স্টাফ রিপোর্টার (দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বর্তমান সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘আপনারা অনেকগুলো সংস্কারের বিষয়ে হাত দিয়েছেন। যতটা সম্ভব করুন। তবে গত ৫৪ বছরে বাংলাদেশের মানুষ যাদের হাতে নির্যাতিত হয়েছে; যারা খুন–ধর্ষণ–লুটপাট, দখল–চাঁদাবাজি করে জুলুম করেছে, তাদের নামের কালো তালিকা প্রকাশ করে দেন। জনগণ তাদের চিনুক। কারণ, নিরপেক্ষ সরকার এটা করতে পারবে, দলীয় সরকার হয়তো এটা করবে না।’
আজ শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দিনাজপুর গোর-এ-শহীদ বড় ময়দানে জামায়াতে ইসলামীর কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শফিকুর রহমান এসব কথা বলেন। এতে সভাপতিত্ব করেন দিনাজপুর জেলা জামায়াতের আমির অধ্যক্ষ আনিসুর রহমান।
কর্মী সম্মেলনের উদ্বোধন করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত সুমনের বাবা ফারুক হোসেন। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য মমতাজ উদ্দিন, মাহবুবুর রহমান, কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরার সদস্য দেলোয়ার হোসেন, আনোয়ারুল ইসলাম, আফতাবউদ্দিন মোল্লা প্রমুখ। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ২৬ লাখ কোটি টাকা চুরি করে বিদেশে পাচার করেছে বলে মন্তব্য করেন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘তারা গণতন্ত্র চায়নি, উন্নয়ন চেয়েছে। আর উন্নয়ন করতে গিয়ে রডের বদলে বাঁশ দিয়েছে, সিমেন্টের সঙ্গে ছাই মিশিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ২৬ লাখ কোটি টাকা চুরি করে বিদেশে পাচার করেছে। যখনই তাদের এসব অন্যায় দেখেছি, আমরা তার প্রতিবাদ করেছি। আমরা বুঝতাম প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমাদের কেউ গ্রেপ্তার হবেন, মারা যাবেন, গুম হতে পারেন। গুলি করে পঙ্গু বানিয়ে ফেলতে পারে। মামলা দিয়ে জেলে দিতে পারে। এরপরও শুধু আল্লাহকে পরোয়া করেছি, এসবকে আমরা পরোয়া করি নাই।’ কর্মী সম্মেলনে সনাতন ধর্মাবলম্বী এক ব্যক্তির বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির বলেন, ‘আপনারা বলেছেন এমন একটা বাংলাদেশে চান, যেখানে আর আতঙ্কে থাকতে হবে না। আমরা বলি, কারা আতঙ্কমুক্ত বাংলাদেশ দিতে পারবে, সেই দলটাকে খুঁজে বের করুন। যারা এই ৫৪ বছর আপনাদের জমিজমা অবৈধভাবে দখল করে নাই, সম্পদ লুণ্ঠন করে নাই, ইজ্জতের ওপরে হাত দেয় নাই; সেই দলটিকে আপনারা খুঁজে পাবেন। বিবেকের চক্ষু দিয়ে খুঁজলে পেয়ে যাবেন। আমরা বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে ছিলাম।’
আওয়ামী লীগ জাগরণেও জামায়াতকে ভয় পায়, ঘুমের মধ্যেও ভয় পায় বলে মন্তব্য করেন শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘তারা দফায় দফায় আমাদের বিনা টিকিটে বাইরের দেশে যাবার জন্য বলত। এখন তাঁরা কোন দেশে কোন টিকিট নিয়ে দেশ থেকে চলে গেলেন? আমরা তো দেশ থেকে চলে যেতে বলি নাই। আমরা বলি, সকল নাগরিকের এ দেশে বসবাস করার বৈধ অধিকার রয়েছে।’
এর আগে সকাল সাড়ে আটটা থেকে দিনাজপুরের বিভিন্ন উপজেলা ও আশপাশের জেলা শহর থেকে বাস-মাইক্রোবাসে করে সম্মেলনস্থলে আসেন দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে মাঠে হাজারো মানুষের সমাগম হয়। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কর্মী সমাবেশে প্রায় আড়াই লক্ষাধিক লোক সমাগম হয়।
আহতদের পরিসংখ্যান তুলে ধরে জামায়াত আমির বলেন, “আমাদের ৩৪ হাজার ভাই বোন ও সন্তান পঙ্গু হয়ে গেছেন। আমাদের হিসাব অনুযায়ী ৫০২ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে অন্ধ হয়ে গেছেন। দুনিয়ার সৌন্দর্য আর তারা দেখবে না। ৭০০ এর অধিক মানুষ এক চোখ গুলিবিদ্ধ হয়ে আরেক চোখ হারাতে বসেছে। ২৫০ এর মতো মানুষ মেরুদন্ডে গুলি লেগেছে তারা এখন অচল হয়ে গেছে। হয় ঘরে বিছানায় না হয় হাসপাতালের পরে আছেন। হয় দুই পা অবশ না হয় চার হাত পা অবশ হয়ে আছে। তারা উঠে বসতে পারেন না। খাওয়া, নামাজ সবকিছু বিছানায় করতে হয়। তারা অন্যের উপর নির্ভরশীল। আপনারা তাদের প্রতি সদয় হবেন।” তিনি আরো বলেন, “আমাদের সন্তানদের শ্লোগানই আমাদের শ্লোগান ‘আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ’। একটি মানবিক বাংলাদেশ গড়ার একটি শপথ নেই। যদি দেখেন বাংলাদেশ সঠিক পথে আছে তাহলে আমাদের ভালোবাসবেন। দোয়া দিবেন। আর অন্যায় করলে আমাদের সমালোচনা করবেন। আমরা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ দেখতে চাই। ঐক্যবদ্ধ হয়ে সকল চ্যালেঞ্জ ও ষড়যন্ত্র একসাথে মোকাবেলা করব। যুবসমাজরা তোমরা আমাকে বুড়া মনে করবে না, আমিও যুবক। ইনকিলাবের যুদ্ধে, অনাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তোমাদের সাথে আমি থাকবো ইন শা আল্লাহ।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘খুনের বিচার না হলে খুনের সংস্কৃতি বন্ধ হবে না। চাঁদাবাজের বিচার না হলে চাঁদাবাজি বন্ধ হবে না। লুটপাটের বিচার না হলে লুটপাট বন্ধ হবে না। ঘুষখোরের বিচার না হলে ঘুষ বন্ধ হবে না। সুতরাং এসব অন্যায়ের বিচার হতে হবে। আমরা চাই ন্যায়বিচারের মাধ্যমে যার যেটা পাওনা সে যেন সেটা পেয়ে যায়।’
তরুণদের উদ্দেশ্য করে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘আগামীর বাংলাদেশ তরুণদের বাংলাদেশ। আমার প্রিয় বাংলাদেশ একটি মানবিক বাংলাদেশ। মানবিক বাংলাদেশ গ—ার জন্যই আমাদের সংগ্রাম। এ সংগ্রামে আমরা আপনাদের পাশে চাই, সাথে চাই।’
দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আমরা একটি মানবিক ও কল্যাণ গড়ে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। যে সমাজে সব ধর্মের মানুষ একসাথে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে।’
বিচার বিভাগ প্রসঙ্গে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘সরকার বিচার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছিল। বিচার ব্যবস্থাকে তারা নির্বাসনে পাঠিয়েছিল। বিচারপতিরা দম্ভ করে বলত, আমরা শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ। কিন্তু তারা শপথবদ্ধ নয়, তারা ছিল শপথভঙ্গকারী রাজনীতিবিদ। আল্লাহর বিধানের বাইরে কেউ ন্যায়বিচার করতে পারবে না। দেশে যত গুম, খুন হয়েছে, তত গুম ও খুনের বিচার করতে হবে। আমরা চাই না বিনাবিচারে একজন মানুষকেও হত্যা করা হোক।
তিনি বলেন, দেশের যুবকেরা আমাদের গর্ব ও অহংকার। তাদের কাছে আমরা ঋণী। তারা জীবন দিয়ে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ উপহার দিয়েছে।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, যেখানে অপকর্ম সেখানেই আওয়ামী লীগ। কোনো অপকর্ম হলে তার দায় তারা জামায়াতের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। জামায়াতকে বিভিন্নভাবে দমন ও নিপীড়ন করেছে।
হিন্দুদের উদ্দেশে জামায়াতে ইসলামীর আমির বলেন, ‘আপনারা নিজেদের কখনো মাইনরিটি ভাববেন না। আপনারা এ দেশের নাগরিক। সম্মান ও মর্যাদার সাথে বসবাস করার অধিকার সকল নাগরিকের রয়েছে।
নারীদের প্রসঙ্গ টেনে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকার সব সময় নারীদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা দিয়েছে। তারা বলেছে, জামায়াত ক্ষমতায় গেলে নারীদের ঘর থেকে বের হতে দেবে না। অথচ জামায়াত ক্ষমতায় গেলে মর্যাদা ও নিরাপত্তার মাধ্যমে নারীরা তাদের দায়িত্ব পালন করবে।
দীর্ঘ ২০ বছর পর উত্তরের জনপদ দিনাজপুরে জামায়াতে ইসলামীর কর্মী সম্মেলন হলো। শনিবার সকাল থেকে হাজার হাজার নেতাকর্মীরা ব্যানার, ফেস্টুন ও খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সম্মেলনে যোগ দেন। সকাল ৯টার মধ্যে ব—মাঠ কানায় কানায় ভরে যায়।
কর্মী সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন দিনাজপুর জেলা জামায়াতের আমির অধ্যক্ষ আনিসুর রহমান। জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি মুহাদ্দিস ড. এনামুল হকের সঞ্চালনায় সম্মেলনের উদ্বোধন করেন শহীদ সুমন পাটোয়ারীর বাবা মো. ফারুক হোসেন
এসময় স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দিনাজপুর জেলা শাখার সভাপতি অধ্যক্ষ মোঃ আনিসুর রহমান, সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম, অধ্যক্ষ মাওলানা মমতাজ উদ্দিন, অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বেলাল, কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য ও সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মোঃ দেলোয়ার হোসেন, ২০২৪ এর গণঅভ্যুথ্যানে দিনাজপুর তথা উত্তরবঙ্গে নিহত ও আহতদের পরিবারের সদস্য, গণমাধ্যম কর্মী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়াও জামায়াতের হিন্দু নেতা বিরামপুর মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ শিশির কুমার সরকার, খানসামা উপজেলার নিতাই চন্দ্র দেব নাথ। নিতাই চন্দ্র দেবনাথ বলেন, ২৪ এর আন্দোলনে উত্তরবঙ্গের হিন্দু সম্প্রদায়কে জামায়াত-শিবির আমাদের নিরাপত্তা দিয়ে বাঁচিয়েছে। আগামীর বাংলাদেশ এ হিন্দু-খিষ্ট্রান-বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদ জামায়াতের হাতে নিরাপদ। আমরা হিন্দু-খিষ্ট্রান-বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদ জামায়াতের সাথে ঐক্য গড়ে তুলেছি। হিন্দুরা জামায়াতের কাছেই নিরাপদ।