(দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) প্রায় তিন বছর আগে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় নাজমুল তারেক নামে এক পুলিশ কনস্টেবল লতা সমাদ্দার নামে এক কলেজ শিক্ষিকাকে তার টিপ পরা নিয়ে কটূক্তি করেন বলে অভিযোগ ওঠে। যা পরে দেশজুড়ে আলোচনার ঝড় তোলে। সেই ঘটনার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে এবং তদন্তে অভিযোগের প্রমাণ না পেলেও সেই কনস্টেবলকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এরপর নাজমুল তারেক বিষয়টি প্রমাণের জন্য পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে গিয়েছেন। প্রমাণাদি ও সাক্ষীও দিয়েছেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।
আলোচিত এই ঘটনাটি ২০২২ সালের ২ এপ্রিল ঘটে। ড. লতা সমাদ্দার শেরেবাংলা থানায় একটি অভিযোগ করেন। এরপর নাজমুল তারেককে সিসি ক্যামেরায় শনাক্ত করে পুলিশ এবং তাকে আটক করা হয়। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি হয় এবং এতে তার চাকরি চলে যায়। এরপর থেকে বেকার জীবন-যাপন করছেন এই পুলিশ সদস্য। পরবর্তী সময়ে তিনি আদালতে একটি মামলা করেন। সেই মামলা এখনো চলমান।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পালাবদলের পর অনেক ঘটনায় ভুক্তভোগীরা বিচার পেয়েছেন। অনেকে চাকরিও ফেরত পেয়েছেন। কিন্তু নাজমুল তারেক এখনো তার চাকরিতে ফিরতে পারেননি।
এ ঘটনায় সেই সময় ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের ডিসি মোহাম্মদ ফারুক জানিয়েছিলেন, তদন্ত কমিটি টিপ নিয়ে কথা হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ পায়নি। তার বক্তব্য দিয়ে সংবাদ প্রকাশ হলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ঠিক তার কিছুদিন পরই নাজমুলকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হয়।
জানা গেছে, আলোচিত ঘটনার পর পুলিশ ইমেজ সংকটে পড়ে। দেশজুড়ে বিষয়টি আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দেয়। বিষয়টি নিয়ে ডিএমপির পক্ষ থেকে একটি কমিটি করা হয়। তিন সদস্যের সেই কমিটিতে তৎকালীন তেজগাঁও বিভাগের ডিসি বিপ্লব কুমার সরকারসহ আরও দুই এডিসি দায়িত্ব পান। তারা বিষয়টি তদন্ত করে ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বরাবরে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন।
প্রত্যক্ষদর্শী নাঈম তদন্ত টিমকে যা বলেছিলেন
আলোচিত এই ঘটনায় ২১ জনকে সাক্ষী করা হয়েছিল। যাদের মধ্যে একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন নাঈম নামের এক মাস্ক বিক্রেতা। তখন সকাল সাড়ে আটটা। ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৫০-৬০ গজ দূরেই তিনি মাস্ক বিক্রি করছিলেন। এসময় তিনি দেখতে পান, ফার্মগেট থেকে খামারবাড়ী যাওয়ার সড়কে একটি হোন্ডা উল্টো পথে আসছে। তখন একজন মহিলা চিল্লাচিল্লি করে সেই হোন্ডায় থাকা পুলিশ সদস্যকে থামান এবং তার গায়ের পোশাকে থাকা ব্যাজ টেনে ধরেন। এসময় তিনি হোন্ডাটি নিয়ে কাত হয়ে পড়ে যান। এরপর হোন্ডাটি তুলে পুলিশ সদস্য রিটার্ন রোড ক্রস করে দ্রুত চলে যান। পরে সেই নারী পাশে থাকা ট্রাকিক বক্সে গিয়ে সার্জেন্টের সঙ্গে কী যেন কথা বলেন। এরপর তিনি আর কিছু দেখেননি বলে তদন্ত কর্মকর্তাদের জানান নাঈম।
তাকে তদন্ত টিমের সদস্যরা জিজ্ঞেস করেছিলেন- আপনি কি সেই সময় কোনো পোশাকধারী পুলিশকে টেনে ফেলে দিতে দেখেছেন কি না? জবাবে নাঈম বলেন, হ্যাঁ। এরপর তাকে প্রতি দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল- টিপ নিয়ে কোনো কথা বলা শুনেছেন কি না? এ প্রশ্নে নাঈমের জবাব ছিল-না। আলোচিত এই ঘটনায় একমাত্র সাক্ষী জানিয়েছেন, টিপ নিয়ে এমন কথা হয়নি এবং তিনি শোনেননি। এরপরও নাজমুলকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করে ঢাকা মহানগর পুলিশ কর্তৃপক্ষ। এমনকি তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনেরও কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি।
নাঈম মিরপুর দারুসসালামের মাজার এলাকার আকরাম হোসেনের ছেলে। পেশায় তিনি একজন মাস্ক বিক্রেতা। কয়েক দিন আগে নাজমুল তারেক তার সাথে যোগাযোগও করেছেন। কিন্তু এখন সেই নম্বরটি নাঈম পুলিশের ভয়ে বন্ধ করে রেখেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ তাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না।
তদন্ত কর্মকর্তারা এ ঘটনায় ১৫ পৃষ্ঠার একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তৎকালীন ডিএমপি কশিমনারের কাছে। এছাড়া সেই প্রতিবেদনের কপি মোহাম্মদপুর ও তেজগাঁও এডিসি ছাড়াও ডিএমপির প্রটেকশন বিভাগের এসি কপিল দেব গাইনের কাছে জমা দেন। তদন্ত প্রতিবেদনের সেই কপিতে নাঈমের দুটি বাংলালিংক ফোন নম্বর দেওয়া ছিল। তার সূত্র ধরেই এই প্রতিবেদক তার সঙ্গে সম্প্রতি যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
লতা সমাদ্দারের ফেসবুক গায়েব, ফোন নম্বরও বন্ধ!
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ ঘটনার পর থেকে লতা সমাদ্দারের ফেসবুক আইডিটি হাওয়া হয়ে গেছে। অথচ তিনি এই ঘটনার বিবরণ প্রথমে ফেসবুকেই তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু ঘটনাটি আলোচনায় এলে এবং পরে নাজমুলকে বহিষ্কার করা হলে সেই ফেসবুক আইডিটি আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, তদন্ত কমিটির কাছে তিনি যে ফোন নম্বরটি দিয়েছিলেন সেটিও এখন বন্ধ রয়েছে। তার ব্যাপারে তেজগাঁও কলেজে খোঁজ করা হলে কেউ তার ফোন নম্বর দিতে চায়নি।
আলোচিত এই ঘটনায় অভিযোগকারীর ফোন নম্বর ও ফেসবুক আইডি বন্ধ থাকায় নানা প্রশ্ন ওঠেছে।

এ বিষয়ে ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের ডিসি মোহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ‘যেহেতু ঘটনাটি আমার সময় নয় তাই বলা মুশকিল। তাছাড়া যেহেতু তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল ফলে বিষয়টি নিয়ে আমার কথা বলা ঠিক হবে না।’
ডিএমপি ছাড়াও বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে পুলিশ সদর দফতরের মিডিয়া বিভাগের এআইজি এনামুল হক সাগরের সঙ্গে যোগাযোগ করা তিনি বলেন, যেহেতু বিষয়টি ডিএমপির সে কারণে তিনি কোনো মন্তব্য করবেন না।
ভুক্তভোগীর মামলা দায়ের
সেই ঘটনায় অবশেষে তেজগাঁও কলেজের শিক্ষিকা লতা সমাদ্দার ও নাট্য অভিনেত্রী সুবর্ণা মোস্তফাসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে ঢাকার একটি আদালতে মামলা করেছেন কনস্টেবল নাজমুল তারেক। গত ১৭ এপ্রিল ঢাকার চিফ ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে তিনি মামলাটি করেন। এই মামলায় লতা সমাদ্দার ও সুবর্ণা মোস্তফা ছাড়া নাট্য অভিনেতা আনিসুর রহমান মিলন, সাজু খাদেম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচ্যকলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মলয় মালা, প্রাণ রায়, সায়মন সাদিক, মনোজ প্রামাণিক, স্বাধীন খসরু, চয়নিকা চৌধুরী, আশনা হাবিব ভাবনা, জ্যোতিকা জ্যোতি, উর্মিলা শ্রাবন্তী কর, দেবী সান, নাজনীন নাহার চুমকী, সুষমা সরকার ও কুসুম সিকদারকে আসামি করা হয়েছে।
এবিষয়ে পুলিশের সাবেক কনস্টেবল নাজমুল তারেক বলেন, ‘বানোয়াট ও ষড়যন্ত্রমূলক এ ঘটনায় আমার এবং গোটা পুলিশ বাহিনীর ইমেজ নষ্ট হয়েছে। সে সময় যারা ঘটনাটি না জেনেই আমাকে দোষী করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানাভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে আমি মানহানির মামলা করেছি।’
সাবেক এই পুলিশ সদস্য বলেন, ‘আমার ওপর অন্যায় করা হয়েছে। আমি আমার চাকরি ফেরত চাই। চাকরি ফেরত পেতে আদালতে মামলা করেছি। সেদিন অভিযোগকারী লতা সমাদ্দারের সাথে টিপ নিয়ে কোনো কথাই হয়নি। কিন্তু কয়েক দিন দেখতে পাই আমি নাকি তাকে টিপ নিয়ে গালমন্দ করেছি বলে তিনি টিভিতে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। বিষয়টি সম্পূর্ণ বানোয়াট ও মিথ্যা এবং উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত। সেই ঘটনাটি আবারও তদন্ত করে দোষী লতা সমাদ্দারের বিরুদ্ধে পুলিশকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করব। সেই সাথে আমরা চাকরিটা আমি ফেরত চাই।’ -ডেস্ক রিপোর্ট