(দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) সাড়ে পাঁচ বছর আগে বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার মামলায় ২০ আসামির মৃত্যুদণ্ড ও ৫ আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রেখে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে।
১৩১ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপি গত মাসের শেষ দিকে হাতে পেয়েছেন বলে শনিবার জানিয়েছেন আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ২০ জনের মধ্যে বিচারিক আদালতের রায়ের সময় থেকেই তিনজন পলাতক ছিলেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আরেক আসামি মুনতাসির আল (জেমি) গত বছরের ৬ আগস্ট গাজীপুরের হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে পালিয়ে যান।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে আবরার ফাহাদ- কেবল এই অভিযোগেই তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে অভিযুক্তরা। কিন্তু কোনো বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তিদের দ্বারা এমন নির্মম নির্যাতন ও অমানবিকভাবে কাউকে হত্যা করার যুক্তি হতে পারে না। যাদেরকে (অভিযুক্তদের) বুয়েটের মেধাবী ছাত্র বলেও দাবি করা হয়। এই হত্যাকাণ্ড ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। বিচারিক আদালত সাক্ষ্য- প্রমাণের ভিত্তিতে আসামিদের যথাযথ সাজা দিয়েছে। সাজা পরিবর্তন করার মতো কোনো অনিয়ম খুজে পায়নি উচ্চ আদালত। তাই ডেথ রেফারেন্স অনুমোদন ও আসামিদের করা আপিল খারিজ করা হলো। রায় প্রকাশের পর এক সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়ায় আবরার ফাহাদের ভাই আবরার ফাইয়াজ গণমাধ্যমকে বলেন, রায় বহাল রয়েছে। আমরা অবশ্যই সন্তুষ্ট। আমরা আশা করব অতি দ্রুত যে প্রক্রিয়াগুলো আছে সেগুলো সম্পন্ন করে রায় কার্যকর করা হোক।
আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ বলেন, নিম্ন আদালতের রায় বহাল রয়েছে। এ রায়টা যেন অতিদ্রুত কার্যকর হয়। আমরা আপাতত সন্তুষ্ট। এ রায় দ্রুত কার্যকরে সরকারের কাছে দাবি জানাই।
সাড়ে পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একটি হলে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে। নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডে দেশজুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের সবাই ছিলেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের (এখন নিষিদ্ধ সংগঠন) নেতা-কর্মী।
এ ঘটনায় করা মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে ২০ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও ৫ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আবরার ফাহাদ হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের সবাই ছিলেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের (এখন নিষিদ্ধ সংগঠন) নেতা-কর্মী। এ ঘটনায় করা মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে ২০ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও ৫ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
মামলায় আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন), আপিল ও জেল আপিলের ওপর শুনানি শেষে বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান (বর্তমানে আপিল বিভাগের বিচারপতি) ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ১৬ মার্চ রায় ঘোষণা করেন। হাইকোর্ট বিচারিক আদালতের রায় বহাল রাখেন।
ওই দিন আসামির আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু জানিয়েছিলেন রায়ের সার্টিফাইড কপি হাতে পাওয়ার পর তারা আপিল দায়ের করবেন।
আইনজীবীরা জানিয়েছেন, হাইকোর্টের এই রায় চূড়ান্ত বিচার নয়। এই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হলে আসামিপক্ষ আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করবে। আপিলের চুড়ান্ত শুনানি শেষে আপিল বিভাগ চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করবেন।
সেই রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ দায়ের হলে সেটিও নিষ্পত্তি করবেন আপিল বিভাগ। রায়ে হাইকোর্টের রায় বহাল থাকলে রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি যাবে কারাগারে। কারা কর্তৃপক্ষ কারাবিধি অনুযায়ি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ব্যবস্থা করবেন। তবে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার সুযোগ পাবেন।
দণ্ডিত ২৫ আসামি: মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা ২০ আসামির সবাই বুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থী। তারা হলেন মেহেদী হাসান (রাসেল), মো. অনিক সরকার, মেহেদী হাসান (রবিন), ইফতি মোশাররফ, মো. মনিরুজ্জামান, মো. মেফতাহুল ইসলাম, মো. মাজেদুর রহমান, মো. মুজাহিদুর রহমান, খন্দকার তাবাককারুল ইসলাম, হোসাইন মোহাম্মদ তোহা, মো. শামীম বিল্লাহ, এ এস এম নাজমুস সাদাত, মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম, মুনতাসির আল (জেমি), মো. শামসুল আরেফিন, মো. মিজানুর রহমান, এস এম মাহমুদ, মোর্শেদ-উজ-জামান মণ্ডল, এহতেশামুল রাব্বি ও মুজতবা রাফিদ।
এ ২০ জনের মধ্যে বিচারিক আদালতের রায়ের সময় থেকেই তিনজন পলাতক। তারা হলেন মোর্শেদ-উজ-জামান, এহতেশামুল রাব্বি ও মুজতবা রাফিদ। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আরেক আসামি মুনতাসির আল (জেমি) গত বছরের ৬ আগস্ট গাজীপুরের হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে পালিয়ে যান।
বিষয়টি গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানায় কারা কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল থাকা আসামিরা হলেন মুহতাসিম ফুয়াদ হোসেন, মো. আকাশ হোসেন, মুয়াজ আবু হুরায়রা, অমিত সাহা ও ইশতিয়াক আহমেদ। এ মামলায় সব মিলিয়ে দণ্ডিত ২৫ আসামির মধ্যে চারজন পলাতক বলে রায় ঘোষণার দিন (গত ১৬ মার্চ) জানিয়েছিল রাষ্ট্রপক্ষ।
ফৌজদারি কোনো মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে কারও মৃত্যুদণ্ড হলে তা কার্যকর করতে হাইকোর্টের অনুমোদন লাগে, যেটি ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে পরিচিত। পাশাপাশি দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আসামিরা জেল আপিল ও নিয়মিত আপিল করতে পারেন। সাধারণত ডেথ রেফারেন্স ও এসব আপিলের ওপর একসঙ্গে হাইকোর্টে শুনানি হয়ে থাকে।
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর বুয়েটের শেরেবাংলা হল থেকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরারের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় তার বাবা বরকতউল্লাহ ঢাকার চকবাজার থানায় মামলা করেন। মামলার তদন্ত শেষে একই বছরের ১৩ নভেম্বর বুয়েটের ২৫ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘আসামিরা পরস্পর যোগসাজশ করে ছাত্রশিবিরের কর্মী সন্দেহে মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে আবরারকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছেন।’
শিবির সন্দেহে আবরার ফাহাদকে নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে পিটিয়ে তাঁকে হত্যা করা হয়: মামলায় ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর রায় দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১।
রায়ে বিচারক বলেছিলেন, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে একে অপরের সহায়তায় শিবির সন্দেহে আবরার ফাহাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অভিযোগ আনেন এবং নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে তাকে হত্যা করেন। এ ঘটনা দেশের সব মানুষকে ব্যথিত করেছে। বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে আর কখনো না ঘটে, তা রোধে সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।
আবরার হত্যা মামলায় আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের (ডেথ রেফারেন্স) জন্য বিচারিক আদালতের রায়সহ নথিপত্র ২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এসে পৌঁছায়, যেটি ডেথ রেফারেন্স হিসেবে নথিভুক্ত হয়।
অন্যদিকে ওই দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আসামিরা আপিল ও জেল আপিল করেন। ডেথ রেফারেন্স ও এসব আপিলের ওপর একসঙ্গে গত ২৪ ফেব্রয়ারি শুনানি শেষে হাইকোর্ট ১৬ মার্চ রায় ঘোষণা করেন।
হাইকোর্ট ডেথ রেফারেন্স অনুমোদন করেন এবং আপিলগুলো খারিজ করে রায় দেন। ফলে বিচারিক আদালতের দণ্ডাদেশ বহাল থাকে। -নিউজ ডেস্ক