(দিনাজপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম) ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার উমেদপুর বাজার। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। বাজারের পাশে খোলা জায়গায় কয়েকটি বেঞ্চ বসানো। সেখানে গোল হয়ে বসেছেন দশ থেকে বারোজন ব্যক্তি, যাদের সবাই সনাতন ধর্মের অনুসারী।
তাদের মধ্যে দলীয় লিফলেট বিতরণ করছিলেন স্থানীয় জামায়াতের এক নেতা। জিজ্ঞেস করতেই জানালেন, সনাতন ধর্মের অনুসারীদের নিয়ে এটি তাদের একটি দলীয় সভা।
তার ভাষায়, সভায় যারা এসেছেন, তারা সবাই জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক।
আমরা কয়েক মাস ধরে সনাতন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে কাজ করছি। তারা রাজনৈতিকভাবে আমাদের সমর্থক হয়েছেন, দাঁড়িপাল্লার সমর্থক হয়েছেন, বলছিলেন উমেদপুর ইউনিয়ন জামায়াতের আমির মো. শওকত আলী।
তিনি জানান, জামায়াতের কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা এসেছে— ভিন্ন ধর্মের মানুষদের কাছেও দলের রাজনৈতিক আহ্বান পৌঁছে দিতে হবে।
ঝিনাইদহে জামায়াত যেভাবে হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের নিয়ে কাজ করছে, সম্প্রতি এরকম আরও বিভিন্ন ঘটনা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। বলা হচ্ছে, জামায়াতে ইসলামীতে সনাতন ধর্মের অনুসারীদের কেউ কেউ যোগ দিচ্ছেন। কোথাও কোথাও জামায়াতের সনাতনী কমিটি গঠনের খবরও পাওয়া যাচ্ছে।
এমনকি সপ্তাহখানেক আগে খুলনার ডুমুরিয়ায় শুধুমাত্র সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে জামায়াতের একটি হিন্দু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশে জামায়াতের মতো ইসলামপন্থি একটি দলে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের যোগদানের কথা অতীতে তেমন শোনা যায়নি।
তবে সম্প্রতি এমন খবর সামনে আসার পর প্রশ্ন উঠছে— দলটিতে ভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের যোগদান বা অন্তর্ভুক্তির সুযোগ বাস্তবে কতটা আছে? আর জামায়াতই বা কেন সংখ্যালঘুদের দলে নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে?
শৈলকূপার ওই সভায় যাদের সমর্থক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন জামায়াত নেতারা, তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়।
গ্রামটিতে নজিরবিহীনভাবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কারো কারো জামায়াতে যোগ দেওয়ার কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেন ‘নিরাপত্তার আশ্বাসের’ কথা।
তাদের ভাষায়, পাঁচই আগস্টের পর হিন্দু বসতিগুলোতে এক ধরনের ভয়-আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। পরে জামায়াত নেতারা এসে তাদের ‘নিরাপত্তার আশ্বাস’ দেন।
ওরা এসে আমাদের বলে, তোমরা যদি কোনো বিপদে-আপদে পড়, আমরা সহযোগিতা করব, পাশে থাকব। তারা আমাদের মোবাইল নম্বরও নিয়ে রাখছে। এখন এই রকম সাপোর্ট তো অন্যরা কম দিয়েছে। তারা সাপোর্ট দিয়েছে বলে আমরাও তাদের সাপোর্ট দিচ্ছি, বলেন অমল কুমার নামে এক সনাতন ধর্মানুসারী।

একই কথা বলেন আরও কয়েকজন।
উমেদপুর ইউনিয়নের জামায়াত নেতা শওকত আলীও বলেন, আমরা তাদের আহ্বান করছি কারণ তারা আমাদের প্রতিবেশী। তারা স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম পালন করবেন, কিন্তু তাদের নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। আমরা তাদের আহ্বান জানিয়েছি— দাঁড়িপাল্লা প্রতীক ন্যায় ও ইনসাফের প্রতীক, তারা আমাদের কাছ থেকে ন্যায়বিচার পাবেন সবসময়।
বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় সংখ্যালঘু নির্যাতনের দীর্ঘ ইতিহাস আছে।
পাঁচই আগস্টের পরও দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও নিরাপত্তা সংকটের খবর দিয়েছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
দেখা যাচ্ছে, এই নিরাপত্তা সংকটকেই জামায়াত স্থানীয়ভাবে কাজে লাগাচ্ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে যেতে।
জামায়াতে কি হিন্দুদের যোগ দেওয়া বা নেতৃত্বের সুযোগ আছে?
জামায়াত একটি ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দল, যেখানে মুসলিম ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা গুরুত্বপূর্ণ। দলটির নেতৃত্ব বা উপরের স্তরে উঠতে ধর্মীয় বিষয়গুলো মূল ভূমিকা পালন করে।
ফলে এমন দলে ভিন্ন ধর্মের কেউ কীভাবে যোগ দেবেন বা যোগ দিলেও বাস্তবে কতটা ভূমিকা রাখতে পারবেন— তা নিয়ে বিতর্ক আছে।
এছাড়া এমন দলে ভিন্ন ধর্মের কেউ যোগ দিলে তার দলীয় কার্যক্রম কী হবে, সেটাও স্পষ্ট নয়।
জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বিবিসি বাংলাকে বলেন, গঠনতন্ত্র মেনেই তারা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সমর্থক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করছেন।
আমাদের গঠনতন্ত্রেই অমুসলিমদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির বিধান আছে। তবে তাদের মুসলমানদের মতো কোনো শর্ত দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে, জামায়াতের শৃঙ্খলা মেনে চলা, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেওয়া, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ভূমিকা রাখা এবং উপার্জনে অবৈধপন্থা অবলম্বন না করা— এই চারটি শর্ত মানলেই ভিন্ন ধর্মের লোকেরা আমাদের সদস্য হতে পারবেন, বলেন তিনি।
তবে সমালোচকরা মনে করেন, প্রাথমিক সদস্য হিসেবে দলে থাকলেও বাস্তবে ভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের কার্যকর ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই।
কারণ, জামায়াতে ইসলামীতে নেতৃত্ব বা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ভিন্ন ধর্মের কারো যাওয়ার সুযোগ নেই গঠনতন্ত্র অনুযায়ী। ফলে দলটি আসলে কতটা ‘সব ধর্মের জন্য উন্মুক্ত’— তা স্পষ্ট নয়।
তবে জামায়াত এতে সমস্যা দেখছে না
তারা তাদের ফোরামে নেতা হবেন। মূল জামায়াতের নেতৃত্বে আসার সুযোগ বিধি অনুযায়ী নেই। তারা তাদের কমিউনিটিতে নেতৃত্ব দেবেন, দায়িত্ব পালন করবেন, স্থানীয় কমিটিগুলোতেও নেতৃত্ব দেবেন, বলেন গোলাম পরওয়ার।
তাহলে দলটি কতটা কার্যকরভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক হলো?
এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তিনি তো আমার দলে যোগ দিলেই সহযোগী হয়ে গেলেন। এটিই তার অন্তর্ভুক্তি। এরপর তার যোগ্যতা ও দক্ষতা কেমন, সেটা আরেক বিষয়।
নজর হিন্দু ভোটব্যাংকে?
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর হার প্রায় ১০ শতাংশ। দেশের অনেক আসনে সংখ্যালঘু ভোটই জয়-পরাজয় নির্ধারণে ভূমিকা রাখে।
পাঁচই আগস্ট-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ থাকায় সংখ্যালঘু ভোট কোন দিকে যাবে, তা নিয়ে নানা আলোচনা চলছে।
অনেকে মনে করেন, সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিএনপির কিছু প্রভাব থাকলেও ইসলামপন্থি দল হওয়ায় জামায়াত সেখানে ঐতিহাসিকভাবে পিছিয়ে।
ফলে জামায়াত যে এখন অমুসলিম সমর্থক বৃদ্ধিতে জোর দিচ্ছে, তার অন্যতম কারণ হতে পারে সংখ্যালঘু ভোটারদের আকৃষ্ট করা।
সপ্তাহখানেক আগে খুলনায় শুধুমাত্র সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে জামায়াতের যে হিন্দু সম্মেলন হয়েছে, সেটিও ছিল মূলত নির্বাচনী জনসভা। সেখানে জামায়াতের প্রার্থীর পক্ষে দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে অংশ নিতে দেখা যায়।
এছাড়া যেসব আসনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সংখ্যালঘু ভোটার আছে, সেখানে নির্বাচনী প্রচারে সংখ্যালঘু ভোটারদের রাখা ও নির্বাচনী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার কৌশল নিয়েছে জামায়াত।
যদিও জানতে চাইলে গোলাম পরওয়ার বলেন, সংখ্যালঘু বা হিন্দু ভোটারদের ভোটব্যাংক হিসেবে নয়, বরং নাগরিক হিসেবেই তারা বিবেচনা করেন।
তারা ভোটার, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু এটাই সবকিছু নয়। আমরা তাদের ভোটব্যাংক হিসেবে দেখি না, বরং পাশে থাকতে চাই, বলেন তিনি।
তবে জামায়াত যা-ই বলুক, দলটির বিভিন্ন স্থানে সনাতনী কমিটি গঠন ও হিন্দুদের দলে অন্তর্ভুক্তি নিয়ে হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে সন্দেহ ও সংশয় আছে।
বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ মনে করেন, কার্যকর ভূমিকা রাখার সুযোগ না দিয়ে দলে ভিন্ন ধর্মের কাউকে অন্তর্ভুক্ত করা কোনো বাস্তব পরিবর্তন আনবে না।
তারা যেহেতু ধর্মভিত্তিক দল, তাদের চিন্তা-চেতনা ও গঠনতন্ত্রে অন্য ধর্মের লোককে ধারণ করার সুযোগ তেমন নেই। এটা ভোটের রাজনীতি, ভোটের সংখ্যা বাড়ানোর কৌশল। কারণ, তাদের দলে নিলেও কোনো দায়িত্বপূর্ণ কাজ না দিলে সেটা ক্ষণস্থায়ী। দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে না, বলেন তিনি।
তার মতে, জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলোর সংখ্যালঘু নির্যাতন ও হুমকি বন্ধে সোচ্চার হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তা হয়নি। ফলে শুধু ভোট বা সদস্য বানিয়েই সংখ্যালঘুদের সমমর্যাদা, সমান অধিকার ও নিরাপত্তার সংকট মেটানো সম্ভব নয়। সূত্র: বিবিসি বাংলা



















