(দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) আসন্ন রমজানের আগে দেশে খেজুরের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় গত সোমবার (৪ মার্চ) রমজানে ইফতারে খেজুর না খেয়ে বরই ও পেয়ারা খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। তার এমন বক্তব্য ঘিরে সোশ্যাল মিডিয়া এবং রাজনীতি অঙ্গনে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
সোমবার ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানের শেষে শিল্পমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, খেজুর নিয়ে আমাদের অভাব অভিযোগ আছে। বরই দিয়ে ইফতার করেন। খেজুর-আঙুর কেন লাগবে? ওই দিন বিকেলেই রাজশাহীর এক সমাবেশে তার বক্তব্যের জোরালো প্রতিবাদ জানান সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমি বরই দিয়ে ইফতার করবো। আর তুই খেজুর-আঙুর খাবি? তা হবে না, তা হবে না। এমন অবস্থায় ইফতারিতে বরই খেজুরের বিকল্প হতে পারে কিনা, সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।
পুষ্টিবিদরা বলছেন, সারাদিন রোজা রাখার পর ইফতারে খেজুর সবচেয়ে উপকারী। যার সঙ্গে অন্য কোনও খাবার বা ফলের তুলনা চলে না। তারা আরও বলছেন, ফল কিংবা খাদ্য হিসেবে বরই কখনও খেজুরের বিকল্প হতে পারে না।
বাংলাদেশসহ গোটা মুসলিম বিশ্বেই রমজানের ইফতারিতে খেজুর খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। যেটিকে সুন্নত হিসেবে বলছেন ইসলামিক চিন্তাবিদরা। তারা জানাচ্ছেন, মুসলিম সমাজে ইফতারে খেজুর খাওয়ার প্রচলন রয়েছে নবী মুহাম্মদ (সা.) এর অনুসরণেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, ইফতারিতে খেজুর খাওয়া মানুষের আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু জিনিসটা আমাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে ভোক্তাদের মধ্যে এ নিয়ে অতৃপ্তি, অসন্তোষ ও অস্বস্তির জায়গা তৈরি হয়েছে। আগামী সপ্তাহ (সোমবার বা মঙ্গলবার) থেকে শুরু হচ্ছে রমজান। দেশে সারাবছর খেজুরের চাহিদা রয়েছে। তবে রোজায় তা বেড়ে যায় অনেক। এ সুযোগে খেজুরের দাম এবারো আগেভাগে বেড়েছে। গত বছর বেশ কম দর দেখিয়ে ফলটি আমদানি করা হয়। যে কারণে এবার শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এ হার বাড়ানোর কারণ দেখিয়ে খেজুরের দাম বাড়ানো হয়েছে। সেই সঙ্গে তৈরি করা হয়েছে কৃত্রিম সংকট।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর বলছে, আগে প্রতি কেজি খেজুরের দাম ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা ছিল। এখন ভালো মানের খেজুর বিক্রি হচ্ছে দেড় থেকে ২০০০ টাকায়। এমন অবস্থায় গত সোমবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানের শেষে শিল্পমন্ত্রী সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। স্বাভাবিকভাবে তাকে খেজুরের দাম নিয়ে প্রশ্ন করা হয়।
জবাবে নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন ইফতারিতে খেজুরের পরিবর্তে বরই খাওয়ার কথা বলেন। এরপর থেকেই এ নিয়ে সমালোচনা তৈরি হয়। সেসময় তিনি বলেন, আমাদের বাইরে থেকে খেজুর আমদানি করতে হয়। এখানে কী আছে? বরই দিয়ে ইফতার করেন না কেন? আঙুর লাগবে কেন? আপেল লাগবে কেন? আর কিছু নাই এদেশে? মূলত মন্ত্রীর ওই বক্তব্যের জেরেই রোজার আগে খেজুর নিয়ে এসব আলোচনা চলছে। প্রতিক্রিয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও রাজনৈতিক বক্তারা এ নিয়ে সমালোচনা করছেন বেশ জোরেশোরে। ফেসবুকের বিভিন্ন পোস্টে অনেকে লিখেছেন, খেজুরের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে মন্ত্রীরা বেফাঁস মন্তব্য করছেন। কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করে লিখেছেন, এ বক্তব্যের জেরে বাড়তে পারে বরইয়ের দামও।
রমজানে খেজুর কেন খাওয়া হয়? কিংবা খেলে কী ধরনের উপকার পাওয়া যায় তা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা পাওয়া ইসলামিক চিন্তাবিদ ও পুষ্টিবিদদের কাছ থেকে। এর ভেতর ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নানা গুরুত্বের কথা বলছেন ইসলামিক চিন্তাবিদরা। তারা বলছেন, ইফতারিতে খেজুর খাওয়া সুন্নত আমল। তাই ফলটি দিয়ে ইফতার করলে আলাদা সওয়াব পাওয়া যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, ইসলামের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) খেজুর খেতেন। তার খেজুরের প্রতি বেশি আকর্ষণের ফলে এটা তখন সবার মাঝখানে বরকতের বিষয় হিসেবে গণ্য হতো। কালের ধারাবাহিকতায় এখনও যা প্রচলিত রয়েছে। রাসুলের সঙ্গে তা আমাদের আবেগ ও ভালোবাসার সম্পর্ক।
সুন্নত কিংবা ইসলামিক ঐতিহ্যগতভাবে খেজুরের গুরুত্ব তো আছেই। সেই সঙ্গে এ ফলের পুষ্টিগুণ নিয়েও নানা তথ্য দিচ্ছেন পুষ্টিবিদরা। তারা বলছেন, প্রচুর পরিমাণ ক্যালরি থাকায় রোজা শেষে ইফতারিতে খেজুর খেলে দ্রুত ক্ষুধা নিবারণ করা যায়। সেই সঙ্গে দ্রুত দুর্বলতাও কেটে যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নাজমা শাহীন বলেন, সারাদিন রোজা রাখার পর সুগার লেভেলটা কমে যায়। সেটার জন্য ইমিডিয়েট সুগার সোর্স হিসেবে খেজুরটা তাৎক্ষণিকভাবে খুব কাজে দেয়।
পুষ্টিবিদরা বলছেন, প্রতি ১০০ গ্রাম খেজুরে ৩০১ কিলোক্যালরি এনার্জি থাকে। সেই সঙ্গে খেজুরে ময়েশ্চার, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফাইবার, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, কপার ও ভিটামিন থাকে। ফলে সারাদিন রোজা রাখার পর খেজুর থেকে একধরনের বাড়তি এনার্জি পাওয়া যায়।
ডায়েট কাউন্সেলিং সেন্টারের প্রধান পুষ্টিবিদ সৈয়দা শারমিন আক্তার বলেন, রোজার মধ্যে সারাদিন পানি খাওয়া হচ্ছে না। সে কারণে নানা সমস্যা হতে পারে। এক্ষেত্রে খেজুর খুব কাজে দেয়। তাছাড়া আমাদের শরীরে গ্লুকোজ শর্ট থাকে। যে কারণে চিনি দিয়ে শরবত পানে চেয়ে ভালো হয় যদি খেজুর খাওয়া যায়। খেজুরে কোনও ফ্যাট নাই। তাছাড়া রোজাদারের সারাদিন যে পুষ্টির ঘাটতি থাকে তা খেয়ে পূরণ করা সম্ভব। এমনকি ডায়াবেটিস রোগীরাও সেটা খেতে পারেন। খেজুরের মূল্যবৃদ্ধি ও শিল্পমন্ত্রী ইফতারিতে খেজুরের পরিবর্তে বরই খাওয়ার পরামর্শ দেয়ার পর এ নিয়ে নানা আলোচনা শোনা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও রাজনীতির আলোচনায়। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে এবারের রোজার ইফতারিতে বরই কি খেজুরের বিকল্প হতে পারবে? দেশি ফল বরইয়ের পুষ্টিগুণ ও ইফতারির তালিকায় সেটিকে রাখা নিয়ে কোনও ধরনের সমস্যা দেখছেন না পুষ্টিবিদ ও ইসলামিক আলোচকরা। তবে তারা বলছেন, খেজুরের সঙ্গে যে ধর্মীয় আবেগ ও পুষ্টিগুণের বিষয়গুলো রয়েছে, তা কখনই বরই দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়।
তাদের অনেকেই খেজুর আর বরইয়ের মধ্যে একটিকে অপরটির বিকল্প হিসেবেও মনে করেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নাজমা শাহীন বলেন, পুষ্টিগুণ চিন্তা করলে খেজুর আর বরইয়ে ক্যালরির ডিফারেন্স অনেক। বরইয়ে ক্যালরির পরিমাণ কম এবং পানির পরিমাণ বেশি থাকে। এছাড়া অন্যান্য নিউট্রিয়েন্ট বা পৌষ্টিক উপাদানগুলোও বরইতে খেজুরের তুলনায় কম থাকে।
ডায়েট কাউন্সেলিং সেন্টারের প্রধান পুষ্টিবিদ সৈয়দা শারমিন আক্তার বলেন, বরইয়ের মধ্যেও অনেক নিউট্রিয়েন্ট থাকে। যেগুলো খুবই ভালো বা উপকারী। তবে যদি বিকল্প হিসেবে চিন্তা করেন তাহলে বরই কখনও খেজুরের বিকল্প নয়।
তারা বলছেন, ইফতারিতে খেজুর খাওয়ার বিষয়টা সৌদি আরবে সহজলভ্য। তবে বাংলাদেশে নয়। সৌদির কারণেই এদেশে ইফতারিতে খেজুর রাখা মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে খেজুর যে খেতেই হবে বা বাধ্যতামূলক – ধর্মীয়ভাবে এমন বিষয় নয় বলেও অনেকে জানাচ্ছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, রমজানের ইফতারিতে খেজুর মানুষের মনের আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে। যদি সেটা সুলভ হয় তাহলে মানুষের চাহিদাটা মিটে। কিন্তু বাজারদরের ব্যাপারটা মানুষের আয়ত্তের বাইরে চলে গেলে মানুষ অস্বস্তিবোধ করে।
খেজুরের বিকল্প হিসেবে বরই খাওয়ার এ বক্তব্য নিয়ে ক্ষোভও প্রকাশ করেন তিনি। অধ্যাপক ইব্রাহিমের মতো আরও অনেকেই বলছেন, বাধ্যতামূলক না হলেও খেজুর ছাড়া রোজার ইফতারি অনেকটা অসম্পূর্ণ মনে হয়।
অধ্যাপক ইব্রাহিম বলেন, আমাদের মন্ত্রী বা দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এসব জিনিসের প্রতি সংবেদনশীল নন বলেই এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে সাধারণ মানুষকে আহত করছেন। অথচ খাদ্যসামগ্রীর দাম মানুষের আয়ত্তের মধ্যে রাখার যে দায়িত্ব, সেটি এড়িয়ে যাচ্ছেন। -অনলাইন ডেস্ক