(দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে মারা গেছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। এই ঘটনায় ওই হেলিকপ্টারে থাকা সবাই নিহত হন, যাদের মধ্যে ছিলেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমিরাবদুল্লাহিয়ান।
রোববার (১৯ মে) উত্তর-পশ্চিম ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের পর্বতঘেরা অঞ্চলে এই দুর্ঘটনা ঘটে। ওই সময় দুর্ঘটনাস্থলে ভারী বৃষ্টি এবং ঘন কুয়াশা ছিল বলেও জানা যায়।
তবে ওই দুর্ঘটনার পর থেকেই প্রশ্ন উঠেছে, হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের ঘটনা কী নিছকই দুর্ঘটনা নাকি ষড়যন্ত্র? কোন হেলিকপ্টারে ভ্রমণ করছিলেন ইরানের প্রেসিডেন্ট? এই হেলিকপ্টারের নির্মাতা কারা?
ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি যে হেলিকপ্টারে ভ্রমণ করছিলেন সেটি ছিল ‘বেল ২১২’। অবশ্য এই হেলিকপ্টারগুলোকে বর্তমানে অনেক আধুনিক এবং সময়োপযোগী করে তোলা হয়েছে, যার নতুন নাম দেওয়া হয়েছে ‘বেল টেক্সট্রন’।
টেক্সট্রন শিল্পগোষ্ঠী এই হেলিকপ্টারটি তৈরি করে। সংস্থাটির সদর দফতর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোড আইল্যান্ডে। ইউটিলিটি হেলিকপ্টার (ইউএইচ) হিসেবে এটির বিশেষ পরিচিতি রয়েছে।
ষাটের দশকের শেষ দিকে ইউএইচ-১ গোষ্ঠীভুক্ত ইরোকুইস হেলিকপ্টারের মানোন্নয়ন করে তৈরি করা হয় বেল হেলিকপ্টার। প্রথমে কানাডার সেনাবাহিনী সামরিক কাজে এটি ব্যবহার করত। পরে যুক্তরাষ্ট্রও এটির ব্যবহার শুরু করে। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থা এই হেলিকপ্টারের নির্মাতা হলেও এটি প্রথম ব্যবহৃত হয় কানাডায়। বর্তমানে এই হেলিকপ্টারটির যেই মডেল ব্যবহৃত হয়, তাতে একটির পরিবর্তে রয়েছে দু’টি ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে হেলিকপ্টারটির বহনক্ষমতা বেড়েছে।
তবে ইরানে যে বেল ২১২ হেলিকপ্টারগুলো ব্যবহৃত হয়, সেগুলো বেশ পুরনো। দেশটির অধিকাংশ বিমান কিংবা হেলিকপ্টারই পুরনো। ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর একাধিক নিষেধাজ্ঞার কারণে হেলিকপ্টার বা বিমানের আধুনিক যন্ত্রপাতি কিনতে অসুবিধায় পড়তে হয়। এমনকি, ইরানের সেনারা যে যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে, সেগুলো ১৯৭৯ সালে দেশটিতে ইসলামিক বিপ্লবের আগেও ব্যবহৃত হত।
এখন প্রশ্ন হলো, এই হেলিকপ্টারের ইতিবাচক দিক কোনগুলো? ইউটিলিটি হেলিকপ্টার হওয়ার কারণে বেল ২১২ যেকোনো প্রয়োজনে ব্যবহার করা যায়। অস্ত্রবহন থেকে শুরু করে যাতায়াত কিংবা মালবহনের জন্যও এই হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়।
বর্তমানে জাপানের উপকূলরক্ষী বাহিনী, যুক্তরাষ্ট্রের তদন্তকারী সংস্থাগুলো এই হেলিকপ্টার ব্যবহার করে। আবার থাইল্যান্ডের পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থল পৌঁছতে বেল ২১২ হেলিকপ্টার ব্যবহার করে।
ইরান কতগুলো বেল ২১২ হেলিকপ্টার ব্যবহার করে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, ইরানের নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনী এই ধরনের মোট ১০টি হেলিকপ্টার ব্যবহার করে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এভিয়েশন সেফটি এজেন্সির মতে, এই হেলিকপ্টারে পাইলট, কর্মীসহ মোট ১৫ জন চড়তে পারেন। বর্তমানে টেক্সট্রন শিল্পগোষ্ঠী নিয়ে এসেছে হেলিকপ্টারটি আরও একটি অত্যাধুনিক মডেল। যার নাম দেওয়া হয়েছে সুবারু বেল ৪১২। অত্যাধুনিক এই মডেলটিকে পুলিশ, চিকিৎসক, দমকল বাহিনী প্রায় সকলেই ব্যবহার করতে পারবে।
ইরানে যে এই হেলিকপ্টারটির আলাদা কদর রয়েছে, তা ইতোমধ্যেই স্পষ্ট। আর সেই কারণেই স্বয়ং প্রেসিডেন্ট এই হেলিকপ্টারটি ব্যবহার করতেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের ‘মধুর’ সম্পর্কের কথা সুবিদিত। পশ্চিম এশিয়ার বর্তমান সঙ্কটে তা মধুরতর হয়েছে। কারণ, পুরনো অবস্থান বজায় রেখে যুক্তরাষ্ট্র যেমন ইজরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছে, তেমনই ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠন হামাসের ইরান পাশে দাঁড়িয়েছে। ইজরায়েলের বিরুদ্ধে সিরিয়া, লেবাননের মতো দেশকে ‘প্ররোচিত’ করার অভিযোগও রয়েছে ইরানের বিরুদ্ধে।
কিন্তু ওয়াশিংটন বিরোধিতা সত্ত্বেও বাইডেনের দেশে তৈরি হেলিকপ্টারেই ভরসা করেছে ইরান। গত রোববারের এই ঘটনার পর সেই ভরসা কতটা থাকবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছে।
তবে অতীতে এই হেলিকপ্টার নিয়ে তেমন বড় কোনো অভিযোগ ওঠেনি। যদিও গত সেপ্টেম্বরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সমুদ্র উপকূলে একটি বেল ২১২ হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়েছিল। তবে সেটি ছিল ব্যক্তি মালিকানাধীন একটি হেলিকপ্টার।
২০১৮ সালেও এই হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে চার জনের মৃত্যু হয়েছিল। এই দু’টি ঘটনা বাদ দিলে আর কখনও বেল হেলিকপ্টারের দুর্ঘটনার কথা শোনা যায়নি।
তবে ইরানের প্রেসিডেন্টের হেলিকপ্টার ভেঙে পড়ার নেপথ্য কী যান্ত্রিক ত্রুটি, নাকি ‘ষড়যন্ত্র’ রয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এক্ষেত্রে ইজরায়েল এবং তাদের গুপ্তচর সংগঠন মোসাদের দিকে সন্দেহের তীর ছুঁড়ছেন অনেকেই।
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইন