(দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) প্রায় এক যুগ আগে স্বামীকে হারানোর পর দুই সন্তান নিয়ে রাজধানীর মগবাজারে বসবাস করেন শারমিন ওয়াদুদ নিপা। স্বামীর রেখে যাওয়া একটি ফ্ল্যাট ও দোকান ভাড়া দিয়েই চলে তার সংসার। রাজনৈতিকভাবে তেমন সক্রিয় না হলেও হঠাৎ করেই এক দুঃসহ ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন তিনি।
গত শুক্রবার গভীর রাতে হাতিরঝিল থানার নয়াটোলা গ্রীনওয়ে এলাকার ৬৫৩ নম্বর বাসার ৪র্থ তলায় অবস্থিত তার ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে তিন যুবক। নিজেদের হাতিরঝিল থানা যুবদলের সদস্য ও প্রভাবশালী নেতা পরিচয় দিয়ে তারা নিপাকে আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যা দেন। এরপর অস্ত্রের মুখে জোরপূর্বক ৮০ হাজার টাকা ও আরও ২০ হাজার টাকার একটি খালি চেক নিয়ে যান।
ঘটনাটি কাউকে জানালে নিপা ও তার দুই সন্তানকে ‘কেটে নদীতে ভাসিয়ে’ দেওয়ারও হুমকি দেওয়া হয়। পরদিন রাতেও তারা বাসায় গিয়ে ফ্ল্যাট ছেড়ে না দিলে সর্বনাশ করার হুমকি দেয়। এমন অবস্থায় নিপা ও তার দুই সন্তানের দিন কাটছে আতঙ্কে।
এ ঘটনার শাওন (২৫), হাবিব (৩৫), সাজিদ (২৫) ও সানি (৩৫) নামে চার যুবকের বিরুদ্ধে হাতিরঝিল থানায় অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী নিপা। এরপর বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করে পুলিশ।

এলাকাবাসী জানায়, নিপা এক সময় আওয়ামী যুব মহিলা লীগের হাতিরঝিল থানার কমিটিতে ছিলেন। কিন্তু পরে সেভাবে আর সক্রিয় ছিলেন না। তার বিরুদ্ধে কারও কোনো অভিযোগও নেই। নিপার বোন তানজিন হামিদ মিতুল বিএনপির সাবেক মহাসচিব প্রয়াত খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের ছেলে আব্দুল হামিদ ডাবলুর স্ত্রী। ঘটনার দিন বোনের বাসায় হাজির গিয়েছিলেন মিতুল।
মিতুল জানান, সেদিন বোনের বাসায় গিয়ে চার যুবককে দেখতে পান তিনি। তাদের দুইজনের কোমরে পিস্তল ছিল। বিএনপির পরিবারের সদস্য পরিচয় দিলেও তারা মিতুলের কথা শোনেননি। বাধ্য হয়ে বোনকে নিয়ে সেই রাতেই নিকটস্থ সিটি ব্যাংকের এটিএম বুথে গিয়ে সানির হাতে ৮০ হাজার টাকা ও বাকি ২০ হাজার টাকার একটি চেক তুলে দেন।
মিতুল বলেন, ‘তারা আমার বোন, ভাগ্নে-ভাগ্নিকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে গেছে। ফলে তারা এখন চরম আতঙ্কগ্রস্ত ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।’
সোমবার বিকেলে বাড়িটির সিসিটিভি ফুটেজে ভুক্তভোগীর ফ্ল্যাটে ‘চাঁদা নিতে যাওয়া’ যুবকদের প্রবেশ ও বের হওয়ার দৃশ্য দেখা গেছে। পরে নিপা, তার বোন মিতুল, মেয়ে প্রিয়া এবং কাজিন তিতাসের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা যায় পুরো ঘটনার ভয়াল বর্ণনা।
নিপার স্কুল পড়ুয়া মেয়ে প্রিয় বলেন, ‘ওরা চারজন এসেছিল। তিনজন অপরিচিত। একজন আমার কাজিন। তারা তাকেই নিয়ে এসেছিল। এসেই আমার মায়ের কাছে বলছিল, আপনি যুব মহিলা লীগের নেত্রী ছিলেন আপনাকে লাখ টাকা দিতে হবে। তাদের দুইজনের (সাজিদ ও শাওনের) কোমরে পিস্তুল দেখেছি। ওই সময় আমরা যে কাউকে কল করব সেই উপায়ও ছিল না। তারা আমার, আমার ভাইয়ের ও মায়ের ফোনগুলো নিয়ে নেয়। এক পর্যায়ে মা বুথে গিয়ে তাদের টাকা দিতে বাধ্য হয়। তারা যাওয়ার সময় বলছিল, আপনাকে ফ্ল্যাট ছাড়তে হবে। আপনি এই ফ্ল্যাটে থাকতে পারবেন না। কারণ আমাদের মতো আরও একটি গ্রুপ আছে যারা আপনার কাছে চাঁদা চাইবে।’
প্রিয় জানায়, প্রথমে ঢুকেই বাসার নিচে পুলিশ আছে বলে জানায় তারা। এমন কথা শুনে আতঙ্কে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরেও কল দিতে সাহস পাননি তারা। দুই ভাই বোনকে যুবদল নেতা সাজিদ বলে, যেহেতু তোদের বাবা নেই তাই তাদের কেটে টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হবে।
তাদের হুমকির পরও সেদিন ফ্ল্যাট ছেড়ে যাননি তারা। প্রথম দিকে বিষয়টি পুলিশ জানাতে না চাইলেও পরে স্বজনদের পরামর্শে থানায় অবগত করেন তারা।
যুবদল পরিচয়ের যুবকরা কারা?
ভুক্তভোগীর অভিযোগে শাওন, হাবিব, সাজিদ এবং সানি নামে চার যুবকের নাম এসেছে।
হাতিরঝিল থানার বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে, হাবিব হাতিরঝিল যুবদলের বিলুপ্ত কমিটির ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। আর সাজিদ চাঁদাবাজি জড়িত বলে স্থানীয় অনেকে জানান। তার নামে একাধিক মামলাও আছে।

অন্যদিনে সানির বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে তারা হাতিরঝিল এলাকার কয়েকজন আওয়ামী লীগ পরিবারের কাছে চাঁদা দাবি করে আসছে। কেউ না দিলে হুমকি দেওয়া হয়।
এই তিনজনের মধ্যে হাবিব যুবদলের বিভিন্ন মিছিল মিটিংয়ে সক্রিয় থাকেন। এই পরিচয় কাজে লাগিয়ে হাবিব এলাকায় চাঁদাবাজি করেন।
ঘটনার দিন এই তিনজনের সঙ্গে নিপার এক আত্মীয় আসায় ঘটনার সঙ্গে তারও যোগসাজস থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আপোষের প্রস্তাব
বিষয়টি আপোষ করতে হাতিরঝিল থানা বিএনপির পক্ষ থেকে ভুক্তভোগী পরিবারটিকে নানাভাবে ‘ম্যানেজ করার’ চেষ্টা চলছে বলে নিপার এক স্বজন জানান।
আসিফ ইবনে আলম নামে নিপার এক স্বজন বলেন, থানায় অভিযোগ করার পর বিএনপির পক্ষ থেকে আপোষের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমে তারা অভিযোগ করতে চাননি। আপা মামলা করতে ভয় পাচ্ছে। কিন্তু পুলিশ বলছে যেহেতু চাঁদাবাজির ঘটনা, তাই মামলা করতেই হবে।’
ভুক্তভোগী নিপা বলেন, ‘আমরা তো মামলা করতে চাই না। যেহেতু আমার দুই সন্তান রয়েছে। কিন্তু পুলিশের কথায় এখন মামলা করতে হবে।’
হাতিরঝিল পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) নাঈম বলেন, ‘আমরা এখনো কাউকে আটক বা গ্রেফতার করতে পারিনি। তদন্তের জন্য আমরা সোমবার বিকেলে সেই বাসায় গিয়েছিলাম।’
হাতিরঝিল থানার ওসি মোহাম্মদ রাজু জানান, অভিযোগটি পাওয়ার পর তদন্ত প্রক্রিয়া চলছে। -নিউজ ডেস্ক


















