(দিনাজপুর টোয়েন্টিফো ডটকম) বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাবে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিরোধ দেখা দেওয়ার আশঙ্কা দেখছেন বিশ্লেষকেরা। যেমন জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের বিপক্ষে। জামায়াতে ইসলামী চায় সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন। আরেক অনিবন্ধিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপি সংবিধান পুনর্লিখনের জন্য চায় গণপরিষদ নির্বাচন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ সব সংস্কার নির্বাচনের আগে শেষ করার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে জার্মানভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘সংবিধান সংস্কারের জন্য জাতীয় সংসদ লাগবে। নির্বাচনে যারা সরকার পরিচিালনার দায়িত্ব পাবে, তারা সেগুলো দেখবে। আর অন্যান্য যেসব সংস্কার অধ্যাদেশের মাধ্যমে করা সম্ভব, সেগুলো করে দ্রুত নির্বাচনের দিকে যেতে হবে।’
কিন্তু সদ্যগঠিত দল এনসিপির সংস্কার বিষয়ক কমিটির কো-অর্ডিনেটর সরোয়ার তুষার বলেন, ‘আমরা সংবিধান পুনর্লিখন চাই। আর তার জন্য আগে প্রয়োজন গণপরিষদ নির্বাচন।’
বিএনপি ঐকমত্য কমিশনে যে প্রস্তাব জমা দিয়েছে, তাতে তারা উচ্চ কক্ষ ও নিম্ন কক্ষ- এই দুই কক্ষের পার্লাামেন্ট প্রস্তাব করেছে। তবে তারা নিম্ন কক্ষের অনুপাতেই উচ্চ কক্ষের কথা বলেছে। এছাড়া গণপরিষদ নির্বাচনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে তারা। বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে সমমর্যাদায় কোনো কিছু আসতে পারে না। এ দেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদাই আলাদা। ২০২৪-কে তার সঙ্গে একই কাতারে টেনে আনা ঠিক নয়। ফলে সংবিধানের প্রস্তাবানায় যেভাবে পরিবর্তন আনার কথা বলা হচ্ছে, তার সাথে আমরা একমত নই।’
‘যারা গণপরিষদ নির্বাচন চায়, তার সারমর্ম হলো, সংবিধানের ব্যাপকভিত্তিক গণতান্ত্রিক সংস্কার। এটা তো দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ। আর এই সংস্কার তো সবাই চায়। কিন্তু তার জন্য ব্যাপকভিত্তিক আলাপ-আলোচনা প্রয়োজন। যেখানে ঐকমত্য হবে, সেগুলো করা যাবে। কিন্তু তার জন্য গণপরিষদ নির্বাচন করতে হবে কেন? আগামী সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে যে সংসদ গঠিত হবে, সেই সংসদেও তা করা যাবে।’
প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে কমিয়ে চার বছর করারও পক্ষেও নয় বিএনপি। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যের যে প্রস্তাব সেই প্রক্রিয়াতেও সায় নেই তাদের।
সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন, বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ স্প্রেডশিটে ছক আকারে দিয়ে দলগুলোর মতামত চেয়েছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সেখানে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের সুপারিশে সহমত প্রকাশ করেছে বিএনপি। তবে উচ্চকক্ষের সদস্য কীভাবে মনোনীত হবে, তা পরবর্তী সময়ে আলোচনা করে নির্ধারণ করা যাবে বলে মনে করে দলটি। অন্যদিকে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০-তে উন্নীত করার প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি। তবে নারী আসনে সরাসরি ভোট নয়, বিদ্যমান পদ্ধতিতে মনোনয়নের কথাই বলেছে তারা।
মূলত সংবিধান সংস্কার আর অন্য সংস্কারে যে সাংবিধানিক পরিবর্তনের দরকার হবে, সেখানেই মতপার্থক্য দেখা যাচ্ছে। অন্যান্য সংস্কারগুলো এই সরকারই যে অধ্যাদেশের মাধ্যমে করতে পারে সেই ব্যাপারে খুব একটা মতপার্থক্য নেই। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেসব সংস্কার, সেসব ব্যাপারে সবাই প্রায় একমত।
সরোয়ার তুষার বলেন, ‘গণপরিষদ নির্বাচন হলো সংবিধান পরিবর্তনের নির্বাচন। প্রকৃত সংস্কার করতে হলে সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে। আমরা গণপরিষদ নির্বাচন চাই। যদি ঐকমত্য হয়, তাহলে নির্ধারিত সময় (ডিসেম্বর)-এর মধ্যেই নির্বাচন সম্ভব। আমরা সব মিলিয়ে ১৬৬টির মধ্যে ২২টি প্রস্তাবে সরাসরি দ্বিমত করেছি। ২৯টিতে আংশিক একমত এবং ১১৩টিতে পুরোপুরি একমত।’
‘আমরা দুই কক্ষ সংসদের পক্ষে। কিন্তু দুটিতেই সরাসরি নির্বাচন চাই। দুই কক্ষেই প্রার্থী থাকবে। আর উচ্চ কক্ষে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন হবে। যে দল যত ভোট পাবে, সেই অনুযায়ী প্রতিনিধি পাবে। কিন্তু বিএনপি দুই কক্ষ চাইলেও তারা নিম্ন কক্ষের আসনের অনুপাতে উচ্চ কক্ষ চায়,’ বলেন তিনি।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি কমিশনে ১৬৬টি প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে কিছু মতামত দিয়েছে। তারা জাতীয় সংলাপের সময় আরো বিস্তারিত মতামত দেবে। দলটির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘তারা যেভাবে টিক মার্কে জবাব চেয়েছে, তাতে ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে৷ তাই আমরা ওই ফরম্যাটে জবাব দিইনি।’
‘সবিধান সংস্কার নিয়ে দেশের নাম পরিবর্তন, মূলনীতি পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। প্রস্তাবনায় পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়েছে। এগুলোর আমরা বিরোধী। তার জবাব তো টিক দিয়ে দেওয়া যায় না,’ বলেন তিনি।
তার কথা, ‘আবার বলা হয়েছে, গণপরিষদ নির্বাচন চান কী চান না এটার প্রেক্ষাপট কী? এটা তো প্রভোক করার মতো। আসলে একটি নির্বাচনের জন্য মিনিমাম সংস্কার দরকার, আমরা সেটা চাই। সংলাপে আমরা সেটা বলবো।’
জামায়তে ইসলামীও তাদের মতামত দিয়েছে। তারা মূলত সংখ্যানুপাতিক নির্বচনের পক্ষে মতামত দিয়েছে। তারা দ্রুত সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের পক্ষে মতামত দিয়েছে।
মোট ৩৮টি দলকে ঐকমত্য কমিশন মতামত দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। এ পর্যন্ত মোট ২০টি দল তাদের মতামত দিয়েছে। বাকিরা ঈদের পর জমা দেবে এবং তারপর জাতীয় সংলাপ শুরু হবে। যারা মতামত এখনো দেয়নি, তাদের মধ্যে বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘আমরা সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা চাই না। আর সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন চাই। মোটা দাগে আমাদের অবস্থান এরকমই হবে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জাহেদ উর রহমান বলেন, ‘সংবিধান সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য অনেক। বিশেষ করে বিএনপি অনেক কিছুই চায় না। যে যার সুবিধামতো অবস্থান নিচ্ছে। তাই ঐকমত্য অনেক কঠিন হবে।’
আর সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বড় সংস্কার, ছোট সংস্কার এগুলো বলে সময় নষ্ট না করে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচনের দিকে যেতে হবে।’সূত্র: ডয়চে ভেলে