(দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত মাসে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উদ্দেশে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলেছিলেন, ‘আল্লাহর কাছে দোয়া গরি সাম্মর বার যেন অনরা নিজর বাড়িত যাইয়ারে ঈদ গরিত পারন৷’ তবে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান গৃহযুদ্ধ তাদের ফেরার পথে এখন বড় বাধা৷
গত বেশ কয়েক দশক ধরে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিচ্ছে বাংলাদেশ৷ তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সংখ্যায় সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে ২০১৭ সালে৷ সে সময় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন দেশটির রাখাইন অঞ্চলে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছিল৷ রোহিঙ্গাদের এই আবাসস্থলে তখন জাতিসংঘের ভাষায় ‘টেক্সট বুক এথনিক ক্লিনজিং’ ঘটেছিল৷ ২০২১ সালে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানে অং সান সুচি সরকারের পতন ঘটলে দেশটির সামরিক বাহিনীর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়৷ তারপর থেকে দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে সামরিক বাহিনীর গৃহযুদ্ধ চলছে৷ ফলে, রাখাইন থেকে আরো রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছেন৷
বাংলাদেশের কক্সবাজারের জনাকীর্ণ শরণার্থী শিবির এবং ভাসান চরে বর্তমানে দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছেন৷ তারা পুরোপুরি ত্রাণ সহায়তার ওপর নির্ভরশীল৷
মিয়ানমারের সামরিক সরকার চলতি মাসের শুরুতে এক লাখ আশি হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী দেশে ফিরতে পারবে বলে জানিয়েছে৷ তারা ইতোমধ্যে তাদের পরিচয় যাচাই করেছে৷ থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে দুই দেশের মধ্যে এক সম্মেলন থেকে এই তথ্য জানানো হয়েছে৷
যাদের ফেরত নিতে চাচ্ছে মিয়ানমার তাদেরসহ আট লাখ রোহিঙ্গার নামের তালিকা বাংলাদেশ ছয় ধাপে ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশটির সরকারের কাছে পাঠিয়েছিল৷ তালিকার অন্যান্যদের পরিচয় যাচাই-বাছাই চলছে বলেও জানিয়েছে মিয়ানমার৷
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আজাদ মজুমদার জার্মানভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘যদিও এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি, তবে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য তা যথেষ্ট নয়৷ রোহিঙ্গারা সবসময়ই নিরাপদ এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন চেয়েছে৷ রাখাইন রাজ্য নিরাপদ বিবেচিত না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যাবাসন শুরুর সম্ভাবনা কম৷’
২০২৪ সালে রাখাইন রাজ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ) এবং মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর মধ্যে লড়াই তীব্র হলে কমপক্ষে ৭০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে৷ রাখাইনের বাসিন্দাদের জন্য আরেও স্বায়ত্তশাসন চায় এএ৷ ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দেয়ার সময় সেনাবাহিনীকে রাখাইনের অন্য বাসিন্দারা সহায়তা করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে৷
রাখাইন রাজ্যের বৌদ্ধদের রাজনৈতিক সংগঠন ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান (ইউএলএ)-এর সুসজ্জিত সামরিক অংশ এএ৷ বৌদ্ধ এবং মুসলমান উভয়ের জন্য রাখাইন রাজ্যে, যেটি আরাকান হিসেবেও পরিচিত, স্বায়ত্তশাসন চায় এএ এবং ইউএলক৷
বাংলাদেশ-মিয়ানমার মানবিক করিডোর চায় জাতিসংঘ
গত মাসে বাংলাদেশ সফর করেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস৷ সেসময় তিনি এবং ড. ইউনূস রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পরিস্থিতি দেখতে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির সফর করেন এবং এক লাখের মতো রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতার করেন৷
বাংলাদেশে এক সংবাদ সম্মেলনে গুতেরেস জানান যে, বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে ত্রাণ পাঠাতে একটি মানবিক করিডোর খোলার কথা বিবেচনা করছে জাতিসংঘ৷ তিনি বলেন, ‘আমাদের মিয়ানমারের ভেতরে মানবিক সহায়তা জোরদার করতে হবে, যাতে [রোহিঙ্গাদের] প্রত্যাবর্তনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়৷’ জাতিসংঘের মহাসচিব এ সময় আরো বলেন, আরাকান আর্মির সঙ্গে সংলাপে বসা জরুরি৷
এদিকে, ব্যাংককের বৈঠক থেকে ফিরে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেনটেটিভ খলিলুর রহমান নিশ্চিত করেন যে, আরাকান আর্মির সঙ্গে সংলাপ চলছে৷ তিনি বলেন, ‘২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ছয়টি ব্যাচে মোট ৮ লাখ রোহিঙ্গার একটি তালিকা মিয়ানমারকে পাঠিয়েছে৷ মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা বাকি সাড়ে ৫ লাখ রোহিঙ্গার তালিকা যত দ্রুত সম্ভব যাচাই-বাছাই শেষ করবে৷’
‘রাখাইন এখনো মিয়ানমারের একটি সার্বভৌম অঞ্চল৷ আমরা আরাকান আর্মির সঙ্গেও আলোচনা করেছি৷ তাদের ঘোষিত অবস্থান হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া৷ তারা এটা প্রকাশ্যে গত সেপ্টেম্বরে বলেছেন৷ আমাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনায় তারা এটা পুর্নব্যক্ত করেছেন,’ যোগ করেন রহমান৷
রোহিঙ্গারা কি আরাকান আর্মির দখলে থাকা রাখাইনে ফিরবেন?
জাতিগত গোষ্ঠী রোহিঙ্গা মিয়ানমারের নাগরিকত্ব না পাওয়ায় দেশটিতে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে ও রাষ্ট্রহীন অবস্থায় রয়েছে৷ মানবাধিকার লঙ্ঘন তদন্ত করা সংস্থা ফার্টিফাই রাইটসের পরিচালক জন কুইনলি ডয়চে ভেলেকে জানান যে নাগরিকত্ব এবং সমানাধিকারের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার সম্ভাবনা কম৷ তিনি বলেন, ‘রাখাইনের অধিকাংশ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করা আরাকান আর্মিকে অনেক রোহিঙ্গা বিশ্বাস করেন না৷’
তিনি আরেও বলেন, ‘রোহিঙ্গারা রাখাইনের আদিবাসী এবং তাদের ঘরে ফেরার সুযোগ পাওয়া উচিত৷ তবে সেখানে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি নাগরিকত্বের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে এবং সামরিক বাহিনী ও আরাকান আর্মিকে তাদের ঘটিয়ে চলা অপরাধের জন্য জবাবদিহির মুখোমুখি করতে হবে৷’ সেসব না করে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো উচিত হবে না বলে মনে করেন কুইনলি৷
ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা নেই সান লুইন মনে করেন যে মিয়ানমারের জান্তা সরকার সত্যিই যদি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চায় তাহলে তাদের আরো পরিষ্কার বার্তা দিতে হবে৷ বিশেষ করে প্রকাশ্যে এই ঘোষণা দিতে হবে যে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উপর বিমান হামলা বা গোলা বর্ষণ করা হবে না৷
তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা বা অন্যদের রাখাইনে পুনরায় জীবন শুরু করতে হলে আরাকান আর্মির কাছ থেকে একধরনের অনুমতি বা নথির প্রয়োজন হবে৷ পাশাপাশি মিয়ানমারের নাগরিকত্বও লাগবে৷’
রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে অব্যাহত আন্তর্জাতিক তৎপরতা
এদিকে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত পাঠাতে আন্তর্জাতিক তৎপরতা আরো বাড়াচ্ছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার৷ এজন্য চীনের সহায়তা চাওয়ার পাশাপাশি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের উদ্যোগে একটি উচ্চপর্যায়ের আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনেরও প্রস্তুতি চলছে৷
দোহায় গোলটেবিল বৈঠকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাদোহায় গোলটেবিল বৈঠকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কাতারের রাজধানী দোহায় বুধবার রোহিঙ্গা বিষয়ক এক গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কথা বলেন। কাতারের রাজধানী দোহায় বুধবার রোহিঙ্গা বিষয়ক এক গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন শুরু করতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য কাতার তাদের কূটনৈতিক প্রভাব কাজে লাগাতে পারে৷ আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে, কাতার জোরালোভাবে তাদের সংহতি প্রকাশ করে এই সংকট সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে৷’
‘এছাড়া ওআইসি দেশগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে তহবিল সংগ্রহ জোরদার ও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে মত প্রকাশের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে,’ যোগ করেন তিনি৷
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে উদ্ভূত নানা সংঘাতের কারণে আন্তর্জাতিক মনোযোগ ধীরে ধীরে রোহিঙ্গা সংকট থেকে সরে যাচ্ছে৷’ সূত্র: ডয়চে ভেলে