এ সংখ্যা পাঁচ হাজারের মতো হবে। এর মধ্যে ২০০১ সালে বিএনপি সরকারের আমলে তিন হাজারের মতো মামলা ছিল। পরবর্তী সময়ে বর্তমান সময় পর্যন্ত আরও দুই হাজারের মতো মামলা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এই পর্যন্ত একটি মামলারও সুষ্ঠু বিচার হয়নি। এমনকি একটি মামলার সুষ্ঠু তদন্তও হয়নি। শাস্তি তো আরও দূরের কথা। সরকার আন্তরিক নয় বিধায় এসব মামলার সুষ্ঠু তদন্ত যেমন হচ্ছে না, তেমনই সুষ্ঠু বিচারও হচ্ছে না। লোক দেখানো কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিছুদিন না যেতেই তারা আবার জামিনে বেরিয়ে আসে।’ এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘২০০১ সালে বিএনপি আমলের মামলার ঘটনায় সাবেক জেলা জজ সাহাবুদ্দিন চুপ্পু কমিশন বিচারের জন্য সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, তার সরকার কোনো মামলার বিচার করতে পারবেন না।’
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোটেক রানা দাশ গুপ্ত বলেন, ‘বিদ্যমান আইনে সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তদের বিচার করা যেমন সম্ভব না, তেমনই শাস্তি দেওয়াও সম্ভব না। এ ক্ষেত্রে বিশেষ আইন দরকার।’ তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘বিশেষ আইনের কারণে ৪২ বছর পরেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা সম্ভব হয়েছে। সে রকম ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন’ করা হলে এখন না হোক, পরবর্তী সময়ে এসব মামলার বিচার করা যাবে।’ -অনলাইন ডেস্ক