(দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) ঠাকুরগাঁওয়ে ১৪২টি ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে মাত্র ৬টি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধনের মেয়াদ রয়েছে। এর বাইরে ১৩৬টি প্রতিষ্ঠানই মেয়াদোত্তীর্ণ। কয়েক বছর আগে এসব প্রতিষ্ঠানের মেয়াদ শেষ হলেও প্রশাসন থেকে নেই কোনো তদারকি ও নজরদারি। এ কারণে অপচিকিৎসা ও ভুল রোগ নির্ণয়ের ঘটনা ঘটছে অহরহ।
অভিযোগ রয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠানের পেছনে রয়েছে প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়া। এ কারণে এসব প্রতিষ্ঠান প্রশাসনসহ কাউকে পরোয়া করে না। স্বাস্থ্য বিভাগের অভিযানের ঘোষণা থাকলেও, মাঠে তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না। মাঝে মাঝে প্রতীকী অভিযান চালিয়ে আবার সব কিছু আগের মতোই চলতে থাকে।
নিয়মানুযায়ী বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালুর আগে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে অনুমোদন নিতে হয়। মানতে হয় বেশকিছু নিয়ম-কানুন। স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য থাকতে হয় প্রয়োজনীয় চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্ট ও যন্ত্রপাতি। পৌরসভা থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়েই চালু করতে হয় এসব প্রতিষ্ঠান। শুধু তাই নয়, ক্লিনিক কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালুর জন্য স্বাস্থ্য বিভাগের লাইসেন্স ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিতে হয়। প্রতি অর্থবছরে নবায়ন করতে হয় নিবন্ধন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানা হয় না এসব নিয়ম। এসবের নিয়ম তোয়াক্কা না করেই ঠাকুরগাঁওয়ে চলছে অবৈধভাবে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো।

এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালে নিবন্ধনের মেয়াদ শেষ হয়েছে ১০টির। সেগুলো হলো, ডক্টরস ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সেবা ক্লিনিক, মায়মুনা শিশু হাসপাতাল, এলিজা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, রাফি ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বৈরচুনা পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ফ্রেন্ডস এ্যাপোলো ডায়াগনস্টিক সেন্টার, একতা ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ঠাকুরগাঁও জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও রানীশংকৈল সেন্ট্রাল ক্লিনিক।
২০১৯ থেকে ২০২০ সালে নিবন্ধনের মেয়াদ শেষ হয়েছে গড়েয়া ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনষ্টিক সেন্টার, এলিজা নার্সিং হোম, নিউ স্কয়ার হাসপাতাল, ক্লাসিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নিউ গ্রীন লাইফ ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, লাইফ এইড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হিমালয় ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ডক্টরস ক্লিনিক অ্যান্ড ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক কমপ্লেক্স, আল মদিনা ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হিমালয় ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারের।
২০২০ থেকে ২০২১ সালে নিবন্ধনের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২৩টির। সেগুলো হলো, ঠাকুরগাঁও স্বাস্থ্য সেবা হাসপাতাল প্যাথলজি, নিউ নর্দান ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, আমাদের হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নিউ রহমান ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ভুল্লী আই কেয়ার অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বসুন্ধরা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নিশা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ডক্টরস প্যাথলজি, একতা নার্সিং হোম, সেন্ট্রাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মাম ডায়াগনস্টিক সেন্টার. এম, এম ডায়াগনস্টিক সেন্টার, গ্রামীণ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, রোজিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, লাইফ এইড হাসপাতাল মাম হাসপাতাল, আল মদিনা ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নেকমরদ ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, প্রাইম ডায়াগনস্টিক কমপ্লেক্স, ঠাকুরগাঁও জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ডেলটা হাসপাতাল।

২০২১ থেকে ২০২২ সালে নিবন্ধনের মেয়াদ শেষ হয়েছে, সেভেন ডে ডায়াগনস্টিক সেন্টার, গোল্ডেন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ঠাকুরগাঁও ব্লাড ব্যাংক অ্যান্ড ট্রান্সফিউশন সেন্টার, হোম কেয়ার ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নূর ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নিউ মেডিনোভা ডক্টরস জোন অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ওহি ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বালা প্যাথলজি, সেভেন ডে নার্সিং হোম, ইএসডিও শিশু ও কমিউনিটি হাসপাতাল, ইএসডিও কমিউনিটি হাসপাতাল (প্যাথলজিক্যাল), দেশ এক্স-রে ক্লিনিক অ্যান্ড প্যাথলজি, সেফ হাসপাতাল, নিরাপদ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, রাণীশংকৈল মা ও শিশু হাসপাতাল, ডক্টরস পয়েন্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টার, মাস্টার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নিউ দেশ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মমতা হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বন্ধন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হোম কেয়ার ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
২০২২ থেকে ২০২৩ সালে নিবন্ধনের মেয়াদ শেষ হয়েছে, নিউ উত্তরা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, তৈয়বা রহমান মা ও শিশু হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নিউ এহিয়া নার্সিং হোম, আলফা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, গ্লোবাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কিউর প্যাথলজি, এমপিআর ব্লাড ব্যাংক ও সঞ্চালন কেন্দ্র, নিউরন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ফেয়ার হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, স্টার ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মমি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও মনোয়ারা ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার।
২০২৩ থেকে ২০২৪ সালে নিবন্ধনের মেয়াদ শেষ হয়েছে ৩৫টির। এর মধ্যে, দি আপডেট ডায়াগনস্টিক সেন্টার, রেইনবো ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মায়া ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যান্ড হাসপাতাল, গ্রীন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বলাকা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মুন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নিউ ক্লিয়ার ল্যাব, রেনাল কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার, নিউ গুড হেলথ ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড হাসপাতাল, মা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হেলথ কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ঠাকুরগাঁও কমিউনিটি হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মমি হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, লাহিড়ী ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ঠাকুরগাঁও বেবি অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নাহিন প্যাথলজি, সিটি ক্লিনিক, নিউ আইডিয়াল হাসপাতাল, মায়া অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সুরক্ষা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সেবা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হেলথ কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সেফ ব্লাড ব্যাংক অ্যান্ড ট্রান্সফিউশন সেন্টার, মমি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নিউ এ্যাপোলো ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নিউ মর্ডান ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মোবারক আলী চক্ষু হাসপাতাল, কেয়ার ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, পীরগঞ্জ ডায়াবেটিক হাসপাতাল, পীরগঞ্জ ডায়াবেটিক হাসপাতাল প্যাথলজি, ঠাকুরগাঁও কমিউনিটি হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ঠাকুরগাঁও কমিউনিটি হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, দেশ জেনারেল হাসপাতাল ও রেইনবো হাসপাতাল।

২০২৪ থেকে ২০২৫ সালে নিবন্ধনের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২১টির। সেগুলো হলো- কর্মফোট ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নিউ যমুনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নিউ পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মক্কা ডায়াগনস্টিক, ক্লিনিক লেন, সুরক্ষা হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ইনসাফ জেনারেল হাসপাতাল, পদ্মা শিশু অ্যান্ড মেডিসিন কেয়ার (ক্লিনিক), হাসান এক্স-রে ক্লিনিক অ্যান্ড প্যাথলজি, নির্মল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সুশ্রী নার্সিং হোম, নিউ ডে নাইট নার্সিং হোম, নিউ সেবা হাসপাতাল, হাসান জেনারেল হাসপাতাল, নর্দান মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতাল, ফেয়ার হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, শুভ প্যাথলজি, ফেয়ার এক্স-রে অ্যান্ড প্যাথলজি, সিটি ক্লিনিক, মক্কা ডায়াগনস্টিক-ক্লিনিক লেন, স্বাস্থ্য সেবা ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ডায়াবেটিক সেন্টার ও সাবা ডায়াগনস্টিক স্টোর।
শুধু মাত্র ২০২৬-২০২৭ সাল পর্যন্ত নিবন্ধন রয়েছে ৮টি ক্লিনিক-ডায়গনস্টিক ও হাসপাতালের। সেগুলো হলো, গ্রামীণ চক্ষু হসপিটাল অ্যান্ড প্যাথলজি, নিউ গড়েয়া ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ইউনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার, চেকআপ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নিউ গড়েয়া ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ইউনিট ডায়াগনস্টিক সেন্টার, বন্ধন ব্লাড ব্যাংক ও সঞ্চালন কেন্দ্র ও সন্ধানী ব্লাড ব্যাংক এন্ড ট্রান্সফিউশন সেন্টার।
সরেজমিনে দেখা গেছে, অনেক ক্লিনিকে নামেমাত্র একজন চিকিৎসকের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। অথচ তিনি বাস্তবে সেখানে দায়িত্বে নেই। কিছু প্রতিষ্ঠানে একদমই নেই কোনো ডাক্তার। ল্যাবরেটরিগুলোয় কাজ করছেন অদক্ষ কর্মচারীরা। এর ফলে ভুল রিপোর্ট ও ভুল চিকিৎসার ঘটনাও ঘটছে নিয়মিত।
নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক এক ক্লিনিকের ম্যানেজার জানান, যেসব শর্ত মেনে লাইসেন্স করাতে হয় তার অধিকাংশ শর্তই বেসরকারি হাসপাতালগুলো মানে না। আর সরকারি হাসপাতালে সব সময় সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় না, সময় লাগে। চিকিৎসকরা বাইরে থেকে করিয়ে নিতে বলেন। সরকারি হাসপাতালে থাকা দালালরা তাদের আমাদের হাসপাতালে নিয়ে আসেন। সেজন্য দালালদের কমিশন দেওয়া হয়। এজন্য আমরা সরকারি হাসপাতালগুলোর আশপাশেই প্রতিষ্ঠান দিয়ে থাকি।

অভিযোগ রয়েছে, যত্রতত্র গড়ে ওঠা এসব স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগেরই নেই রোগ নির্ণয়ের মানসম্মত যন্ত্রপাতি, অপারেশন থিয়েটার, পরীক্ষাগার, প্রশিক্ষিত সেবিকা ও ল্যাব টেকনোলজিস্ট। বিভিন্ন রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নাম দিয়ে সাইনবোর্ড টানানো থাকলেও নিয়মিত রোগী দেখতে বসেন না তারা। ধার করা খণ্ডকালীন চিকিৎসক দিয়ে চলছে জটিল অস্ত্রোপচারসহ নানা চিকিৎসা।
অনেক ক্লিনিকে রোগীরা অপ-চিকিৎসার শিকার হচ্ছেন। ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রোগ নির্ণয়ের মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। অনেক সময় সরকারি হাসপাতালে মানসম্মত চিকিৎসা মেলে না। আবার চিকিৎসা ভালো হলেও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান রোগীবান্ধব নয়। এ কারণে অনেকেই বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের ওপর নিভর্র করেন আর এ সুযোগটিই নেয় একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। তারা চিকিৎসাসেবা দেওয়ার নামে গড়ে তোলে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। আর এক্ষেত্রে অনেকেই কোনো নিয়ম-নীতির ধার ধারেন না। অনুমোদনহীন এসব হাসপাতালে চিকিৎসার নামে ব্যবসা, প্রতারণা, রোগী ভোগান্তির অভিযোগ উঠছে হরহামেশাই। এছাড়াও এসব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে প্রায় সময়ই ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগও উঠে।
সম্প্রতি, সদর উপজেলার রহিমানপুর ইউনিয়নের পাইকপাড়া গ্রামের বাসিন্দা খয়রুল ইসলাম নামে এক রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ উঠে। ঠাকুরগাঁওয়ের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মাম হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গলব্লাডার অপারেশনে অবহেলার অভিযোগ উঠেছে চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। অপারেশনের পর টানা পাঁচ দিন আইসিইউতে অচেতন থাকার পর মারা যান খয়রুল ইসলাম।
তার কয়েক দিন পরেই শহরের সুরক্ষা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সিজার করতে গিয়ে এক নবজাতকের মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। আর ভুল চিকিৎসা ও অপরিছন্নতারসহ নানান অভিযোগে শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অবস্থিত আমাদের হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং হাজীপাড়া এলাকায় অবস্থিত নিউ সূর্যের হাসি ক্লিনিকে অভিযান চালানো হয়। এসময় ভ্রাম্যমাণ আদালত দুটি প্রতিষ্ঠানকে অর্থদণ্ড প্রদান করেন এবং নিউ সূর্যের হাসি ক্লিনিককে সিলগালা করে দেন প্রশাসন।

রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, সুস্থ একজন মানুষকে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও অপ-চিকিৎসার কারণে লাশ নিয়ে ফিরতে হয়েছে। তারা এ ঘটনায় বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, একটি হাসপাতাল পরিচালনার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বৈধ সনদ, নিয়মিত নবায়ন, নারকোটিক পারমিট, পরিবেশ ছাড়পত্র, বর্জ্যব্যবস্থাপনা কাগজপত্র সত্যায়িত করে সংরক্ষণ করতে হবে, যা পরিদর্শনকালে নিরীক্ষা করতে হবে। বিশেষ সেবার ক্ষেত্রে প্রতিটির শয্যা সংখ্যা, সেবা প্রদানকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, কর্তব্যরত চিকিৎসকের নাম ও কর্তব্যরত নার্সদের নাম-ঠিকানা, ছবি, বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন, বিশেষজ্ঞ সনদ, নিয়োগ ও যোগদান বা সম্মতিপত্র লাগবে। চিকিৎসা সাহায্যকারীদের তালিকা, যন্ত্রপাতির তালিকা, বর্তমানে যেসব অস্ত্রোপচার ও যন্ত্রপাতির তালিকা হাসপাতাল প্রধানের স্বাক্ষরসহ সংরক্ষণ করতে হবে। কিন্তু কোনো হাসপাতালেই এসব শর্ত শতভাগ মানা হচ্ছে না।
হরিপুর থেকে ফারুক-বালিয়াডাঙ্গী থেকে গোলাপী বেগম-আকচা থেকে আশরাফুল হক-সালন্দর থেকে বৃদ্ধ রশিদুল ইসলাম ও শীবগঞ্জ থেকে সেবা নিতে আসা তরিকুল জানান, জেলা-উপজেলায় অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিকের দৌরাত্ম্য কমানো যাচ্ছে না কিছুতেই। একটা হাসপাতাল-ক্লিনিক করার জন্য যে সব যন্ত্রপাতি ও জনবল থাকতে হয়, তার বিন্দুমাত্র নেই। অলিগলিতে গড়ে ওঠা এসব হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসক-নার্স-টেকনোলজিস্ট তো দূরের কথা, ভুয়া ডিগ্রির লোকজন দিয়ে অবাধে চলছে প্রশাসনের নাকের ডগায়। অনেক বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের পরিবেশ অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন ও গোয়াল ঘরের মতো।
তারা আরও বলেন, অপারেশনের প্রয়োজন নেই, তারপরও অপারেশন করা হয়। টাকা নেওয়া হয় দ্বিগুণ। বিভিন্ন সময় মোবাইল কোর্ট অভিযান চালিয়ে অনেক হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে জেল-জরিমানা দিয়েছে। কিন্তু সেখানে তেমন পরিবর্তন আসে না। এগুলো কখনো বন্ধ হবে না। যারা নিয়ন্ত্রণ করে তারাই তো ভাগ পায়।
তবে হাসপাতাল ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা প্রতিবেদকের সাথে কথা বলতে রাজী হননি। প্রতিষ্ঠানের মালিককে দেখিয়ে দেন।
এ বিষয়ে শহরের সেভেন ডে নার্সিং হোম এর মালিক এটিএম আরমান হোসেন বলেন, শুধু আমার নয়, প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের কিছু না কিছু কাগজপত্র ঘাটতি থেকেই যায়। আমাদের ফাইল ২০২১ ও ২২ সাল পর্যন্ত জমা দেওয়া ছিল। এখন সেই ফাইলগুলো ঢাকায় কেন রিসিভ করছে না তা জানি না।
তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগের একটি টিম কয়েক দফা ভিজিট করে গেছে, রিপোর্টও দিয়েছে তারপরেও আমাদের নবায়নের কাগজটা এখনো আসেনি। মাঝখানের পরিবেশের ছাড়পত্র কারওই ছিল না। এখন আমরা সেই ছাড়পত্রটি সবাই পেয়েছি। আমরা অনলাইনে আবেদন করেছি তারা ঝুলিয়ে রাখলে আমাদের করণীয়’র কিছুই নেই।
ফ্রেন্ডস এপোলো ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক মো. আহসান হাবিব বলেন, আমরা আবেদন করেছি স্বাস্থ্য বিভাগ যদি এটা রিসিভ না করে তাহলে কি এতো দিন আমরা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখবো? তাছাড়া এই প্রতিষ্ঠান এখন দেখভাল করছেন সুপ্রিয় বাবলুর রহমান ভাই। তাহলে মালিকানায় আপনার নাম কেন এমন প্রশ্ন করলে তিনি এড়িয়ে যান এবং আবারও সুপ্রিয় বাবলুর রহমানকে দেখিয়ে দেন। তবে আহসান হাবিরের কথা মতো সুপ্রিয় বাবলুর রহমানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি প্রতিবেদকের ফোন রিসিভ করেননি।
ঠাকুরগাঁও স্বাস্থ্য সেবা হাসপাতাল ও প্যাথলজি এর মালিক মো. রাজিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে কথা বলতে চাননি। পরে আবারও ফোন দিলে তিনি প্রতিবেদককে জানান, তিনি আর ওই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে নেই। কয়েক মাস আগে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন।
প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বিষয়ে কথা হয় সুরক্ষা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক ডিনেল সিংহ এর সাথে। তিনি বলেন, নিবন্ধনের আবেদন অনলাইনে কথা হয়েছে। সিভিল সার্জন পরবর্তী নির্দেশনা না দিলে আমরা কিভাবে কাজ করব। তারা যদি আগের আবেদন গ্রহণ না করে ঝুলিয়ে রাখে তাহলে পরের বার কীভাবে আবেদন করব? আমাদের কাগজপত্র সবই আছে।
সেবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক মো. সবুজ শাহ বলেন, একটা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে যেসব ডুকুমেন্ট প্রয়োজন তার সবই আমাদের আছে। এটা তো অনলাইনে আবেদন। আমরা আবেদন করেছি। তারা এখনো পেন্ডিং রখেছে। এখানে কারও হাত নেই। তবে আমরা স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করছি যাতে দ্রুতই আমরা নিবন্ধনটি পাই।
রোগী হয়রানির ব্যাপারে তিনি আরও বলেন, জেলার বিভিন্নস্থান থেকে আমাদের প্রতিষ্ঠানে রোগীরা সেবা নিতে আসে। অনেক সময় স্টাফদের সঙ্গে তাদের কথা মিল হয় না বা তাদের বুঝতে ভুল হওয়ায় এই ধরনের একটু হট্রোগোল হয়ে থাকে। সার্বক্ষণিক একজন চিকিৎসক তো থাকেই। আমরা চেষ্টা করি সেবা নিতে আসা রোগীদের সর্বচ্চ সু-চিকিৎসা দিতে।
বাংলাদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স এসোসিয়েশন ঠাকুরগাঁওয়ের প্রচার সম্পাদক মো. নাজিম উদ্দীন মাহেল বলেন, জেলার প্রত্যেকটি প্রাইভেট হাসপাতাল ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসক রয়েছে। রাউন্ডের চিকিৎসক না থাকলে আমাদের লাইসেন্সই নবায়ন যোগ্য হবে না। সরকারি বিধি মোতাবেক যে সংখ্যক চিকিৎসক থাকার কথা সেই সংখ্যক নাই। কারণ জেলায় চিকিৎসকের সংকট রয়েছে। তবে কিছু কম হলেও প্রতিটি ক্লিনিকে রাউন্ডের জন্য চিকিৎসক আসে।
তিনি আরও বলেন, জেলায় যতগুলো ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে সবগুলোতে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র না থাকলেও ৭০ ভাগ প্রতিষ্ঠানে রয়েছে। আমরা খুব চেষ্টা করছি বাকিরাও যেন দ্রুত সময়ের মধ্যে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র স্থাপন করে। আগে ফায়ার সার্ভিস থেকে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রের অনুমতির জন্য কিছু টা জটিলতা ছিল। অনেক কাগজ দেখাতো হতো। এখন আর নেই।
বাংলাদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স এসোসিয়েশন ঠাকুরগাঁওয়ের সাধারণ সম্পাদক এম রাজিউল ফারুক রোমেল চৌধুরী বলেন, আমাদের এসোসিয়েশনের আওতাভুক্ত প্রায় ৫৮টি ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক রয়েছে। তার মধ্যে সবকটিরও কাগজপত্র রয়েছে। তবে যেগুলোর হালনাগাদ করা নাই সেগুলোকে নিয়ে আমরা অনেক সময় সমস্যায় পড়ি। সরকারের বিধি মোতাবেক সকল শর্ত মেনে স্বাস্থ্য বিভাগে আমরা আবেদন করি। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগে মাসের পর মাস বা বছরেও পরে থাকে এটা আর সেখান থেকে ফেরত হয়ে আসে না। সব কিছু দেয়ার পরেও যদি এটা এক বছর বন্ধ থাকে তাহলে পরের বছরের জন্য আমরা আর আবেদন করতে পারি না। ফলে সব কিছু ঠিক থাকার সত্যেও আমরা অবৈধ হয়ে যাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, দেশের ৭০ ভাগ রোগীকে স্বাস্থ্য সেবা দেয় ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো। নিয়ম হলো ১০ বেডের হাসপাতালে একজন করে চিকিৎসক থাকতে হবে কিন্তু আমাদের তো সেরকম চিকিৎসক নেই। এমনকি সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন ৪০০/৫০০ রোগী ভর্তি থাকে সেখানেও চিকিৎসক নেই। বর্তমানে যে চিকিৎসক সংকট লাখ টাকা বেতন দিলেও পাওয়া যাবে না। আমরা চেষ্টা করি নিয়মকানুন মেনে চলার। চিকিৎসক প্রতিটি ক্লিনিকে কম বেশি আছে। আমরা সরকারের সকল শর্ত মেনে চলি। যে সমস্ত ক্লিনিকের সমস্যা থাকবে সেগুলোর দায়িত্ব আমরা নেব না। অবশ্যই নিময়ের মধ্যে চলতে হবে। আমাদেরও কোনো সমস্যা থাকলে প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে এতে কোনো আপত্তি নেই।
এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স’র উপ-সহকারী পরিচালক মো. সাহিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের বাধ্যবাধকতা না থাকলেও অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা ছাড়া ক্লিনিকের লাইসেন্স দেওয়ার কথা না। সরকারি গেজেটেই রয়েছে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স নিতে গেলে অবশ্যই ফায়ারের মতামত লাগবে। ফায়ার সার্ভিসেরও লাইসেন্স প্রয়োজন রয়েছে ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিকগুলোর। আমাদের মতামত ছাড়া সিভিল সার্জন অন্যান্য কাজের অনুমতি দিতে পারে না।
অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে অভিযান প্রসঙ্গে ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসকের সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মোরশালিন তুরাগ বলেন, জেলায় অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাব সেখানেই অভিযান পরিচালনা করা হবে। ইতোমধ্যে শহরে আমাদের হাসপাতাল নামে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা আর নিউ সূর্যের হাসি ক্লিনিক সিলগলা করা হয়েছে। সেবা নিতে এসে রোগীরা যেন কোনো প্রকার হয়রানি ও ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
এসব বিষয়ে ঠাকুরগাঁও সিভিল সার্জন ডা. মো. আনিছুর রহমান তিনি বলেন, এই মুহূর্তে পৌরসভা ও উপজেলার কয়েকটি ছাড়া আর কোনো বৈধ-অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের হিসাব আমাদের কাছে নেই। তবে জেলায় মোট কতগুলো সেবাদান প্রতিষ্ঠান রয়েছে তা তালিকা করা হচ্ছে। আমরা দ্রুতই প্রত্যেক ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকের সঙ্গে বসবো। যাদের কাগজপত্র নেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, অবৈধ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলছে। এরই মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, জরিমানাও করা হয়েছে অনেককে। স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে তালিকা ধরে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। -নিউজ ডেস্ক

 
                    








 
                                     
                                     
                                     
                                    








