# বিএনপির প্রত্যাখ্যান, জামায়াত-এনসিপির সমর্থন
# জুলাই সনদ ঘিরে ফের বিভাজন
# বিভক্তিতে হতাশ সরকার
# গণভোটের সময় নিয়ে ভার্চুয়াল যুদ্ধে বিএনপি-জামায়াত
দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা ও মতবিনিময়ের পর বহুল প্রত্যাশিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ চূড়ান্ত করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সব পক্ষ কিছুটা ছাড় দিয়ে সনদে সই করলেও বাস্তবায়ন নিয়ে কমিশনের সবশেষ সুপারিশ ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখা দিয়েছে বিভাজন। কমিশনের সুপারিশকে ‘অগণতান্ত্রিক ও জবরদস্তিমূলক’ আখ্যা দিয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি তা ‘নতুন সূচনার নকশা’ হিসেবে স্বাগত জানিয়ে গণভোট ও বাস্তবায়নের দাবিতে মাঠে নামছে। ফলে ঐকমত্যের বদলে রাজনৈতিক বিভাজনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে ঐকমত্য কমিশন। রাজনীতির এমন বিরোধ ও বিভাজন নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি বলেছেন, “এতদিন আলোচনার পরও ঐকমত্য না আসলে এখন আমাদের কী করা উচিত, তা নিয়ে সত্যিই চিন্তা করতে হচ্ছে।’
জুলাই সনদ, গণভোটসহ বিভিন্ন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ নিয়ে দুঃশ্চিন্তা আছে সরকারের মধ্যে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার কী করবে তা বুঝতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা।
আসিফ নজরুল বলেন, ‘এতদিন আলোচনার পর যদি আপনাদের ঐকমত্য না আসে, এখন আমরা আসলে কীভাবে কী করব, ‘এটা নিয়ে সত্যি আমাদের একটু চিন্তা করতে হচ্ছে।’
শুরু থেকেই দলে দলে বিরোধ
ঐকমত্য কমিশনের যাত্রা শুরুর পর থেকেই দলগুলোর মধ্যে বিরোধ স্পষ্ট ছিল। বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত-এনসিপির অবস্থান ছিল ভিন্ন মেরুতে। সংসদে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা, সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে ভোট, প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদ, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল— কেবল জুলাই সনদ প্রণয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে বিপরীতমুখী অবস্থানে ছিলেন সংশ্লিষ্ট দলগুলোর নেতারা। কখনো কখনো কমিশনের বৈঠকে তীব্র বাদানুবাদেও জড়িয়েছেন নেতারা। ঘটেছে ওয়াকআউটের ঘটনাও। একাধিক ইস্যুতে বিএনপির পক্ষ থেকে নোট অব ডিসেন্ট দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও এর বাস্তবায়ন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা না পেয়ে সনদ সইয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়নি তরুণদের নিয়ে গড়া দল এনসিপি। জুলাই সনদে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিসহ নিজেদের মতামত উপেক্ষিত অভিযোগে বামপন্থি চার দলও- সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ— সে অনুষ্ঠান বর্জন করে। এই পাঁচ দল এখনো জুলাই সনদে সই করেনি। তবে বিএনপি-জামায়াতসহ ২৫টি দলের জুলাই সনদে সই করেছে।
ঐকমত্য কমিশনের জমা দেওয়া সুপারিশে বলা হয়েছে- জুলাই সনদের ধারা অনুযায়ী, ২৭০ দিনের মধ্যে সংসদে সংস্কার বিল পাস না হলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানের অংশ হবে। পাশাপাশি, সনদ বাস্তবায়নের বৈধতা নিশ্চিত করতে নভেম্বরে গণভোট আয়োজনের প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। এই দুই বিষয়ই এখন রাজনৈতিক বিতর্ক বাড়িয়েছে। যা নিয়ে রাজপথে কর্মসূচিও পালন করা হচ্ছে।
সুপারিশ প্রত্যাখ্যান ক্ষুব্ধ বিএনপির
ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশকে প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, জুলাই সনদে থাকা ‘নোট অব ডিসেন্ট’গুলো সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে, যা গ্রহণযোগ্য নয়। কমিশন জাতির ওপর এই সুপারিশ জোরজবরদস্তি চাপিয়ে দিয়েছে।
তিনি অভিযোগ করেন, ‘কমিশনের আলোচনায় ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত বেশ কিছু দফা তাদের অগোচরেই পুনর্লিখন করা হয়েছে। সরকার এবং কমিশন এক হয়ে সংবিধান সংশোধনের নামে নতুন ষড়যন্ত্র করছে।
অন্যদিকে ঐকমত্য কমিশনের পুরো বৈঠকে দলের নেতৃত্ব দেওয়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ হতাশার কথা বলেছেন।

সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘রেফারিকে আমরা কখনো গোল দিতে দেখিনি। এখন মনে হচ্ছে, ঐকমত্য কমিশন, সরকার ও কয়েকটি দল একই দলে খেলছে। সংবিধানের ৪৮টি দফা নিয়ে প্রস্তাব তৈরি হয়েছে, অথচ বিএনপির সঙ্গে কোনো আলোচনাই হয়নি।’
রাজবাড়ীকে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করেন, ‘জুলাই সনদে বিএনপির স্বাক্ষরিত পাতা পরিবর্তন করে কমিশনে নতুন কপি জমা দেওয়া হয়েছে।’
নভেম্বরে গণভোটের দাবি নিয়ে মাঠে জামায়াত
এদিকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশকে সাদরে গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটি জানিয়েছে, জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের আগে গণভোট সম্পন্ন করতে হবে।
বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘জুলাই সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন আইনগতভাবে নিশ্চিত করতে হবে। নভেম্বরে গণভোট আয়োজনই হবে নতুন বাংলাদেশের সূচনা। জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট না হলে রাজনৈতিক সংকট আরও গভীর হবে।
এর আগে বুধবার জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘গণভোটের সিদ্ধান্ত সরকারকেই নিতে হবে। বিলম্ব ঘটলে নির্বাচনের সময়সূচিও পিছিয়ে যেতে পারে।’
সনদে সই না করেও সমর্থন এনসিপির
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখনো জুলাই সনদে আনুষ্ঠানিকভাবে সই করেনি। তবে কমিশনের সুপারিশকে ‘গঠনমূলক পদক্ষেপ’ হিসেবে স্বাগত জানিয়েছে দলটি।
এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দিন পাটওয়ারী বলেন, ‘কমিশনের প্রস্তাবিত প্রস্তাব-২-এর বিষয়ে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য নেই। এর ফলে গোটা সংস্কার কার্যক্রমই ভণ্ডুল হয়ে যেতে পারে। প্রস্তাব-১ এর ক্ষেত্রে কিছু জায়গায় অস্পষ্টতা চিহ্নিত করে তা সংশোধন করতে হবে।
বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে পাটোয়ারী বলেন, সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালার ড্রাফট প্রকাশ্যে আনতে হবে এবং ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। এটা যদি না হয়, আর দেশ যদি গৃহযুদ্ধের দিকে যায়, তার দায় প্রধান উপদেষ্টাকে নিতে হবে।
হতাশা ও ক্ষোভ গণঅধিকার পরিষদে
অন্যদিকে গণঅধিকার পরিষদ কমিশনের ভূমিকা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছে। সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, ঐকমত্য কমিশন নোট অব ডিসেন্ট বাদেই সরকারের কাছে সুপারিশ দিয়েছে। এতে নয় মাস সময় ও রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় হলো। ৮৪টি বিষয়ে গণভোট নেওয়ার কথা থাকলেও কমিশন কেবল কিছু দলের মতই গুরুত্ব দিয়েছে।
বিরোধে হতাশ সরকার
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় এবং গণভোটের সময় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধ তীব্রতম পর্যায়ে পৌঁছেছে জানিয়ে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পক্ষ শক্তিগুলোর মধ্যে এই বিরোধ হতাশাব্যাঞ্জক।
গণভোট নিয়ে বিএনপি-জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ নিয়ে উপদেষ্টা বলেন, এটা দুর্ভাগ্যজনক। ২৭০ দিন যাবত আলাপ-আলোচনার পর প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্যের মধ্যে যে অনৈক্যের সুর দেখছি এটা হতাশাব্যঞ্জক। এই তীব্র বিরোধের মধ্যে কীভাবে সমঝোতার দলিল পাস; এটা খুব দুরূহ একটা চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে এনে দিয়েছে। -নিউজ ডেস্ক

 
                    








 
                                     
                                     
                                     
                                    








