(দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) দেশের একটি জেলার প্রশাসনের মূল অভিভাবক হচ্ছেন জেলা প্রশাসক (ডিসি)। তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। জেলার সার্বিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষা, ভূমি ব্যবস্থাপনা এবং সরকারের বিভিন্ন নীতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন তিনি। এছাড়া জেলা প্রশাসক ওই জেলার জনগণের সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন।
গত কয়েক বছরে এই গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তারা বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের শিরোনাম হয়েছেন বারবার। ডিসিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তো অহরহই পাওয়া যায়। এর বাইরে গত কয়েক বছরে নারী কেলেঙ্কারি, সাংবাদিক নির্যাতনসহ বিভিন্ন অনৈতিক কাজে ডিসিদের জড়ানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সবশেষ শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক আশরাফ উদ্দিনের নারী কেলেঙ্কারির বিষয়টি টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। এর আগে জামালাপুরের সাবেক ডিসি আহমেদ কবীরের নারী সহকর্মীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক, বরগুনার সাবেক ডিসি মো. হাবিবুর রহমানের নারী কেলেঙ্কারি, দিনাজপুরের সাবেক ডিসি মাহমুদুল আলমের অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ, কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীনের বিরুদ্ধে সাংবাদিক নির্যাতনের অভিযোগ এবং বরগুনার সাবেক ডিসির আপত্তিকর ভিডিও ক্লিপ দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
নারীর সঙ্গে শরীয়তপুরের ডিসির ঘনিষ্ঠ ভিডিও, তোলপাড়
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শরীয়তপুরের ডিসি আশরাফ উদ্দিনের ৫৭ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে জেলা প্রশাসককে এক নারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখা যায়। ভিডিওতে দেখা যায়, তিনি ওই নারীকে কোলে তুলে নিয়ে চুম্বন করছেন। ভিডিওর বিষয়ে বিতর্ক শুরু হলে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি।
ভুক্তভোগী নারী গণমাধ্যমকে জানান, ডিসি তাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং তার দাম্পত্য জীবন নষ্ট করেন। অভিযোগে তিনি বলেন, ‘তিনি আমার স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স করিয়ে সম্পর্ক গড়েন। এখন বিয়ের কথা অস্বীকার করে আমাকে হুমকি দিচ্ছেন।’
জেলা প্রশাসকের অফিস সূত্রে জানা গেছে, মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিন ২০২৪ সালের ৩ নভেম্বর শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ২৭তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। এর আগে তিনি নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টের পরিচালক ছিলেন।
ঘটনাটি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করলে শনিবার বিকেল পর্যন্ত কোনো তদন্ত কমিটি গঠিত হয়নি। তবে প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে বলে জানা গেছে। এছাড়া শুক্রবার (২০ জুন) বিকেল থেকে ডিসি জেলার বাইরে রয়েছেন বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শরীয়তপুরের একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বলেন, ‘শুক্রবার বিকেল থেকে তিনি শরীয়তপুর জেলায় নেই। কোথায় গেছেন, তা আমি জানি না।’
নারী কেলেঙ্কারিতে শাস্তি পেয়েছিলেন জামালপুরের ডিসি
২০২১ সালের ২২ আগস্ট রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জামালপুরের তৎকালীন ডিসি আহমেদ কবীরের আপত্তিকর একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়। ৪ মিনিট ৫৮ সেকেন্ডের ভিডিওটিতে আহমেদ কবীরকে তার কার্যালয়ের এক নারী অফিস সহায়কের সঙ্গে অফিস কক্ষের সংযুক্ত রুমে আপত্তিকর অবস্থায় দেখা যায়। পরে ওই ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এতে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন ডিসি কবির।
ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ায় কেলেঙ্কারির মুখে আহমেদ কবীরকে ওএসডি করা হয়। এরপর জামালপুরে নতুন ডিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় পরিকল্পনামন্ত্রীর একান্ত সচিব (উপসচিব) মোহাম্মদ এনামুল হককে।
অভিযুক্ত আহমেদ কবীরকে প্রথমে অভিযোগ জানিয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। লিখিত কারণ দর্শানোর সঙ্গে তিনি ব্যক্তিগত শুনানি চান। কোনো জবাবেই তার বক্তব্য গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তার বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (বাজেট) মাসুদুল হাসানের প্রথম দফায় করা তদন্তে ভুল থাকায় দ্বিতীয় দফা তদন্তের প্রতিবেদন দিলে সেটি গ্রহণ করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আহমেদ কবীরের বেতন গ্রেড কমিয়ে তাকে শাস্তি প্রদান করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এছাড়া তিনি আর পদোন্নতি পাবেন না বলে জানানো হয়।
সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা-২০১৮ অনুযায়ী এটি কম দণ্ডের শাস্তি। সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা-২০১৮ অনুযায়ী গুরুদণ্ড হিসেবে শাস্তির যে বিধান রাখা হয়েছে সেগুলো হলো- নিম্নপদ বা নিম্নবেতন গ্রেডে অবনমিত করা, বাধ্যতামূলক অবসর, চাকরি থেকে অপসারণ, চাকরি থেকে বরখাস্ত করা। আর সবচেয়ে লঘুদণ্ডের শাস্তি হলো- নিম্নবেতন গ্রেডে অবনমিত করা।
দিনাজপুরের ডিসি মাহমুদুল আলমের বিরুদ্ধে নারীর ভিডিও বার্তা
২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে দিনাজপুরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক (ডিসি) মাহমুদুল আলমের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়ানোর অভিযোগ তোলেন এক নারী। এক ভিডিও বার্তায় ডিসির সঙ্গে নিজের অনৈতিক সম্পর্কের তথ্য ফাঁস করেন ওই নারী নিজেই। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয় ভিডিওটি।
ভিডিও বার্তায় ওই নারী বলেন, নানা প্রলোভন দেখিয়ে আমার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন ডিসি মাহমুদুল আলম। তার সেই ফাঁদে পা দিয়ে ভেঙেছে আমার সংসার। তিনি আমাকে হত্যার হুমকিও দিয়েছেন। সংবাদ প্রকাশ করে দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম। তখন তোপের মুখে দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম এর সম্পাদক মো. শাহ্ আলম নূর আকাশ। সংবাদ ডিলিট করার জন্য সম্পাদক এস.এন.আকাশকে নানান ভাবে হুমকি-ধামকি দেয়া হয়। কিন্তু সংবাদটি অনলাইনকে সরিয়ে নেয়া হয়নি বা ডিলিট করা হয়নি।
ভিডিওতে তিনি আরও বলেন, ডিসি মাহমুদুল আলম বিভিন্ন প্রতিশ্রুতিতে আমার সঙ্গে অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। পরে তিনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। তার সঙ্গে আমার ভিডিও কল রেকর্ড, মোবাইল কল রেকর্ডসহ যাবতীয় তথ্যাদি মুছে দিতে বলেন। সেই সঙ্গে বিষয়গুলো কাউকে না জানাতে বলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে তার অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। যদিও অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছিল কি না সেটা পরে আর জানা যায়নি।
নারী কর্মীকে কুপ্রস্তাব দিয়ে আলোচনায় নাটোরের ডিসি গোলামুর রহমান
২০১৮ সালে নভেম্বর মাসে নাটোরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) গোলামুর রহমানের বিরুদ্ধে এক নারী ম্যাজিস্ট্রেটকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে। এছাড়াও একই সময়ে কর্মচারীকে বেদম মারধর এবং সরকারি দফতরের বিভিন্ন কাজে অসহযোগিতা ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ করা হয় তার বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী নারী ম্যাজিস্ট্রেটের অভিযোগ, ডিসি তাঁকে ফেসবুক মেসেঞ্জারে কুপ্রস্তাব ও রাতে সার্কিট হাউসে যাওয়ার জন্য চাপ দেন। কুপ্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ায় তাকে দাফতরিকভাবে হয়রানি করেন। এর প্রতিকার চেয়ে ওই ম্যাজিস্ট্রেট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ করেন।
সূত্র জানায়, ডিসি গোলামুর রহমান ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে তার কার্যালয়ের ওই নারী ম্যাজিস্ট্রেটকে ফেসবুক মেসেঞ্জার এবং মোবাইল ফোনে কুপ্রস্তাব দেন। এই অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ডিসি বিভিন্নভাবে ওই ম্যাজিস্ট্রেটকে হয়রানি করেন। পরে ভুক্তভোগী ওই নারী ম্যাজিস্ট্রেট লিখিতভাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি অবগত করেন। এর ফলে মন্ত্রণালয় তাকে অন্যত্র বদলি করে। এছাড়া আর্ট কলেজের আরেক ছাত্রীকে কুপ্রস্তাব এবং নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
২০১৮ সালে ৯ সেপ্টেম্বর নাটোরের জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন গোলামুর রহমান। ২০তম বিসিএস ব্যাচের এই ক্যাডার অফিসার সর্বশেষ কর্মরত ছিলেন শিপিং করপোরেশনের ম্যানেজার হিসেবে।
সাংবাদিক পিটিয়ে আলোচিত হন কুড়িগ্রামের ডিসি সুলতানা পারভীন
২০২০ সালের মার্চ মাসে গভীর রাতে সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানকে ফিল্মি স্টাইলে দরজা ভেঙে বাড়িতে ঢুকে, পা বেঁধে মারধর এবং চোখ বেঁধে জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে তৎকালীন কুড়িগ্রামের তৎকালীন ডিসি সুলতানা পারভীনের বিরুদ্ধে। নির্যাতনের পর ওই সাংবাদিককে আধা বোতল মদ ও দেড়শ গ্রাম গাঁজা পাওয়ার অভিযোগ এনে ওই রাতেই তাকে এক বছরের কারাদণ্ড দিয়ে জেলে পাঠানো হয়। এরপর থেকেই ডিসি সুলতানা পারভীন আলোচনায় ছিলেন।
এ ঘটনা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নজরে এলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রংপুর বিভাগীয় কমিশনারকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। রংপুর বিভাগীয় কমিশনার অফিসের কর্মকর্তারা তদন্ত করে প্রতিবেদনের খসড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠায়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ডিসির কাজে অনিয়ম পাওয়ায় তাকে প্রত্যাহারের আদেশ দেয়। সুলতানা পারভীনের ২ বছর বেতন বৃদ্ধি স্থগিত করা হয়। তবে পরবর্তী সময়ে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। এছাড়া তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
বরগুনার ডিসি হাবিবুর রহমানের আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল
এদিকে ২০২৩ সালের অক্টোবরে বরগুনার সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. হাবিবুর রহমানের সঙ্গে এক নারীর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। দুটি ক্লিপের একটি ৬ মিনিট ১৭ সেকেন্ডে এবং অপর ক্লিপে ১ মিনিট ১০ সেকেন্ডের আপত্তিকর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যায়। পরবর্তী সময়ে তাকে ওএসডি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। -নিউজ ডেস্ক