(দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) শোকেসের ভেতর সাজিয়ে রাখা হয়েছে বেশ কিছু ক্রেস্ট, সনদপত্র, ছবি, আর একটি চশমা। চশমাটি বের করে মা আঞ্জুমান আরা (৪০) শাড়ির আঁচলে কাচ মুছলেন। কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন চশমার দুই পাশে—এ যেন ছেলের চোখ দুটো খুব কাছ থেকে দেখছিলেন তিনি। চোখে জল এসে গিয়েছিল, কিন্তু তার আগেই আঁচলে মুছে ফেললেন।
গতকাল সোমবার রাতে ঢাকার ধামরাইয়ে শহীদ আফিকুল ইসলাম সাদের স্মৃতিচিহ্নগুলো দেখাচ্ছিলেন তার মা। যখন ছেলের ব্যবহৃত চশমাটি দেখালেন, তখন এমন আবেগঘন দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। আফিকুল ইসলাম সাদ ছিল সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। ৫ আগস্ট দুপুরে ধামরাই সরকারি হার্ডিঞ্জ স্কুল অ্যান্ড কলেজের মূল ফটকের সামনে পুলিশের গুলিতে আহত হয়, চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮ আগস্ট মৃত্যুবরণ করে।
আঞ্জুমান আরা বলেন, ‘সব সময় ছেলের স্মৃতিগুলো আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। মনে হয়, সাদ এখনো আমার পাশেই আছে। কিন্তু ‘মা’ ডাকটা আর শোনা যায় না। সবসময় মুখে হাসি থাকা ছেলেটা আজ নেই। তার বই, খেলনা; সবই আগের মতোই পড়ে আছে। ওর খুব ইচ্ছা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার, সেটি আর পূরণ হলো না।’
তিনি আরও বলেন, ‘সাদকে যারা গুলি করে হত্যা করেছে, আরও যেসব মায়ের বুক খালি করেছে, সেই ফ্যাসিস্ট সরকারের পুলিশদের বিচার আজও হলো না। যারা দেশের জন্য ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, আহত বা নিহত হয়েছে, তাদের আত্মত্যাগের উদ্দেশ্য যদি বাস্তবায়িত হতো, দেশটা যদি সত্যি শান্তিময় হতো, তাহলে এই কষ্ট কিছুটা হলেও সয়ে যেত। সন্তান হারিয়েছি, কিন্তু শান্তির বাংলাদেশ তো দেখি না। সবার প্রতি অনুরোধ, এই জুলাই যোদ্ধাদের রক্ত যেন বৃথা না যায়, তাদের স্বপ্নের দেশ যেন গড়ে তোলা হয়।’
সন্তানের আত্মত্যাগে গর্বিত মায়ের আক্ষেপ:
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ হন আরেক কিশোর সাফওয়ান আখতার সদ্য (১৫)। সাভারের সিআরপি রোডের ডগরমোড়ায় সদ্যদের প্রতিটি কক্ষে তার স্মৃতিচিহ্ন ছড়িয়ে আছে ক্রিকেট ব্যাট, তবলা, হারমোনিয়াম, টেবিল টেনিসের ব্যাট, পাঠ্যবই; সবই যত্ন করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। প্রায়ই সেইসব জিনিসে হাত বুলিয়ে ছেলের স্পর্শ খোঁজেন মা খাদিজা বিন জুবায়েদ।
তিনি বলেন, ‘সন্তানের আত্মত্যাগে আমি গর্বিত, কিন্তু আজও যারা বর্বরভাবে ওদের হত্যা করল, তাদের বিচার হলো না। যে প্রত্যাশা নিয়ে তারা জীবন দিয়েছিল, তা আজও অর্জিত হয়নি।’
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে ছেলের অনুরোধে বাবার সঙ্গে বাইরে যান সদ্য। কিছু সময় পর বাসায় ফিরে এলেও দুপুর সোয়া ৩টার দিকে আবার বিজয় মিছিলে যোগ দিতে বের হন। রাত সোয়া ৯টার দিকে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে স্ট্রেচারে শোয়ানো সদ্যের নিথর দেহ খুঁজে পান বাবা।
খাদিজা বলেন, ‘সন্ধ্যার পরেও ছেলে বাসায় ফিরছিল না। তার বাবা ও গৃহশিক্ষক খোঁজ করতে বের হন। রাত ৯টার দিকে ফোন করে ওর বাবা বললো, ‘সদ্যকে পেয়েছি, কিন্তু জীবিত না। আমি লাশ পেয়েছি।’ একটা বছর পেরিয়ে গেল, কিন্তু বিচার পেলাম না। দেশে এখনো খুন, ছিনতাই, রাহাজানি চলছে। যদি ছেলের হত্যার বিচার হতো, তার আত্মা শান্তি পেত, আমরাও কিছুটা সান্ত্বনা পেতাম। সরকার ক্ষমতায় থাকলেও কখনো জিজ্ঞেস করল না আমরা কী চাই। বিচার আমরা কার কাছে চাইবো?’
লাল কাপড়টি মুখে চেপে ধরে কেঁদে উঠলেন মা তানিয়া:
সাভারের ইসলামনগরে থাকেন শহীদ আলিফ আহমেদের (১৫) পরিবার। তার ঘরটি ঠিক আগের মতোই গুছিয়ে রেখেছেন মা তানিয়া আক্তার। দেয়ালে ঝুলছে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলার মেডেল। পড়ার টেবিলে রাখা বই-খাতা, সনদপত্র। পাশের দেয়ালে স্কচটেপ দিয়ে লাগানো নানা দেশের গোপন স্থান আর দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে পত্রিকার কাটিং, উত্তর কোরিয়ার রুম ৩৯, যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ব্রাদার্স আইল্যান্ড, রাশিয়ার মেট্রো-২, ব্রাজিলের স্নেক আইল্যান্ড ইত্যাদি।
আলিফ ছিল ডেইরি ফার্ম হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। শেখ হাসিনার পতনের পর আনন্দমিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে আহত হয় এবং ৭ আগস্ট মৃত্যুবরণ করে।
তানিয়া আক্তার বলেন, ‘আমার আলিফকে যারা কেড়ে নিল, তাদের বিচার চাই। এক বছর ধরে অপেক্ষা করছি, এই বুঝি আলিফ এসে ‘মা’ বলে ডাকবে। কিন্তু অপেক্ষার যেন শেষ নেই। কেউ তো ওকে ফিরিয়ে আনতে পারলো না। পাইলট হওয়ার স্বপ্ন দেখত, সেটাও আর পূরণ হলো না।’
কথার ফাঁকে ফাঁকে আলিফের মাথার ক্যাপটা গালে চেপে ধরছিলেন তানিয়া। আন্দোলনের সময় কপালে বাঁধা লাল কাপড়টি মুখে চেপে ধরে বারবার কেঁদে উঠছিলেন।
তিনি বলেন, ‘যারা শহীদ হয়েছে, তাদের ‘বিপ্লবী যোদ্ধা’ খেতাব দেওয়ার দাবি জানানো হলেও সেটি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। আর কতকাল লাগবে ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে তাদের স্বীকৃতি পেতে? তাদের জীবনী, অবদান সবার সামনে তুলে ধরার কাজ কবে শুরু হবে? যারা আমাদের সন্তানদের হত্যা করেছে, তারা এখনো দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর আমরা মায়েরা কাঁদছি। যাদের ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদের ছেলেরা প্রাণ দিয়েছিল, তারা আজ ক্ষমতা নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের আহাজারি শোনে কে?’ -নিউজ ডেস্ক